গোলাম মুস্তাফা
একাত্তরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের কোনো এক রাতে আমি পাইওনিয়ার প্লাটুনের টিম নিয়ে শত্রু-এলাকায় যাচ্ছি ওদের দুই বাংকারের চলাচলের মাঝামাঝি স্থানে মাইন লাগানোর পরিকল্পনা নিয়ে। এসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আমাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর জাফর ইমামের নিজ হাতে গড়া পাইওনিয়ার প্লাটুনের ‘বিচ্ছু’দের জন্য এসব ‘কিচ্ছু’ না। সফিক, খোকন, হারুন, বেলাল ও শহীদ আমার সঙ্গী। হাতে আমাদের স্টেনগান। সঙ্গে পরিমাণমতো পি-২ অ্যান্টি পার্সোনাল প্লাস্টিক মাইন। অন্ধকার রাত। জমির আলের ওপর দিয়ে নীরবে ও সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছি। কারও মুখে কথা নেই। এক সারিতে এগোচ্ছি সবাই। সামনে আমি। হঠাৎ পা পিছলে কাত হয়ে বাঁদিকে নরম প্যাঁক-কাদাযুক্ত ধানখেতের মধ্যে পড়ে গেলাম। খানিকের মধ্যেই তড়াক করে আবার উঠে গেলাম। রসিকতা করে ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় নিম্ন স্বরে শহীদ কথা বলে উঠল, প্রমিত ভাষায় যা এ রকম দাঁড়ায়: ‘ডান দিকের তুলনায় তোমার বাঁ দিকের গোঁফ বাড়াবাড়ি রকমের তাড়াতাড়ি বড় এবং ভারী হয়ে গেছে। ফলে শরীরের ব্যালান্স হারানোতেই তুমি বাঁ দিকে কাত হয়ে পড়ে গেছ। কালকেই বাঁ দিকের গোঁফ পরিমাণমতো ছেঁটে শরীরের ওজনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে।’ শুনে দু-তিনজন সহযোদ্ধা একটু শব্দ করে হেসে উঠল।
পাকিস্তানিদের বাংকার থেকে আমরা তখনো বেশ দূরে। কিন্তু তারা মনে হয় হাসির ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যেই গুলি শুরু করে দিল। ক্ষণিকের মধ্যেই আমরা সবাই কাদাযুক্ত ধানখেতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ কাত, কেউবা চিত। আমি আছি উপুড় হয়ে। হঠাৎ মনে হলো বাতাসের বেগ তৈরি করে বেশ কিছু বুলেট আমার মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। গুলি থেকে বাঁচার আশায় আমি নরম মাটির মধ্যে চাপ দিয়ে মাথাটা আরও গভীরে ঢোকাতে থাকলাম। একসময় নাক শক্ত মাটিতে গিয়ে ঠেকে গেল। আর গভীরে যায় না। এদিকে নিশ্বাসের অভাবে বুক ফেটে যাচ্ছে। নাক ও মাথা কাদার মধ্যে। জানি এখানে বাতাস নেই। গুলির ভয়ে মাথাও ওঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু একপর্যায়ে আর পারা গেল না। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি পরাজিত হলো। নিজের অজান্তেই নিশ্বাস নেওয়া শুরু হলো। আহ্ কী শান্তি! যেন শীতল নরম বাতাস নাকের ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে হৃৎপিণ্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার প্রিয় একটি গানের কলি, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’। কিন্তু পরমুহূর্তেই নাসারন্ধ্র জ্বলে উঠল আগুনের মতো। বুঝলাম, সর্বনাশ হয়ে গেছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে নিশ্বাস নেওয়ায় বাতাসের স্থলে নরম কাদা ঢুকে গেছে নাকের মধ্যে। গুলি খেয়ে মরার চিন্তা ভুলে গেলাম। উঠে বসে পড়লাম আমি। বুঝলাম, ইতিমধ্যে গুলি থেমে গেছে। জোরে সর্দি ঝাড়ার মতো করে কাদা বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিজের অজান্তেই আবার নিশ্বাস টেনে ফেললাম। নাকের শেষ প্রান্তে এবং মাথায় আবার যেন আগুন জ্বলে উঠল। সৌভাগ্যবশত, তখনই হ্যাচ্চো করে একটা হাঁচি এল। হাঁচির সঙ্গে অনেকটা কাদা বের হয়ে গেল। পরে কলকল করে আরও অনেক!
বন্ধুরা কেউ কাতচিত হয়ে শুয়ে ছিল বলে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। শহীদ লজ্জায় ও ভয়ে আধমরা। পরিকল্পিত অপারেশনটি বাতিল করে দিতে হলো। বন্ধুদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে ফিরে এলাম নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে যাওয়ার সময় অপ্রত্যাশিত মন্তব্যের জন্য শহীদকে এবং যারা অসাবধানতাবশত হেসে উঠেছিল তাদের কাউকে আমি কিছু বলিনি। কিন্তু তারা মর্মে মর্মে অনুভব করেছে, এ ধরনের ভুল ও অসাবধানতার ফলে আমরা সবাই বেঘোরে মারা যেতে পারতাম। এভাবে ভুল করতে করতেই আমরা ভুল শুধরেছি এবং যুদ্ধ করতে করতেই শিখেছি যুদ্ধ করা।
গোলাম মুস্তাফা, মুক্তিযোদ্ধা
একাত্তরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের কোনো এক রাতে আমি পাইওনিয়ার প্লাটুনের টিম নিয়ে শত্রু-এলাকায় যাচ্ছি ওদের দুই বাংকারের চলাচলের মাঝামাঝি স্থানে মাইন লাগানোর পরিকল্পনা নিয়ে। এসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আমাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর জাফর ইমামের নিজ হাতে গড়া পাইওনিয়ার প্লাটুনের ‘বিচ্ছু’দের জন্য এসব ‘কিচ্ছু’ না। সফিক, খোকন, হারুন, বেলাল ও শহীদ আমার সঙ্গী। হাতে আমাদের স্টেনগান। সঙ্গে পরিমাণমতো পি-২ অ্যান্টি পার্সোনাল প্লাস্টিক মাইন। অন্ধকার রাত। জমির আলের ওপর দিয়ে নীরবে ও সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছি। কারও মুখে কথা নেই। এক সারিতে এগোচ্ছি সবাই। সামনে আমি। হঠাৎ পা পিছলে কাত হয়ে বাঁদিকে নরম প্যাঁক-কাদাযুক্ত ধানখেতের মধ্যে পড়ে গেলাম। খানিকের মধ্যেই তড়াক করে আবার উঠে গেলাম। রসিকতা করে ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় নিম্ন স্বরে শহীদ কথা বলে উঠল, প্রমিত ভাষায় যা এ রকম দাঁড়ায়: ‘ডান দিকের তুলনায় তোমার বাঁ দিকের গোঁফ বাড়াবাড়ি রকমের তাড়াতাড়ি বড় এবং ভারী হয়ে গেছে। ফলে শরীরের ব্যালান্স হারানোতেই তুমি বাঁ দিকে কাত হয়ে পড়ে গেছ। কালকেই বাঁ দিকের গোঁফ পরিমাণমতো ছেঁটে শরীরের ওজনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে।’ শুনে দু-তিনজন সহযোদ্ধা একটু শব্দ করে হেসে উঠল।
পাকিস্তানিদের বাংকার থেকে আমরা তখনো বেশ দূরে। কিন্তু তারা মনে হয় হাসির ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যেই গুলি শুরু করে দিল। ক্ষণিকের মধ্যেই আমরা সবাই কাদাযুক্ত ধানখেতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ কাত, কেউবা চিত। আমি আছি উপুড় হয়ে। হঠাৎ মনে হলো বাতাসের বেগ তৈরি করে বেশ কিছু বুলেট আমার মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। গুলি থেকে বাঁচার আশায় আমি নরম মাটির মধ্যে চাপ দিয়ে মাথাটা আরও গভীরে ঢোকাতে থাকলাম। একসময় নাক শক্ত মাটিতে গিয়ে ঠেকে গেল। আর গভীরে যায় না। এদিকে নিশ্বাসের অভাবে বুক ফেটে যাচ্ছে। নাক ও মাথা কাদার মধ্যে। জানি এখানে বাতাস নেই। গুলির ভয়ে মাথাও ওঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু একপর্যায়ে আর পারা গেল না। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি পরাজিত হলো। নিজের অজান্তেই নিশ্বাস নেওয়া শুরু হলো। আহ্ কী শান্তি! যেন শীতল নরম বাতাস নাকের ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে হৃৎপিণ্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার প্রিয় একটি গানের কলি, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’। কিন্তু পরমুহূর্তেই নাসারন্ধ্র জ্বলে উঠল আগুনের মতো। বুঝলাম, সর্বনাশ হয়ে গেছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে নিশ্বাস নেওয়ায় বাতাসের স্থলে নরম কাদা ঢুকে গেছে নাকের মধ্যে। গুলি খেয়ে মরার চিন্তা ভুলে গেলাম। উঠে বসে পড়লাম আমি। বুঝলাম, ইতিমধ্যে গুলি থেমে গেছে। জোরে সর্দি ঝাড়ার মতো করে কাদা বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিজের অজান্তেই আবার নিশ্বাস টেনে ফেললাম। নাকের শেষ প্রান্তে এবং মাথায় আবার যেন আগুন জ্বলে উঠল। সৌভাগ্যবশত, তখনই হ্যাচ্চো করে একটা হাঁচি এল। হাঁচির সঙ্গে অনেকটা কাদা বের হয়ে গেল। পরে কলকল করে আরও অনেক!
বন্ধুরা কেউ কাতচিত হয়ে শুয়ে ছিল বলে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। শহীদ লজ্জায় ও ভয়ে আধমরা। পরিকল্পিত অপারেশনটি বাতিল করে দিতে হলো। বন্ধুদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে ফিরে এলাম নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে যাওয়ার সময় অপ্রত্যাশিত মন্তব্যের জন্য শহীদকে এবং যারা অসাবধানতাবশত হেসে উঠেছিল তাদের কাউকে আমি কিছু বলিনি। কিন্তু তারা মর্মে মর্মে অনুভব করেছে, এ ধরনের ভুল ও অসাবধানতার ফলে আমরা সবাই বেঘোরে মারা যেতে পারতাম। এভাবে ভুল করতে করতেই আমরা ভুল শুধরেছি এবং যুদ্ধ করতে করতেই শিখেছি যুদ্ধ করা।
গোলাম মুস্তাফা, মুক্তিযোদ্ধা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে