দখলদারদের কবলে বধ্যভূমি

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৭: ৫২
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬: ১৫

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান রায়েরবাজার বধ্যভূমি। যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে এনেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। সেই স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৯ সালে বধ্যভূমিতে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ। কিন্তু পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালের অভাবে রাষ্ট্রীয় এ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়েছে।

কী নেই এখানে! রাজনৈতিক দলের কার্যালয় থেকে দোকানপাট, নার্সারি থেকে রিকশার গ্যারেজ, সবই আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বধ্যভূমির জায়গা দখল করে গত পাঁচ বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বধ্যভূমির এমন অবস্থা হয়েছে। জায়গাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন। কিন্তু এসব নিয়ে যেন কারও মাথাব্যথা নেই।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, বধ্যভূমির ঠিক সামনে ডিএনসিসি ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের প্রধান কার্যালয়, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের ওয়ার্ড কার্যালয় ও জাতীয় শ্রমিক লীগের ইউনিট কার্যালয় রয়েছে। গেটের দুই পাশে ২৫টি করে ৫০টি প্লট করা হয়েছে। ৩৬ বাই ৫০ ফিট জায়গার এসব প্লটের প্রায় ৩৮ টিতে ফুল ও ফলের নার্সারি। আর ১২টি প্লটে রয়েছে রিকশা, ট্রাক ও লেগুনার গ্যারেজ।

রিকশার একটি গ্যারেজের মালিক আয়নুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভাড়া নিয়েই এখানে থাকছি। প্রভাশালীদের পরিচয়ে পোলাপানরা আসে। আমরা তাদের মাসে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে দিই।’ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দোকানপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে চাঁদা তোলা হয়। ৫০টি দোকান থেকে বছরে যা ৬০ লাখের মতো হয়। এভাবে ২০১৭ সাল থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন দখলদারেরা। বধ্যভূমির গেট থেকে দক্ষিণ অংশে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড অংশের চাঁদা তোলেন স্থানীয় বনফুল নার্সারির মালিক শাহ আলম। আর উত্তর অংশের চাঁদা তোলেন মায়ের দোয়া গার্ডেন সেন্টারের মালিক মাসুম বিল্লাহ। এরপর টাকা ভাগাভাগি হয়ে যায় বিভিন্ন হাতে।

গড়ে উঠেছে দোকানপাট, নার্সারি, দলীয় কার্যালয়।  পাঁচ বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়েছে।  দখলের নেপথ্যে প্রভাবশালী ও অসাধু কর্মকর্তা। জানতে চাইলে বনফুল নার্সারির শাহ আলম বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলরের সহযোগিতা পাচ্ছি। জোরপূর্বক কারও থেকে টাকা নিই না। আলোচনা করেই আমরা টাকার পরিমাণ ঠিক করি। গত বছর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ একবার উচ্ছেদ করতে এসেছিল। আমরা ম্যানেজ করে নিয়েছি।’ আরেক চাঁদা সংগ্রহকারী মায়ের দোয়া গার্ডেনের মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘অবৈধ জায়গায় নার্সারি করেছি, মনে ভয় আছে। তবে খারাপ কিছু করছি না। গাছ বিক্রি করে ডাল-ভাত খাই।’ ডিএনসিসির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ হোসেন (খোকন) বলেন, ‘অবৈধ দোকান থেকে আমি কোনো টাকা নিই না। থানা-পুলিশ বা অন্য কেউ খাইতে পারে। একটা গ্রুপের টাকা শাহ আলম তোলে, এটা আমি জানি।’

অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মো. আব্দুল লতিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বধ্যভূমির সামনে নার্সারি আছে, এটা ঠিক। আমরা কাউকে বসাইনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো টাকা নিই না। কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদা আদায়ের সঙ্গে জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’

ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ বলেন, বধ্যভূমি দেখভাল করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। জায়গাটির পবিত্রতা রক্ষায় অবশ্যই অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে।

দখলদারদের উচ্ছেদ করে বধ্যভূমির সামনে সৌন্দর্যবর্ধনে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে জানিয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বধ্যভূমির জায়গা দখলমুক্ত করতে শিগগিরই পদক্ষেপ নেব। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থানটির মান-মর্যাদা সব সময় সমুন্নত থাকুক।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত