Ajker Patrika

কয়রার কান্না কি গ্লাসগোয় পৌঁছাল?

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ১০: ২৮
কয়রার কান্না কি গ্লাসগোয় পৌঁছাল?

প্রায় দেড় সপ্তাহের কথা-চালাচালি, আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ, এক দেশ আরেক দেশের ওপর দায় চাপানো, বিশ্বনেতাদের কথার ফুলঝুরি আর প্রায় ৪২ হাজারের বেশি প্রতিনিধি নিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে শেষ হয়েছে। গত তিন দশকে এটি ছিল ২৬তম সম্মেলন। ২০১৯ সালে চিলির পর বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর সম্মেলন আয়োজন করা যায়নি। এবারের সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, প্রায় ২০০টি দেশ জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে; যার সারবস্তু হলো—‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করা।’

‘গ্লাসগো চুক্তি’তে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দায়ী দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণের সুনির্দিষ্ট মাত্রা ঠিক করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে গ্লাসগো সম্মেলন।

সম্মেলন শেষ হওয়ার পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে, তবে এটাই যথেষ্ট নয়। কপ-২৬-এ একটা সমঝোতা হয়েছে, তবে সমাধান হয়নি। বৈশ্বিক তাপমাত্র ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলে আমাদের এই কাজ অব্যাহত রাখতে হবে।’ তার মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানো, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশে অর্থ ছাড়, কয়লার ব্যবহার বন্ধ, কার্বন নিঃসরণের ওপর করারোপ ও বিপদাপন্ন মানুষকে রক্ষায় ‘জরুরি পরিস্থিতি’র মতো কাজ করে যেতে হবে। এই পথ সব সময় সরল নয়। কখনো আঁকাবাঁকা, কখনো খাদ।

তবে সুইডেনের বিখ্যাত জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, ‘এবারের সম্মেলনের সারসংক্ষেপ হলো, ব্লা-ব্লা-ব্লা...।’ তার মতে, আসল কাজ হয়েছে সম্মেলনের বাইরে। তিনি অবশ্য ঠিকই বলেছেন। এবারও সম্মেলনস্থলের বাইরে হাজার হাজার কর্মী নানান কৌশল ব্যবহার করে বিক্ষোভ করে গেছেন। প্রতিবাদের এসব বিকল্প ভাষা সাধারণ মানুষের যেমন নজর কেড়েছে, তেমনি ধনী দেশগুলোর ওপর প্রকারান্তরে চাপ সৃষ্টি করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এ সম্মেলন ছিল ধনী দেশগুলোর কথার ফুলঝুরি।

শুরুতেই দেখা যাক, এবারের সম্মেলনে কোন কোন বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে।

প্রথমত, এবারের সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক চুক্তি থেকে সরে আসার পর গোটা ব্যাপারটার অগ্রগতিই ছিল হুমকির মুখে। অর্থ ছাড়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে দুই মেরুকরণের দেশ চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র আগামী দশকজুড়ে জলবায়ু সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে নজিরবিহীন ঐকমত্য দেখিয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করা এই দুই দেশের যৌথ প্রতিশ্রুতি ছিল রীতিমতো চমক।

২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি ধ্বংসের ইতি টানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শতাধিক দেশ। এবারের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬)-এর এটাই প্রথম কোনো বড় সমঝোতা। প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলও রয়েছে। লাতিন আমেরিকার এই দেশটি এরই মধ্যে আমাজন বনের বড় একটি অংশের গাছ কেটে সাফ করে ফেলেছে। বিশ্বের বনভূমি রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ১৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের তহবিল জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের নেতারা। তবে ২০১৪ সালে করা একই ধরনের আরেকটি চুক্তির পরও বনভূমি রক্ষায় তেমন কোনো সাফল্য দেখা যায়নি। সে বিষয়টি সামনে এনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি। পরবর্তী সময়ে এক বক্তব্যে জানানো হয়েছে, দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি না থাকাই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার মূল কারণ। এবারের সম্মেলনে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা গ্যাসোলিনচালিত গাড়ি উৎপাদন বন্ধ, আকাশপথে ভ্রমণে কার্বন নিঃসরণ কমানো, বন রক্ষার মতো টেকসই উদ্যোগে অর্থ লগ্নি না করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।

তবে ভারতের আপত্তির কারণে বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তনের ইতি টানার উদ্দেশ্যে করা একটি চুক্তি ছাড়াই শেষ হলো। গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট হচ্ছে প্রথম কোনো জলবায়ু চুক্তি, যেখানে কয়লা ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। কয়লাকে বলা হয় গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ জীবাশ্ম জ্বালানি। পূর্ববর্তী দর-কষাকষির খসড়ায় কয়লা ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ভারত নেতৃত্বাধীন বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত নাটকীয় এক পরিসমাপ্তি হয়। শেষ পর্যন্ত দেশগুলো কয়লার ব্যবহার থেকে ‘ধাপে ধাপে পুরোপুরি সরে আসার’ পরিবর্তে ‘ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার’ ব্যাপারে একমত হয়। চুক্তিটা হলে কয়লার ব্যবহার বন্ধে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারত।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো ও তা ছাড় করা সম্মেলনের অন্যতম আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। কিন্তু ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত তহবিল গঠন নিয়ে কপ-২৬-এর খসড়া ঘোষণায় সুনির্দিষ্ট পথরেখা নেই। প্যারিস চুক্তির আওতায় ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত সাকল্যে ৮০ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে জলবায়ু অর্থের মাত্র ২৫ শতাংশ অভিযোজন খাতে পাওয়া গেছে, আর নতুন খসড়ায় যা বৃদ্ধিতে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। যেটি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।

সাধারণ মানুষের কথা যেহেতু এল, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের দিকে নজর দেওয়া যাক।

অংশগ্রহণকারীর দিক থেকে এবারের সম্মেলন রীতিমতো রেকর্ড করেছে। প্রায় ১২০টি দেশ থেকে শুধু নিবন্ধিত অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাই ছিল ৪০ হাজার। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ছিলেন ২২ হাজারের বেশি, ১৪ হাজারের মতো প্রত্যক্ষদর্শী ও ৩ হাজার ৮৫০ সংবাদকর্মী হাজির ছিলেন গ্লাসগোয়। কিন্তু বিশ্বনেতারা একদিকে যখন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, অন্যদিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে হয়েছে দরিদ্র দেশের প্রতিনিধিদের। অধিকাংশ দেশের পরিবেশবিদেরা সম্মেলনে এসে পৌঁছাতে পারেননি। কারণ, করোনাবিধি মেনে তাঁদের পক্ষে এসে পৌঁছানোই সম্ভব হয়নি।

রাষ্ট্রনেতারা ছাড়া সম্মেলনে যোগ দেওয়া অধিকাংশ পরিবেশবিদই অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশের বাসিন্দা, যাঁরা টিকা পেয়ে গেছেন। যাঁদের দেশ থেকে আসার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। কিন্তু দরিদ্র দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল। করোনা ঠেকাতেই ওই সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে বহু পরিবেশবিদ আসতেই পারেননি সেখান থেকে। ১০ বা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের খরচ তুলতে পারেননি বলে অনেকে আসতে পারেননি। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অনেকেই গ্লাসগোয় জায়গা পাননি। পার্শ্ববর্তী শহর এডিনবরায় তাঁদের থাকতে হয়েছে। নিয়মিত সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ এসেছে।

এ তো গেল পরিবেশবিদদের কথা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে যাঁরা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব কে করল গ্লাসগোয়? সম্মেলনে যাওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গে কী কথা বলা হয়েছে? জানতে চাওয়া হয়েছে তাঁদের সমস্যাসমূহ কী? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

গত বছরের মে মাসের ২০ তারিখ ঘূর্ণিঝড় আম্পান বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে আঘাত হানে। খুলনার কয়রা উপজেলার কয়রা, উত্তর বেদকাশিসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় ১৭টি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। ঝড়ের কিছুদিন পর সাধারণ মানুষের উদ্যোগে বাঁধের কিছু স্থান মেরামত করা গেলেও কয়েকটি ভাঙন এত ভয়াবহ ছিল যে, সেগুলো আর মেরামত করা যায়নি; ফলে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে ভাসতে থাকল সেসব গ্রামের মানুষের জীবন। বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিল রাস্তায়, বেড়িবাঁধে কিংবা স্কুলঘরে। বাঁধ মেরামতে লেগে গেল ছয় মাস। এই ছয় মাসে তাঁদের কাছে ত্রাণ পৌঁছায়নি বললেই চলে। প্রথম কিছুদিন কিছু সহায়তা পেলেও এরপর সেসব সহায়তাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায় ১২ হাজার মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। শুধু কয়রা নয়, বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে দাকোপ হয়ে শ্যামনগরের গাবুরা—গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের গল্প এটি। যেখানে একটু একটু করে খাওয়ার পানি হয়ে উঠছে দুষ্প্রাপ্য! এক কলস খাওয়ার পানির জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হচ্ছে তাঁদের! মাটির তলদেশ হয়ে উঠছে নোনাপানির সংসার।

এবারের জলবায়ু সম্মেলনে কি তাঁদের কথা উঠল? ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড় হলে কি তাঁদের নোনাপানির কষ্ট কমবে? ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়ে আবারও বাঁধ ভাঙলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের ঘরে খাবার পৌঁছাবে? ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বেড়িবাঁধের জন্য বাজেট বরাদ্দ কি হবে? সেটা যদি না হয়, যদি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের টাকায় ঢাকার বনানীতে লিফটচালিত ফুটওভারব্রিজ বসে, আরও তিন দশকে যদি আরও ২৫টি সম্মেলনও হয়, সেসব সম্মেলনের জন্য যদি পৃথিবীর আরও সুন্দর সুন্দর শহর বেছে নেওয়া হয়, তবে সেসব সম্মেলন প্রমোদভ্রমণই হয়ে থাকবে। যাঁরা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, হোক কয়রা কিংবা শরণখোলা, দিল্লি, নাইরোবি কিংবা মাদাকাস্কারের ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষ, তাঁদের কাছে এসবের সারাংশ শূন্য!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত