খেজুর গুড়ের সমৃদ্ধির ঐতিহ্য ফিরে আসুক

শাইখ সিরাজ
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮: ১০

এক দশকের বেশি সময় ধরে আমি খেজুর গুড়ের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছি টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও আমার লেখালেখিতে। তুলে ধরেছি গাছিদের নানা সংকটের কথা। প্রচার-প্রচারণায় বেড়েছে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের চাহিদা। গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণা এবং সরকারের, প্রশাসনের উদ্যোগে খেজুর গুড় উৎপাদনের তাগিদ ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মাঝে। ফলে খেজুরগাছ রোপণ থেকে রস আহরণ এবং গুড় উৎপাদনে উদ্যোগী হচ্ছেন অনেকেই।

প্রকৃতির অনন্য আশীর্বাদ এই খেজুরগাছ। মরু অঞ্চলের খেজুরগাছ থেকে পাওয়া যায় পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। আর এই অঞ্চলের খেজুরগাছ 
থেকে শীতকালে আহরণ করা হয় সুমিষ্ট রস। ফলে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে খেজুর রসের ইতিহাস জড়িয়ে গেছে। পিঠা-পুলি থেকে 
খেজুরের গুড়...মোহনীয় ঘ্রাণে বেঁধেছে আমাদের জীবনযাপনকে।

শীতের সকালে রোদে বসে খেজুর রস কিংবা খেজুরের গুড় দিয়ে এক বাটি মুড়ির তৃপ্তি অন্য কিছুতে পাওয়া যাবে না। রসনাতৃপ্তির জন্য 
একসময় বাদামি চিনি তৈরি হতো এই খেজুরের গুড় দিয়ে। যে বাদামি চিনির খ্যাতি শুধু বাংলাদেশেই নয়, ছিল বিশ্বজুড়ে। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আমাদের সেই সমৃদ্ধি। তবে এখনো বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে চলে খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির প্রক্রিয়া।

কয়েক দিন আগে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল যশোরের চৌগাছায়। কথা বলেছিলাম চৌগাছার গাছি হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে। তিনি চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। গাছ কাটা, রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুড় বানানো পর্যন্ত সব কাজই করেন নিজ হাতে। তিনি বললেন, আগের মতো খেজুরগাছ নেই, একই সঙ্গে কমছে গাছির সংখ্যাও। গাছিদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আগ্রহী হচ্ছে না। সংকটের আরেকটি কারণ পরিশ্রম ও উৎপাদন খরচ অনুযায়ী গুড়-পাটালির ন্যায্য দাম না পাওয়া।

রফিকুল ইসলাম ও কেনু মণ্ডল নামের দুজন খেজুরগাছ থেকে রস পাড়ছিলেন। কথা হয় তাঁদের সঙ্গেও। রফিকুল ইসলাম বলেন, কালের বিবর্তনে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরের গাছ ও রস। একসময় রাস্তার মেঠোপথের দুই পাশেই চোখ বোলালে চোখে পড়ত খেজুরগাছের সারি। আর এখন এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে দিন দিন খেজুরের গাছ কমতে থাকায় গাছিরাও বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা।

বছর বিশেক আগেও কনকনে শীতে হারিকেন জ্বালিয়ে খেজুর রস চোরের ভয়ে গভীর রাত পর্যন্ত রসের হাঁড়ি পাহারা দিতে হতো। পুরো শীতকাল ব্যস্ত থাকতে হতো খেজুরের রস এবং রসের গুড় তৈরি নিয়ে। এখন যে গাছগুলো আছে তাতেও তেমন রস মিলছে না। শীতের সময় রস সংগ্রহের পরে গাছগুলো আর পরিচর্যা করা হয় না বলে গাছে শীতের সময় রস হয় না; বিশেষ করে প্রতিটি এলাকায় কৃষকেরা তাঁদের অভাব-অনটনের কারণে রসের খেজুরগাছগুলো কেটে ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে সংকট দেখা দিচ্ছে রস সংগ্রহের জন্য গাছের।

একদিকে চাহিদার তুলনায় রসের জোগান অনেক কম, অন্য দিকে ভেজাল গুড়ে বাজার সয়লাব। এতে করে আসল খেজুর গুড়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। চৌগাছার হাজীপুর গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা হয়।

তাঁরা জানালেন, ইটভাটা, গাছি-সংকট, ধান-সবজির চাষ—এই তিন কারণে যশোরের ঐতিহ্যের খেজুর গুড় হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীরা খেজুর গুড়ে চিনি মেশানোর কারণে চিরচেনা সেই স্বাদও আর থাকছে না। শীত মৌসুমে নলেন গুড়ের পায়েস, রস পিঠা, নারকেল পুলি ঐতিহ্যের এই পিঠা-পায়েসও কেবল খেজুর গুড়ের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।

একবার গাছকাটার পর দুই-তিন দিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। প্রথম দিনের রসকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় জিরেন। জিরেন রস থেকেই হয় নলেন গুড়। গাছ কাটার ওপর যেমন রসের তারতম্য, তেমনি গুড়ের মানও নির্ভর করে রসের ওপর। নলেন গুড়ের সুঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি। দোকাটের রসে হয় পাটালি আর দানাগুড়। এই অঞ্চলে তৃতীয় কাট বা নিমঝরা রস সংগ্রহ করা হয় না। নিমঝরা রসের গুড় হয় কিছুটা টক টক। দিনের বেলার রস ‘ওলা’। সেই রসের গুড়ের স্বাদ তেমন ভালো হয় না।

আমি হৃদয়ে মাটি ও মানুষের নানা পর্বে যশোরের খাজুরার গুড় তৈরির দৃশ্য যেমন তুলে ধরেছি, তুলে ধরেছি মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড় তৈরির প্রক্রিয়াও। খেজুরের গুড় ছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলের গোলপাতার গুড়ের গল্পও তুলে ধরেছি। ২০১৭ সালে প্রথম হাজারি গুড়ের উৎপাদন চিত্র তুলে ধরি।

তখন এর ঐতিহাসিক গল্পগুলো ঠিকই ছিল, কিন্তু বহু মানুষের তৎপরতায় হাজারির আসল ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। সে সময় মনে হয়েছিল, মানিকগঞ্জ জেলার অন্যতম সেরা ঐতিহ্য এই হাজারি গুড় যুক্ত হওয়া উচিত জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে। বিষয়টি চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানেও তুলে ধরেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় মানিকগঞ্জের তৎকালীন পৌর মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম ও চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি গোলাম সারওয়ার সানু বিষয়টি নিয়ে জোরালো তৎপরতা চালান। পরে জেলার ব্র্যান্ডিং হয়—‘লোকসংগীত আর হাজারি গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর’।

ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ বইয়ে পাওয়া যায়, ১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধু যশোরেই তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ গুড়। ১৮৬১ সালে মিস্টার নিউ হাউস চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের তীর এলাকার তাহেরপুরে প্রথম খেজুরের গুড় উৎপাদনের যান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলেন। ওই কারখানার উৎপাদিত গুড় ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে ওঠে। সেই সমৃদ্ধির গল্প কবেই তলিয়ে গেছে। তবে এখন খেজুর গুড়ের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য বলছে, দেশে প্রতিবছর সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টন গুড় উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে খেজুর ও তালের রস থেকে উৎপাদিত গুড়ের পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন। এর বড় অংশই খেজুরের গুড়। ধীরে ধীরে পরিধি বাড়ছে খেজুর গুড়ের বাজারের।

গুড় তৈরির প্রক্রিয়াটি শুদ্ধতম চর্চা হিসেবে খ্যাত। যশোরের খেজুর গুড়কে ভৌগোলিক নির্দেশক, অর্থাৎ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলছে। একদিকে দেশের বাজারে চিনির বিকল্প গুড়ের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাড়বে আন্তর্জাতিক কদর। আমাদের আদি ঐতিহ্যের ধারক খেজুর গুড়ের গুণ ও ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বব্যাপী।

খেজুরের রস আহরণ থেকে শুরু করে গুড় তৈরির প্রতিটি প্রক্রিয়া হতে হবে শুদ্ধ। গুড়ের শিল্পকে আরও অগ্রসর করতে প্রয়োজন নানাবিধ গবেষণা এবং এই খাতে পরিকল্পিত বিনিয়োগ। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের খেজুর গুড়ের মোহনীয় ঘ্রাণে একদিন মোহিত হবে সারা বিশ্ব।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত