নিম্নবিত্তের কষ্ট বাড়বে
যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তা অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয়। একেবারেই এত দাম বাড়ানো উচিত হয়নি। প্রয়োজন হলে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে দাম সমন্বয় করা যেত। এতে একেবারে এত বড় ধাক্কা পড়ত না। কারণ, এখন মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তার ওপর ডলারের দামও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক চড়া।
ভর্তুকি না কমিয়ে সরকারের তো কৃচ্ছ্রসাধনের আরও অনেক সুযোগ ছিল। অনেক খাতে প্রচুর অপচয় হচ্ছে। অনেক অপ্রয়োজনী প্রকল্প রয়েছে। সেসব খাতে খরচ কমানোর প্রচুর সুযোগ ছিল। কিন্তু সেগুলোতে সে রকম নজর না দিয়ে শুধু তেলে ভর্তুকি তুলে দিয়ে, দাম বাড়িয়ে গরিবসহ সব শ্রেণির মানুষেরই কষ্ট বাড়ানো হলো।
যেকোনো জিনিসেরই সময় নিয়ে সমন্বয় করা উচিত। যেমন আমরা আগেও বলেছিলাম ডলারের বিপরীতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন দরকার আছে। কিন্তু তা করা হয়নি। এখন এক লাফে ৮৫ টাকার ডলার ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে।
তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে অনেকেই বলেন, ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে তো তেলের দাম অনেক কম। তা ছাড়া, এ দেশে দাম কম হলে ভারতে পাচার হয়ে যাবে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কি আমাদের সবকিছুতে তুলনা চলে? শুধু তেলের দাম কম দেখলেই হবে না। অন্য অনেক কিছু তাদের মতো আছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। আর পাচারের কথাই যদি বলি, পাচার রোধে তো সীমান্তে আমাদের বাহিনী আছে। তাই দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলেই মনে করি।
বিশ্বে কমছে, বাড়ানোর যুক্তি নেই
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, তাই এ মুহূর্তে দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত। একেবারেই প্রায় ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোরও কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না। এখন যে পরিমাণ দাম বেড়েছে, আর আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম কমছে, তাতে তো বিপিসির ভর্তুকি কাটিয়ে লাভও থাকবে। কিন্তু অর্থনীতির এ কঠিন সময়ে বিপিসির তো লাভের চিন্তা করা উচিত নয়।
দাম বাড়ার প্রভাবে সব ধরনের পরিবহন খরচ বাড়বে। এতে মানুষের যাতায়াতের খরচসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ব্যবসা-উদ্যোক্তা-সরবরাহ—সব পর্যায়ে খরচ বেড়ে যাবে। খরচ বাড়লে উৎপাদন কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে সরবরাহ কমে যাবে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে তো কোনো কিছুতে খরচ বাড়ার তুলনায় দাম বেড়ে যায় অনেক বেশি।
এখন দাম বাড়ার মূল চাপ পড়বে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ও দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে থাকা মানুষের ওপর। কারণ, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হবে, আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরের লোকজন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়ে যাবে।
যদিও সরকার বলছে, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে আমাদের দেশে একবার দাম বাড়লে তা আবার কমার উদাহরণ খুবই কম। আবার যদি দাম কমেও, তবে যে হারে বাড়ে, সে হারে আর কমে না।
সঠিক সময় নয়
সরকারকে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতেই হতো। তবে দাম সমন্বয়ের এটা সঠিক সময় ছিল না। দামও বেড়েছে অনেক বেশি। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বেড়ে গেল। কারণ, এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান এখন অনেক কমেছে। এই অবস্থায় তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে। গণপরিবহন, পণ্য পরিবহনসহ সব খাতেই খরচ বেড়ে যাবে। যার চাপ নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর বেশি পড়বে। এই অবস্থায় যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের এখন সহায়তা আরও বেশি প্রয়োজন হবে।
তবে জ্বালানির এ দাম বেড়েছে মূলত রাজস্ব আহরণে দুর্বল অবস্থার জন্য। কারণ, রাজস্ব সক্ষমতা কম থাকায় এসব খাতে সরকার যে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল, তা দেওয়ার ক্ষমতা আর সরকারের ছিল না।
জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে
সরকার জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণে এত দিন ধরে যে অ্যাডমিনিস্টার্ড প্রাইস মেকানিজম অনুসরণ করত, তা থেকে সরে এসেছে। এই মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরকার জনগণকে স্বস্তি দিতে মূল্যটা সহনশীল রাখত। যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা সাংঘাতিক রকমের বেশি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকার সময় যখন আমরা বলতাম, ভর্তুকি কমান; তখন সরকার বলত, দাম বাড়ানো যাবে না। দাম বাড়ালে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আর এখন এমন সময় দাম বাড়ানো হলো, যখন দেশের অর্থনীতি চাপে আছে এবং মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দৈন্যর মধ্যে আছে। সরকার যদি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বাড়ায়, তাহলে জনগণের বিষয়ে চিন্তা করল কই। সরকার যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়, তাহলে কখনোই বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করবে না। যে প্রক্রিয়ার দাম বাড়ানো হয়েছে, তা অবৈধ। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য যদি দাম বাড়াতে হয়, তাহলে বিইআরসির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। বিইআরসির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করলে যে সুবিধাটা হবে—দাম বাড়লে দাম বেশি দেব, কমলে কম দেব। কিন্তু সরকার সেটা না করে দাম বাড়লে বাড়াচ্ছে, কিন্তু কমলে আর কমাচ্ছে না।
তেলের যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অসহনীয়। এই দাম বাড়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে আমাদের মৌলিক জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় জনগণের যে অধিকার, তা সরকার রাখল না।
সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এখন জ্বালানির ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভঙ্গুর অবস্থায় আছি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার এখন করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০০৯ সালের দিকে আমাদের জ্বালানি কম ছিল, কিন্তু বর্তমান অবস্থার মতো অনিশ্চিত ছিলাম না।
এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনো অবস্থাতেই সমীচীন হবে না। তবে দেখা যাচ্ছে, একদিকে ডলারের সংকট, জ্বালানি তেলের দাম, ভোজ্যতেলের দাম—এসব বিবেচনায় নিলে মনে হচ্ছে, সংকটটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।
সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সরকারের খুবই সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত। এই দাম বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আগামী ছয় মাস পর এই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। আমরা যদি জ্বালানি তেলের দাম এখন সমন্বয় না করি, তাহলে অর্থনীতি নিয়ে বিরাট একটা ঝামেলায় পড়তে হবে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আইএমএফ থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার একটা যোগসূত্র আছে। কারণ, আইএমএফ জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, সরকার আইএমএফের সঙ্গে ঋণ নিয়ে দর-কষাকষি করছে। আইএমএফের কাছেও মনে হচ্ছে, সরকার জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমাতে আন্তরিক। এই দাম বাড়ার ফলে সরকার আইএমএফকে একটা সিগন্যাল দিচ্ছে।
ডিজেলের দাম পৃথিবীর কোনো দেশে সস্তা নয়। আমাদের এখানে কৃত্রিমভাবে দাম কমিয়ে রাখা হতো। ভবিষ্যতে ফসিল ফুয়েলের ওপর ভর্তুকি উঠিয়ে দিতে হবে। আমরা ফসিল ফুয়েলের ওপর ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে এগিয়ে গেলাম। এই দাম বাড়ানো তারই একটা পদক্ষেপ।
আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত এখনই সরকারকে ঘোষণা করতে হবে। অকটেন ও পেট্রলের ওপর বেশি দাম বাড়িয়ে ডিজেলের ওপর যে ভর্তুকি ছিল, সরকার এখানে একটা সমন্বয় করেছে।
ডিজেলের দাম ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। সামনে ডিজেলের দাম আরও পড়তে থাকবে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে গরিব মানুষের ভোগান্তি লাঘবে সরকারের উচিত সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়ে সহায়তা করা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হবে, ফলে পণ্যের দাম বাড়বে।
মূল্যস্ফীতি বাড়বে
আমরা সংকটকালে শুধু স্বল্পকালীন সমাধানের দিকে যাই। এভাবে ১৫-১৬ বছর পার করেছি। কিন্তু সবকিছুতে বহুমাত্রিক বিকল্প ব্যবস্থা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হতো। এত দিনে আমাদের উৎপাদন শুরু হলে জ্বালানির খরচ কমে যেত। এসব না করে আমরা এলএনজি আনছি। এতে সমাধান হবে না। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেচ, সার, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় সহযোগিতা করতে হবে। এত বেশি দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; বিশেষ করে কৃষি খাতে। খাদ্যনিরাপত্তায়ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তবে এটা স্বল্প সময়ের জন্য সমাধানের উপায় হতে পারে।
অর্থনীতি নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা
হঠাৎ জ্বালানির মূল্য এত বেশি বৃদ্ধিতে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারখানায় পণ্য উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু পণ্যের দাম তো রাতারাতি বৃদ্ধি করা যায় না। আর বিদেশের ক্রেতারা তো আগের দামে পণ্য ক্রয়ের আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরা হঠাৎ বেশি দাম বাড়াতে অভ্যস্তও না। দাম সমন্বয় করতে না পারলে অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। যার ফলে শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা কর্মহারা হতে পারেন। আর করোনার পরে চলমান সংকটের কারণে অন্যত্র নতুন চাকরি পাওয়াটাও সহজ হবে না। যদিও সংকটকালে সরকারের কর্মসংস্থানে বিশেষ নজর রাখা উচিত।
এদিকে বাংলাদেশে তো কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা সহজে কমে না। পাশাপাশি কোনো পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়ালে ব্যবসায়ীরা বাড়ান কমপক্ষে ৩০ শতাংশ। আর পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব পড়ে জনজীবনে। বেড়ে যাবে বাজারের পণ্যমূল্য।
নিম্নবিত্তের কষ্ট বাড়বে
যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তা অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয়। একেবারেই এত দাম বাড়ানো উচিত হয়নি। প্রয়োজন হলে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে দাম সমন্বয় করা যেত। এতে একেবারে এত বড় ধাক্কা পড়ত না। কারণ, এখন মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তার ওপর ডলারের দামও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক চড়া।
ভর্তুকি না কমিয়ে সরকারের তো কৃচ্ছ্রসাধনের আরও অনেক সুযোগ ছিল। অনেক খাতে প্রচুর অপচয় হচ্ছে। অনেক অপ্রয়োজনী প্রকল্প রয়েছে। সেসব খাতে খরচ কমানোর প্রচুর সুযোগ ছিল। কিন্তু সেগুলোতে সে রকম নজর না দিয়ে শুধু তেলে ভর্তুকি তুলে দিয়ে, দাম বাড়িয়ে গরিবসহ সব শ্রেণির মানুষেরই কষ্ট বাড়ানো হলো।
যেকোনো জিনিসেরই সময় নিয়ে সমন্বয় করা উচিত। যেমন আমরা আগেও বলেছিলাম ডলারের বিপরীতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন দরকার আছে। কিন্তু তা করা হয়নি। এখন এক লাফে ৮৫ টাকার ডলার ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে।
তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে অনেকেই বলেন, ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে তো তেলের দাম অনেক কম। তা ছাড়া, এ দেশে দাম কম হলে ভারতে পাচার হয়ে যাবে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কি আমাদের সবকিছুতে তুলনা চলে? শুধু তেলের দাম কম দেখলেই হবে না। অন্য অনেক কিছু তাদের মতো আছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। আর পাচারের কথাই যদি বলি, পাচার রোধে তো সীমান্তে আমাদের বাহিনী আছে। তাই দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলেই মনে করি।
বিশ্বে কমছে, বাড়ানোর যুক্তি নেই
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, তাই এ মুহূর্তে দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত। একেবারেই প্রায় ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোরও কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না। এখন যে পরিমাণ দাম বেড়েছে, আর আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম কমছে, তাতে তো বিপিসির ভর্তুকি কাটিয়ে লাভও থাকবে। কিন্তু অর্থনীতির এ কঠিন সময়ে বিপিসির তো লাভের চিন্তা করা উচিত নয়।
দাম বাড়ার প্রভাবে সব ধরনের পরিবহন খরচ বাড়বে। এতে মানুষের যাতায়াতের খরচসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ব্যবসা-উদ্যোক্তা-সরবরাহ—সব পর্যায়ে খরচ বেড়ে যাবে। খরচ বাড়লে উৎপাদন কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে সরবরাহ কমে যাবে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে তো কোনো কিছুতে খরচ বাড়ার তুলনায় দাম বেড়ে যায় অনেক বেশি।
এখন দাম বাড়ার মূল চাপ পড়বে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ও দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে থাকা মানুষের ওপর। কারণ, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হবে, আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরের লোকজন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়ে যাবে।
যদিও সরকার বলছে, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে আমাদের দেশে একবার দাম বাড়লে তা আবার কমার উদাহরণ খুবই কম। আবার যদি দাম কমেও, তবে যে হারে বাড়ে, সে হারে আর কমে না।
সঠিক সময় নয়
সরকারকে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতেই হতো। তবে দাম সমন্বয়ের এটা সঠিক সময় ছিল না। দামও বেড়েছে অনেক বেশি। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বেড়ে গেল। কারণ, এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান এখন অনেক কমেছে। এই অবস্থায় তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে। গণপরিবহন, পণ্য পরিবহনসহ সব খাতেই খরচ বেড়ে যাবে। যার চাপ নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর বেশি পড়বে। এই অবস্থায় যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের এখন সহায়তা আরও বেশি প্রয়োজন হবে।
তবে জ্বালানির এ দাম বেড়েছে মূলত রাজস্ব আহরণে দুর্বল অবস্থার জন্য। কারণ, রাজস্ব সক্ষমতা কম থাকায় এসব খাতে সরকার যে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল, তা দেওয়ার ক্ষমতা আর সরকারের ছিল না।
জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে
সরকার জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণে এত দিন ধরে যে অ্যাডমিনিস্টার্ড প্রাইস মেকানিজম অনুসরণ করত, তা থেকে সরে এসেছে। এই মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরকার জনগণকে স্বস্তি দিতে মূল্যটা সহনশীল রাখত। যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা সাংঘাতিক রকমের বেশি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকার সময় যখন আমরা বলতাম, ভর্তুকি কমান; তখন সরকার বলত, দাম বাড়ানো যাবে না। দাম বাড়ালে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আর এখন এমন সময় দাম বাড়ানো হলো, যখন দেশের অর্থনীতি চাপে আছে এবং মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দৈন্যর মধ্যে আছে। সরকার যদি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বাড়ায়, তাহলে জনগণের বিষয়ে চিন্তা করল কই। সরকার যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়, তাহলে কখনোই বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করবে না। যে প্রক্রিয়ার দাম বাড়ানো হয়েছে, তা অবৈধ। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য যদি দাম বাড়াতে হয়, তাহলে বিইআরসির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। বিইআরসির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করলে যে সুবিধাটা হবে—দাম বাড়লে দাম বেশি দেব, কমলে কম দেব। কিন্তু সরকার সেটা না করে দাম বাড়লে বাড়াচ্ছে, কিন্তু কমলে আর কমাচ্ছে না।
তেলের যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অসহনীয়। এই দাম বাড়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে আমাদের মৌলিক জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় জনগণের যে অধিকার, তা সরকার রাখল না।
সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এখন জ্বালানির ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভঙ্গুর অবস্থায় আছি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার এখন করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০০৯ সালের দিকে আমাদের জ্বালানি কম ছিল, কিন্তু বর্তমান অবস্থার মতো অনিশ্চিত ছিলাম না।
এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনো অবস্থাতেই সমীচীন হবে না। তবে দেখা যাচ্ছে, একদিকে ডলারের সংকট, জ্বালানি তেলের দাম, ভোজ্যতেলের দাম—এসব বিবেচনায় নিলে মনে হচ্ছে, সংকটটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।
সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সরকারের খুবই সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত। এই দাম বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আগামী ছয় মাস পর এই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। আমরা যদি জ্বালানি তেলের দাম এখন সমন্বয় না করি, তাহলে অর্থনীতি নিয়ে বিরাট একটা ঝামেলায় পড়তে হবে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আইএমএফ থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার একটা যোগসূত্র আছে। কারণ, আইএমএফ জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, সরকার আইএমএফের সঙ্গে ঋণ নিয়ে দর-কষাকষি করছে। আইএমএফের কাছেও মনে হচ্ছে, সরকার জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমাতে আন্তরিক। এই দাম বাড়ার ফলে সরকার আইএমএফকে একটা সিগন্যাল দিচ্ছে।
ডিজেলের দাম পৃথিবীর কোনো দেশে সস্তা নয়। আমাদের এখানে কৃত্রিমভাবে দাম কমিয়ে রাখা হতো। ভবিষ্যতে ফসিল ফুয়েলের ওপর ভর্তুকি উঠিয়ে দিতে হবে। আমরা ফসিল ফুয়েলের ওপর ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে এগিয়ে গেলাম। এই দাম বাড়ানো তারই একটা পদক্ষেপ।
আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত এখনই সরকারকে ঘোষণা করতে হবে। অকটেন ও পেট্রলের ওপর বেশি দাম বাড়িয়ে ডিজেলের ওপর যে ভর্তুকি ছিল, সরকার এখানে একটা সমন্বয় করেছে।
ডিজেলের দাম ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। সামনে ডিজেলের দাম আরও পড়তে থাকবে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে গরিব মানুষের ভোগান্তি লাঘবে সরকারের উচিত সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়ে সহায়তা করা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হবে, ফলে পণ্যের দাম বাড়বে।
মূল্যস্ফীতি বাড়বে
আমরা সংকটকালে শুধু স্বল্পকালীন সমাধানের দিকে যাই। এভাবে ১৫-১৬ বছর পার করেছি। কিন্তু সবকিছুতে বহুমাত্রিক বিকল্প ব্যবস্থা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হতো। এত দিনে আমাদের উৎপাদন শুরু হলে জ্বালানির খরচ কমে যেত। এসব না করে আমরা এলএনজি আনছি। এতে সমাধান হবে না। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেচ, সার, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় সহযোগিতা করতে হবে। এত বেশি দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; বিশেষ করে কৃষি খাতে। খাদ্যনিরাপত্তায়ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তবে এটা স্বল্প সময়ের জন্য সমাধানের উপায় হতে পারে।
অর্থনীতি নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা
হঠাৎ জ্বালানির মূল্য এত বেশি বৃদ্ধিতে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারখানায় পণ্য উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু পণ্যের দাম তো রাতারাতি বৃদ্ধি করা যায় না। আর বিদেশের ক্রেতারা তো আগের দামে পণ্য ক্রয়ের আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরা হঠাৎ বেশি দাম বাড়াতে অভ্যস্তও না। দাম সমন্বয় করতে না পারলে অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। যার ফলে শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা কর্মহারা হতে পারেন। আর করোনার পরে চলমান সংকটের কারণে অন্যত্র নতুন চাকরি পাওয়াটাও সহজ হবে না। যদিও সংকটকালে সরকারের কর্মসংস্থানে বিশেষ নজর রাখা উচিত।
এদিকে বাংলাদেশে তো কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা সহজে কমে না। পাশাপাশি কোনো পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়ালে ব্যবসায়ীরা বাড়ান কমপক্ষে ৩০ শতাংশ। আর পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব পড়ে জনজীবনে। বেড়ে যাবে বাজারের পণ্যমূল্য।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে