জাহীদ রেজা নূর
চলে গেলেন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম। তাঁকে অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতিবিদ কিংবা শিক্ষকদের শিক্ষক বলা হতো। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ছয় দফা আন্দোলন। সেই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা অর্থনৈতিক বিষয়বস্তুর চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করেছিলেন, নুরুল ইসলাম ছিলেন তাঁদের মধ্য অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর প্রথম যে পরিকল্পনা কমিশন হয়েছিল, নুরুল ইসলাম ছিলেন তার ডেপুটি চেয়ারম্যান। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তাই এটাই ছিল কমিশনের সর্বোচ্চ পদ।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা পেশ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় ছয় দফা প্রসারে মূলত ছাত্রলীগ ও ইত্তেফাক পালন করেছিল মুখ্য ভূমিকা। আন্দোলন যতই তীব্র হয়েছে, ততই বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলে পুরোদমে কাজ করেছেন মূলত ১৯৬৯ সাল থেকে। ছয় দফার বিশ্লেষণ, সত্তরের নির্বাচনের ইশতেহার তৈরি, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশমালা তৈরি, পাকিস্তানের সম্ভাব্য সংবিধান তৈরির ব্যাপারে আলোচনা করা ইত্যাদি বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদেরা অবদান রেখেছেন।
আমাদের সৌভাগ্য, অন্য অনেক লেখালেখির মধ্যে নুরুল ইসলাম সে সময়টি এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা রচনা করে গেছেন। বাংলাদেশ নিয়ে নুরুল ইসলামের কার্যক্রম তাতে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য বই আছে। সেগুলোর নাম এখানে বলা যেতে পারে। ‘মেকিং অব আ নেশন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্টস টেল’, ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ: আ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি’, ‘অ্যান ওডেসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ’। এই বইগুলোয় বিস্তারিতভাবে নুরুল ইসলামের ভাবনার নাগাল পাওয়া যাবে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু বের হওয়ার পর থেকেই মূলত অর্থনীতিবিদেরা ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। তৎকালীন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর এম রশিদ একটি বার্তা দিয়ে নুরুল ইসলামকে জানান, যত শিগগির সম্ভব নুরুল ইসলামকে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে নুরুল ইসলামের তৎপরতার কথা বঙ্গবন্ধু জানতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি নুরুল ইসলামকে বললেন, এখন তাঁর পাশে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, স্বাধিকার দাবি ও ছয় দফাকে জোরালো করার ব্যাপারে যাঁরা অবদান রাখতে পারেন।আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার রচনায় অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখার কথাও তিনি বলেন।
ছয় দফা কর্মসূচির মূল বিষয়গুলো সম্প্রসারণের কাজটি যাঁদের হাতে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের একজন ছিলেন নুরুল ইসলাম। ১৯৭০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞদের কাজটি গোপনে শেষ করে ফেলার কথা ছিল। এ সময় ছয় দফা নিয়ে আলোচনায় দেখা গেছে, অনেক ব্যাপারেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ একমত নন। তিনি খুব বেশি প্রশ্ন করতেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে পাকিস্তানের লাহোরের একটি পত্রিকায় ছয় দফার মূল বিষয়গুলো ছাপা হলে সবাই অবাক হন। এগুলো ছিল গোপন বিষয়। এই খসড়ার অনুলিপি সংরক্ষিত থাকত ড. কামাল হোসেনের কাছে। পরিচালনা কমিটির সদস্য রাজনীতিবিদেরা সেটা কিছু সময়ের জন্য ধার নিতে পারতেন। সবচেয়ে ঘন ঘন ধার নিতেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যখন ফাঁস হয় পত্রিকায়, তখন মোশতাকের হাতে এই খসড়ার একটি অনুলিপি ছিল। নুরুল ইসলামসহ অনেকেই এই ফাঁসের ব্যাপারে মোশতাককেই সন্দেহ করেছিলেন।
ছয় দফার পুরোটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অন্য অনেকের মতো নুরুল ইসলামও খুব অখুশি হন। এখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা আগেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ছয় দফার বিষয়ে জেনে যাওয়ায় সংঘবদ্ধভাবে বিরোধিতা করতে পারবে। ড. কামাল হোসেন আর রেহমান সোবহানকে নিয়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে যান, বিষয়টির ভয়াবহতার কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে নিজের রাজনৈতিক জীবনের ঝুঁকি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং আশ্বাস দেন যে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। নুরুল ইসলামকে বললেন পরিকল্পনা কমিশন গঠন করতে। পাকিস্তানের শেষের দিকে যাঁরা অর্থনৈতিক বিষয়ে কাজ করেছিলেন, তাঁদের নিয়েই কমিশনটি করতে বললেন। কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হলেন নুরুল ইসলাম। সঙ্গে থাকলেন রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করা মোশারফ হোসেন।
পরিকল্পনা কমিশনের কাজ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত হলে কমিশনের সদস্যরা একমত হন যে এভাবে কাজে সাফল্য আসবে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কমিশনের সন্তোষজনক সম্পর্ক ছিল না। দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল বলে মনে করতেন কমিশনের লোকেরা, রাজনীতিবিদ আর আমলারা সেগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত পোষণ করতেন না। ফলে কমিশন অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। ফলে বিদায়ের কথা ভাবছিলেন কমিশনের প্রায় সব সদস্যই। বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, এখন উপযুক্ত অর্থনীতিবিদ ও আমলারা মিলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করুক। কমিশনের আর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন পড়লে কমিশনের সদস্যরা অবশ্যই অনানুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শ দেবেন, কমিশনের সদস্য বা সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে নয়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁদের কথা একেবারেই শুনতে চাইলেন না। তিনি মনে করলেন, সবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সংগঠিত হতে শুরু করেছে—এ সময় কমিশন ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছিল দেশে। ১৯৭৪ সালেও একই রকম অবস্থা হওয়ায় খাদ্য মজুত করার প্রবণতা বেড়ে যায়। মজুতের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দরকার ছিল সে সময়। খাদ্যশস্য মজুত না করার আহ্বান জানানো দরকার ছিল। নুরুল ইসলাম ভাবতেন, মজুতদারির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুরই বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়া দরকার। কিন্তু তিনি জানতেন না, সর্বজনের স্বার্থের খাতিরে কিংবা জরিমানা বা হুমকি দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থপরতা বা নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন বিসর্জন করানো বা লাভজনক মজুত করার প্রবণতা রোধ করতে পারে না।
নিজের প্রস্তাব নিয়ে ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে বঙ্গবন্ধু বিমর্ষচিত্তে বলেছিলেন, ‘আপনি বাংলাদেশের মানুষকে চেনেন না। বহু বছর ধরে আমি তাদের সঙ্গে থেকেছি। আমি এদের খুব ভালো করেই চিনি। এরা ক্ষমা করবে না। যদি আপনি একবার ভুল করেন বা ব্যর্থ হন, তাহলে আপনার সারা জীবন তাদের জন্য যা করেছেন, সব বৃথা হয়ে যাবে।’
যাই হোক, আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৭৩ সালের শেষ দিক থেকেই বঙ্গবন্ধু আমলাতন্ত্রের ছলাকলা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশও ঠিকভাবে পালন করছিলেন না আমলারা। এ নিয়ে তিনি ক্রুদ্ধ ছিলেন। নুরুল ইসলাম গিয়েছিলেন কমিশনের কোনো এক কাজে। সিভিল সার্ভিসের সাবেক এক সদস্যকে ডেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্দেশ পালনে দেরি হচ্ছে কেন, তা খুঁজে বের করতে বললেন। তারপর নুরুল ইসলামের দিকে ফিরে বললেন, ‘ছোট লাঠি (ব্যাটন) হাতে শর্ট-প্যান্ট পরা আর ইংরেজি বলা (পাকিস্তানি) সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনদের আদেশ এই আমলারা অবিলম্বে পালন করত। পাঞ্জাবি-পায়জামার মতো সাধারণ পোশাকের রাজনীতিবিদ, যারা বাংলায় কথা বলে আর মাঝে মাঝে পান চিবোয়, তাদের কথায় এরা মনোযোগ দিতে চায় না। সেনাবাহিনীর সেই সব ক্যাপ্টেন আবার ক্ষমতা নিয়ে শাসন করলেই এরা খুশি হবে।’
কথাগুলো যে কতটা অন্তর্ভেদী ছিল, সেটা নুরুল ইসলাম অনুভব করেছেন পরে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি থেকে এক বছরের জন্য নুরুল ইসলামের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন। কিন্তু মার্চের ১৯ তারিখেই বঙ্গবন্ধু চিঠি লিখেছিলেন, নুরুল ইসলাম যেন যত দ্রুত সম্ভব আগের দায়িত্ব বুঝে নেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর আসেনি নুরুল ইসলামের জীবনে। এর আগেই বাংলার ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে যায়।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
চলে গেলেন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম। তাঁকে অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতিবিদ কিংবা শিক্ষকদের শিক্ষক বলা হতো। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ছয় দফা আন্দোলন। সেই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা অর্থনৈতিক বিষয়বস্তুর চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করেছিলেন, নুরুল ইসলাম ছিলেন তাঁদের মধ্য অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর প্রথম যে পরিকল্পনা কমিশন হয়েছিল, নুরুল ইসলাম ছিলেন তার ডেপুটি চেয়ারম্যান। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তাই এটাই ছিল কমিশনের সর্বোচ্চ পদ।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা পেশ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় ছয় দফা প্রসারে মূলত ছাত্রলীগ ও ইত্তেফাক পালন করেছিল মুখ্য ভূমিকা। আন্দোলন যতই তীব্র হয়েছে, ততই বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলে পুরোদমে কাজ করেছেন মূলত ১৯৬৯ সাল থেকে। ছয় দফার বিশ্লেষণ, সত্তরের নির্বাচনের ইশতেহার তৈরি, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশমালা তৈরি, পাকিস্তানের সম্ভাব্য সংবিধান তৈরির ব্যাপারে আলোচনা করা ইত্যাদি বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদেরা অবদান রেখেছেন।
আমাদের সৌভাগ্য, অন্য অনেক লেখালেখির মধ্যে নুরুল ইসলাম সে সময়টি এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা রচনা করে গেছেন। বাংলাদেশ নিয়ে নুরুল ইসলামের কার্যক্রম তাতে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য বই আছে। সেগুলোর নাম এখানে বলা যেতে পারে। ‘মেকিং অব আ নেশন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্টস টেল’, ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ: আ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি’, ‘অ্যান ওডেসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ’। এই বইগুলোয় বিস্তারিতভাবে নুরুল ইসলামের ভাবনার নাগাল পাওয়া যাবে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু বের হওয়ার পর থেকেই মূলত অর্থনীতিবিদেরা ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। তৎকালীন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর এম রশিদ একটি বার্তা দিয়ে নুরুল ইসলামকে জানান, যত শিগগির সম্ভব নুরুল ইসলামকে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে নুরুল ইসলামের তৎপরতার কথা বঙ্গবন্ধু জানতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি নুরুল ইসলামকে বললেন, এখন তাঁর পাশে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, স্বাধিকার দাবি ও ছয় দফাকে জোরালো করার ব্যাপারে যাঁরা অবদান রাখতে পারেন।আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার রচনায় অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখার কথাও তিনি বলেন।
ছয় দফা কর্মসূচির মূল বিষয়গুলো সম্প্রসারণের কাজটি যাঁদের হাতে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের একজন ছিলেন নুরুল ইসলাম। ১৯৭০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞদের কাজটি গোপনে শেষ করে ফেলার কথা ছিল। এ সময় ছয় দফা নিয়ে আলোচনায় দেখা গেছে, অনেক ব্যাপারেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ একমত নন। তিনি খুব বেশি প্রশ্ন করতেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে পাকিস্তানের লাহোরের একটি পত্রিকায় ছয় দফার মূল বিষয়গুলো ছাপা হলে সবাই অবাক হন। এগুলো ছিল গোপন বিষয়। এই খসড়ার অনুলিপি সংরক্ষিত থাকত ড. কামাল হোসেনের কাছে। পরিচালনা কমিটির সদস্য রাজনীতিবিদেরা সেটা কিছু সময়ের জন্য ধার নিতে পারতেন। সবচেয়ে ঘন ঘন ধার নিতেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যখন ফাঁস হয় পত্রিকায়, তখন মোশতাকের হাতে এই খসড়ার একটি অনুলিপি ছিল। নুরুল ইসলামসহ অনেকেই এই ফাঁসের ব্যাপারে মোশতাককেই সন্দেহ করেছিলেন।
ছয় দফার পুরোটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অন্য অনেকের মতো নুরুল ইসলামও খুব অখুশি হন। এখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা আগেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ছয় দফার বিষয়ে জেনে যাওয়ায় সংঘবদ্ধভাবে বিরোধিতা করতে পারবে। ড. কামাল হোসেন আর রেহমান সোবহানকে নিয়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে যান, বিষয়টির ভয়াবহতার কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে নিজের রাজনৈতিক জীবনের ঝুঁকি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং আশ্বাস দেন যে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। নুরুল ইসলামকে বললেন পরিকল্পনা কমিশন গঠন করতে। পাকিস্তানের শেষের দিকে যাঁরা অর্থনৈতিক বিষয়ে কাজ করেছিলেন, তাঁদের নিয়েই কমিশনটি করতে বললেন। কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হলেন নুরুল ইসলাম। সঙ্গে থাকলেন রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করা মোশারফ হোসেন।
পরিকল্পনা কমিশনের কাজ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত হলে কমিশনের সদস্যরা একমত হন যে এভাবে কাজে সাফল্য আসবে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কমিশনের সন্তোষজনক সম্পর্ক ছিল না। দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল বলে মনে করতেন কমিশনের লোকেরা, রাজনীতিবিদ আর আমলারা সেগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত পোষণ করতেন না। ফলে কমিশন অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। ফলে বিদায়ের কথা ভাবছিলেন কমিশনের প্রায় সব সদস্যই। বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, এখন উপযুক্ত অর্থনীতিবিদ ও আমলারা মিলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করুক। কমিশনের আর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন পড়লে কমিশনের সদস্যরা অবশ্যই অনানুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শ দেবেন, কমিশনের সদস্য বা সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে নয়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁদের কথা একেবারেই শুনতে চাইলেন না। তিনি মনে করলেন, সবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সংগঠিত হতে শুরু করেছে—এ সময় কমিশন ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছিল দেশে। ১৯৭৪ সালেও একই রকম অবস্থা হওয়ায় খাদ্য মজুত করার প্রবণতা বেড়ে যায়। মজুতের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দরকার ছিল সে সময়। খাদ্যশস্য মজুত না করার আহ্বান জানানো দরকার ছিল। নুরুল ইসলাম ভাবতেন, মজুতদারির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুরই বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়া দরকার। কিন্তু তিনি জানতেন না, সর্বজনের স্বার্থের খাতিরে কিংবা জরিমানা বা হুমকি দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থপরতা বা নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন বিসর্জন করানো বা লাভজনক মজুত করার প্রবণতা রোধ করতে পারে না।
নিজের প্রস্তাব নিয়ে ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে বঙ্গবন্ধু বিমর্ষচিত্তে বলেছিলেন, ‘আপনি বাংলাদেশের মানুষকে চেনেন না। বহু বছর ধরে আমি তাদের সঙ্গে থেকেছি। আমি এদের খুব ভালো করেই চিনি। এরা ক্ষমা করবে না। যদি আপনি একবার ভুল করেন বা ব্যর্থ হন, তাহলে আপনার সারা জীবন তাদের জন্য যা করেছেন, সব বৃথা হয়ে যাবে।’
যাই হোক, আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৭৩ সালের শেষ দিক থেকেই বঙ্গবন্ধু আমলাতন্ত্রের ছলাকলা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশও ঠিকভাবে পালন করছিলেন না আমলারা। এ নিয়ে তিনি ক্রুদ্ধ ছিলেন। নুরুল ইসলাম গিয়েছিলেন কমিশনের কোনো এক কাজে। সিভিল সার্ভিসের সাবেক এক সদস্যকে ডেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্দেশ পালনে দেরি হচ্ছে কেন, তা খুঁজে বের করতে বললেন। তারপর নুরুল ইসলামের দিকে ফিরে বললেন, ‘ছোট লাঠি (ব্যাটন) হাতে শর্ট-প্যান্ট পরা আর ইংরেজি বলা (পাকিস্তানি) সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনদের আদেশ এই আমলারা অবিলম্বে পালন করত। পাঞ্জাবি-পায়জামার মতো সাধারণ পোশাকের রাজনীতিবিদ, যারা বাংলায় কথা বলে আর মাঝে মাঝে পান চিবোয়, তাদের কথায় এরা মনোযোগ দিতে চায় না। সেনাবাহিনীর সেই সব ক্যাপ্টেন আবার ক্ষমতা নিয়ে শাসন করলেই এরা খুশি হবে।’
কথাগুলো যে কতটা অন্তর্ভেদী ছিল, সেটা নুরুল ইসলাম অনুভব করেছেন পরে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি থেকে এক বছরের জন্য নুরুল ইসলামের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন। কিন্তু মার্চের ১৯ তারিখেই বঙ্গবন্ধু চিঠি লিখেছিলেন, নুরুল ইসলাম যেন যত দ্রুত সম্ভব আগের দায়িত্ব বুঝে নেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর আসেনি নুরুল ইসলামের জীবনে। এর আগেই বাংলার ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে যায়।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে