পলিথিনের দূষণ মারাত্মক ক্ষতিকর

আলম শাইন
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮: ০৮

দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ নানা কাজে পলিথিন ব্যবহার করে থাকে। এই ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা শুধু শপিংয়ে নয়, প্রাত্যহিক কাজে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধান কাজটি হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ফ্রিজে রাখা। অথচ আমাদের অনেকেরই জানা নেই, পলিথিন মুড়িয়ে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করলে একধরনের অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ে তা। পরে সেই খাদ্যদ্রব্য বের করে আনলে ‘স্টাইরিন’ নামের গ্যাস উৎপাদিত হয়ে নিশ্বাস ও লোমকূপের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে মাথাব্যথা, দুর্বলতা, জটিল ও কঠিন রোগব্যাধির সৃষ্টি হয়; এমনকি স্নায়ুতন্ত্র বিকলের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

অন্যদিকে প্লাস্টিকের পানির বোতল ও ট্যাপ ব্যবহারের প্রবণতার কারণে মানুষের প্রজননক্ষমতা হ্রাস, অ্যালার্জি, হাঁপানি, চর্মরোগ, থাইরয়েডের অতিরিক্ত হরমোন ধারণ এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়। অনেকে আবার খাবারকে নিরাপদে ঢেকে রাখতে রঙিন পলিথিন ব্যবহার করেন, যা আরও মারাত্মক। পলিথিনের রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে রঙের রাসায়নিক উপাদান মিশে খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টির কারণে পরে জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হয়।

পলিথিন ব্যবহারে শুধু খাদ্যে বিষক্রিয়াই ঘটে না, ঘটে ড্রেনেজব্যবস্থারও বিপত্তি। কারণ পলিথিন শত শত বছর ধরে সক্রিয় থাকতে সক্ষম। এটি মাটির নিচে অথবা পানিতে দ্রবীভূত হয় না। পলিথিন উৎপাদনে যে পলিমার ব্যবহার করা হয়, তা খুবই শক্তিশালী এবং যেকোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া এর ভেতরে প্রবেশ করে নষ্ট করতে পারে না বলেই শত বছরেও অক্ষয় থেকে যায়।

এ কারণে মাটির উর্বরাশক্তি হ্রাস পায় এবং স্যুয়ারেজ বা ড্রেনে আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। এ ধরনের জলাবদ্ধতায় ড্রেনেজব্যবস্থা তো ভেঙে পড়েই, তার ওপর ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু মশার উপদ্রবও বাড়ে। এ ছাড়া পলিথিনের মিশ্রণের কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নদ-নদী এবং সমুদ্রে পলিথিনের বর্জ্য নিক্ষেপণের ফলে জলজ প্রাণীদের জীবনহানি ঘটছে ব্যাপকভাবে। খাদ্য ভেবে জলজ প্রাণীরা পলিথিনের বর্জ্য খেয়ে হজম করতে না পেরে পরিশেষে প্রাণ হারায়। এভাবে অনেক তিমি, কাছিমসহ অসংখ্য জলজ প্রাণী প্রাণ হারিয়েছে। সত্য কথাটি হচ্ছে, সমুদ্রে পলিথিনের বর্জ্যের ভাগাড় বানানোর জন্য বাংলাদেশ মোটেও দায়ী নয়।

মূলত বঙ্গোপসাগরে বিদেশি জাহাজ কর্তৃক বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে সমুদ্র বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বেশ কিছু জাহাজ গোপনে বর্জ্য খালাস করেছে, সেই সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। ১৯৯৮ সালের আলোচিত বিষয় ছিল, পারমাণবিক বর্জ্যভর্তি বিদেশি একটি জাহাজ সাগর-মহাসাগরে বর্জ্য নিক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গোপনে নিক্ষেপ করে চলে যায়। এভাবে আন্তর্জাতিক চক্র প্রতিনিয়তই পলিথিনের বর্জ্য সাগরে নিক্ষেপ করে যাচ্ছে।

সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি মিনিটে সাগরের জলে ৩৫ হাজার প্লাস্টিক পণ্য যেকোনোভাবে পড়ছে; যার সংখ্যা বছরে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ মিলিয়ন। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে কার্বন নিঃসরণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পোড়ানো হচ্ছে, তাতে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়ে জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

২০২০ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক চক্র। ওই বর্জ্যের ভাগাড়ে ছেঁড়া জাল থাকায় তাতে পেঁচিয়ে অনেক মাছ, কাছিম, ডলফিন প্রাণ হারিয়েছিল। ফলে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্যহানিসহ মারাত্মকভাবে পরিবেশদূষণ হয়েছিল। সেই বর্জ্যের অধিকাংশই ছিল পলিথিনের বিস্তৃতি।
উল্লেখ্য, সাগরে নিক্ষিপ্ত পলিথিন বর্জ্যের কারণে সূর্যরশ্মির বিকিরণে মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়ে জলজ প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে। এতে প্রায় ৮৫০ প্রজাতির জলজ প্রাণী রোগে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া বছরে ১০-১২ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে।

সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, ২০২২ সালের মার্চ মাসে বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় জানা যায়, মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি রয়েছে; যা মানুষের রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্থান করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। গবেষকেরা আরও জানিয়েছেন, অর্ধেক নমুনায় পিইটি প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যে উপাদানটি পানীয় বোতলে ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য পণ্যের প্যাকেজে ব্যবহৃত পলিস্টাইরিন মিলছে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের রক্তে। অন্যদিকে এক-চতুর্থাংশ রক্তের নমুনায় পলিথিন শনাক্ত হয়েছে, যা থেকে সরাসরি বিভিন্ন ধরনের পলিব্যাগ তৈরি করা সম্ভব।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বেশি। কারণ শিশুদের প্লাস্টিকের বোতলে সংরক্ষিত খাবার খাওয়ানো হয় বেশি, ফলে তাদের দেহে প্রতিদিন লাখ লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করছে। এতে করে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে মানবদেহের, তা এখনো গবেষণায় উঠে আসেনি। তবে অনুমান করা যায়, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতির কারণে মারাত্মক ধরনের রোগব্যাধির মুখোমুখি হতে হবে মানুষকে।

পলিথিনের মারাত্মক দূষণের বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নত দেশগুলো পচনশীল পলিথিন তৈরি করছে। তারা পচনশীল পলিথিন বা প্লাস্টিক তৈরিতে ভুট্টা বা চালের স্টার্চ মিশিয়ে দিচ্ছে। এতে পলিথিন মাটিচাপা পড়লে খুব দ্রুত ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ে অণুগঠন হারিয়ে ফেলে।

এর সঙ্গে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা নিঃশেষ হয়ে যায়। অবশ্য দ্রুত বিনষ্ট হওয়াটা নির্ভর করে মিশ্রিত স্টার্চের পরিমাণ এবং মাটির গঠন ও তাপ আর্দ্রতার পরিমাণের ওপর। আমাদের দেশে যেহেতু ওই প্রযুক্তির ব্যবহার নেই, সেহেতু পলিথিন ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা উচিত। হাতল ছাড়া শপিং ব্যাগও যেন বাজারে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।

বিষয়টি কঠিনই বটে। কাজটি শুধু আইন প্রয়োগ করেই সমাধান করা যাবে না। এটি সমূলে নির্মূল করতে হলে আগে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। ক্ষতির দিকটা যত বেশি জানাজানি হবে, ততই মানুষ সচেতন হয়ে উঠবে। একসময় নিজ থেকেই পলিথিন বর্জনে উদ্বুদ্ধ হবে। ব্যাপক প্রচারের ফলে যেমন আর্সেনিকযুক্ত পানি পরিহার করতে শিখেছে মানুষ, এ ক্ষেত্রেও সফলতা আসবে নিশ্চয়ই।

আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত