মোনায়েম সরকার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও শেষ হয়েছে। এখন নতুন মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালন শুরুর অপেক্ষা। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করেছে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ। এর ফলে টানা চতুর্থবারের মতো সংসদ নেতা নির্বাচিত হলেন তিনি।
বুধবার নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সংসদ উপনেতাও নির্বাচন করা হয়। একাদশ সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরীকেই দ্বাদশ সংসদের উপনেতা নির্বাচন করেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সদস্যরা।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে নতুন সংসদেও স্পিকারের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করবে আওয়ামী লীগ। আগের মতো শামসুল হক টুকুই ডেপুটি স্পিকার হিসেবে থাকবেন। আর একাদশ সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী দ্বাদশেও একই দায়িত্ব সামলাবেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পঞ্চমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন শেখ হাসিনা। মন্ত্রী হিসেবে ২৫ জন ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ১১ জন শপথ নিয়েছেন। পুরোনোদের মধ্যে ৩০ জন মন্ত্রী বাদ পড়েছেন। এবারই প্রথম মন্ত্রী হয়েছেন সাতজন। সাতজন প্রতিমন্ত্রীও নতুন। আগে মন্ত্রী ছিলেন এমন পাঁচজন এবার মন্ত্রিসভায় ফিরেছেন। পদোন্নতি পেয়েছেন তিনজন। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে নতুন বছরে নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে মানুষের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে। বিগত মন্ত্রিসভার বিতর্ক, ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অনুপস্থিতি, অতিকথনের দোষমুক্ত হয়ে নতুন মন্ত্রিসভা নতুন উদ্যমে সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবিলায় সক্ষম হবে—এই আশা আমরা করতেই পারি।
কেউ কেউ বলে থাকেন, কে মন্ত্রী হলো বা কে বাদ পড়ল, সেটা বড় কথা নয়। কারণ সবকিছু আসলে পরিচালিত হয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশ ও পরামর্শে। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছু হয় না বলেই প্রচার ও বিশ্বাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শেখ হাসিনা অবশ্যই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। কিন্তু তিনি অন্যদের ভালো পরামর্শ শোনেন না, সেটা মোটেও ঠিক নয়। সমস্যা বরং অন্যখানে, আমাদের অনেকের মধ্যেই তোয়াজ-তোষামদের প্রবণতা প্রবল। শেখ হাসিনা কোনো বিষয় নিয়ে যেভাবে ভাবেন, কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে তাঁর যে পদ্ধতি, সেটা সব সময় শতভাগ সঠিক না-ও হতে পারে। কিন্তু এ কথা যদি তাঁকে বলা না হয়, তাহলে তিনি পুনর্বিবেচনা করবেন কীভাবে? আমি মনে করি, মন্ত্রিসভার বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে খোলামেলা আলোচনার ব্যবস্থা অবারিত হওয়া উচিত।
এবার মন্ত্রিসভায় সৎ, রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব, নানা বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয় ঘটেছে। এই মন্ত্রিসভা শেখ হাসিনার স্বপ্নযাত্রার যোগ্য সহযোগী হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করছেন। আমাদের দেশের রাজনীতি যে সুস্থ ধারায় অগ্রসর হচ্ছে না, সেটা সবারই জানা। দেশের একটি বড় জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের যে রাজনীতি করছে, তা থেকে বেরিয়ে না এলে সংকট সমাধান সহজে হবে না।
এক বছর ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র-জুনিয়র নেতারা বলে আসছেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না’—অথচ ৭ জানুয়ারি যথারীতি নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচন ঠেকানো দূরের কথা, সরকারকে বড় ধরনের কোনো চাপে ফেলতে পারেনি বিএনপি ও তার মিত্ররা। ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই দ্বাদশ নির্বাচন সমাপ্ত করেছে। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে চরমভাবে হেরেছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থেকে ভুল করেছে দলটি। দেশে আর কখনো নির্দলীয় সরকার ফিরে আসবে না। আবার নাশকতায় জড়িয়ে হোঁচট খেয়েছে বিএনপির আন্দোলনও। তবে দলটির নেতারা তা মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, ‘একতরফা ভোট’ বর্জনে বিএনপির ডাক সফল হয়েছে। সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপি সঠিক পথেই আছে। পাঁচ বছরের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সম্ভাবনা যারা দেখে, তারা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনার ‘ডিজাইন’ ছাড়া বাংলাদেশে এখন কিছুই হয় না।
সরকার পতনের আন্দোলন সফল হলো না, আবার নির্বাচনও ঠেকাতে পারল না বিএনপি। তাহলে দলটি কী পেল? দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির কিছু লাভ হয়নি; হতাশায় ডুবেছেন দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। আগামী পাঁচ বছর এর জের টানতে হবে দলটিকে। বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে দল ও রাজনীতি ছাড়তে পারেন কেউ কেউ। রাজনীতির মাঠে নিজেদের পোক্ত অবস্থানে ধরে রাখতে না পারলে ভোটারদের স্মৃতি থেকেও দলটি হারিয়ে যেতে পারে; নতুন প্রজন্ম থেকেও দলটির দূরে সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এরা ১৭ বছর ধরেই বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেনি।
সে জন্য কেউ কেউ এমনও বলছেন, বিএনপির এবারের নির্বাচনী কৌশল অনেকটা খেলার আগেই হার স্বীকারের মতো। বিএনপির আন্দোলন ছিল ভুল লক্ষ্যের। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকারের পতন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সমাধান নয়, তা এই ভোটেই প্রমাণিত হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই নেতৃত্বের সংকট নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে দলের ভেতরে ও বাইরে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বও। দলের কূটনৈতিক বৈঠকে তারা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কাছে বহুবার জানতে চেয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? নির্বাচনের আগেও একাধিক বৈঠকে কূটনৈতিক নেতারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বলে শোনা যায়।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ কনস্টেবল হত্যা, পিস্তল ছিনতাই, পুলিশের কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, নাশকতা, ভাঙচুর, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, গাড়ি পোড়ানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিরুদ্ধে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী এখনো কারাগারে।
এমন পরিস্থিতিতেও লন্ডনে বসে সরকার পতনের লক্ষ্যে একের পর এক কঠোর কর্মসূচির নির্দেশনা দিয়ে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অথচ এসব কর্মসূচি পালন না করে গ্রেপ্তার এড়াতে দলের প্রথম সারির অনেক নেতা আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় প্রথম সারির নেতারা জেলে থাকলে দ্বিতীয় সারির নেতারা দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেবেন—এমন দলীয় সিদ্ধান্ত থাকলেও মাঠের কর্মসূচিতে কোনো উল্লেখযোগ্য নেতাকে দেখা যায়নি। সরকার পতনের আন্দোলনে কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে তারেক রহমানের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয়েছে দলের নেতা-কর্মীদের। টানা নিষ্ফল হরতাল-অবরোধ ডেকে বিএনপি কেবল সাধারণ মানুষকে দুর্দশার মধ্যে ফেলেনি; একটানা কঠোর কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা হাঁপিয়ে উঠেছেন; হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি ডেকে ঢাকা মহানগরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকলেও ঢাকার বাইরের নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। মামলা ও গ্রেপ্তারের আতঙ্ক পাশ কাটিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে তাঁরা দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন। তৃণমূল থেকে বারবার কর্মসূচি পরিবর্তনের দাবি উঠলেও তারেক রহমান এতে কর্ণপাত করেননি। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিনিয়র নেতারাও কর্মসূচি পরিবর্তনের ব্যাপারে বহুবার নিজেদের মত দিয়েছেন; কিন্তু তারেক রহমান তা আমলে নেননি। ফলে বর্তমান অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মিত জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আন্দোলন সমন্বয়ের চেষ্টা করেও খুব একটা সাড়া পাচ্ছেন না বলে শোনা যাচ্ছে।
বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছেন ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার কৌশল যে সঠিক ছিল না, এই নির্বাচনী ফলাফলে তা প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কারও কারও কাছে প্রত্যাশিত মনে হলেও আমি মনে করি, কিছু হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। পরাজিতদের মধ্যে দুই-তিনবারের সংসদ সদস্য, কেউ কেউ সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, দলের কেন্দ্রীয় নেতা, আবার কেউ রাজনৈতিক দলের প্রধান। তাঁদের পরাজয়ের প্রধান কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। নিজেকে মনে করতেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দলের তৃণমূল এমনকি জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীদেরও তোয়াক্কা করতেন না তাঁরা। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেননি। নির্বাচনী এলাকায় জোটের শরিক দলের নেতা-কর্মীদের থেকেও ছিলেন বিচ্ছিন্ন। শরিকেরাও সংগঠনকে শক্ত কাঠামোয় দাঁড় করায়নি। সব সময় নজর ছিল কেন্দ্রের দিকে। দলীয় হাইকমান্ডের সন্তুষ্টির দিকে। ভেবেছিলেন, দলীয় প্রতীক পেলেই তাঁরা বিজয়ী হবেন। কিন্তু এবার ব্যতিক্রমী কৌশলের অনন্য নির্বাচনে হেরেছেন তাঁরা। কেউ তিন যুগের, কেউ দেড়-দুই যুগের সাম্রাজ্য হারিয়েছেন। এ ধরনের দেড় ডজনেরও বেশি হেভিওয়েট রাজনীতিকের বিস্ময়কর পরাজয় ও সাম্রাজ্য হারানোর নেপথ্যের কারণ চিহ্নিত করা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যই প্রয়োজন।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক; চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও শেষ হয়েছে। এখন নতুন মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালন শুরুর অপেক্ষা। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করেছে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ। এর ফলে টানা চতুর্থবারের মতো সংসদ নেতা নির্বাচিত হলেন তিনি।
বুধবার নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সংসদ উপনেতাও নির্বাচন করা হয়। একাদশ সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরীকেই দ্বাদশ সংসদের উপনেতা নির্বাচন করেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সদস্যরা।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে নতুন সংসদেও স্পিকারের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করবে আওয়ামী লীগ। আগের মতো শামসুল হক টুকুই ডেপুটি স্পিকার হিসেবে থাকবেন। আর একাদশ সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী দ্বাদশেও একই দায়িত্ব সামলাবেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পঞ্চমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন শেখ হাসিনা। মন্ত্রী হিসেবে ২৫ জন ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ১১ জন শপথ নিয়েছেন। পুরোনোদের মধ্যে ৩০ জন মন্ত্রী বাদ পড়েছেন। এবারই প্রথম মন্ত্রী হয়েছেন সাতজন। সাতজন প্রতিমন্ত্রীও নতুন। আগে মন্ত্রী ছিলেন এমন পাঁচজন এবার মন্ত্রিসভায় ফিরেছেন। পদোন্নতি পেয়েছেন তিনজন। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে নতুন বছরে নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে মানুষের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে। বিগত মন্ত্রিসভার বিতর্ক, ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অনুপস্থিতি, অতিকথনের দোষমুক্ত হয়ে নতুন মন্ত্রিসভা নতুন উদ্যমে সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবিলায় সক্ষম হবে—এই আশা আমরা করতেই পারি।
কেউ কেউ বলে থাকেন, কে মন্ত্রী হলো বা কে বাদ পড়ল, সেটা বড় কথা নয়। কারণ সবকিছু আসলে পরিচালিত হয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশ ও পরামর্শে। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছু হয় না বলেই প্রচার ও বিশ্বাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শেখ হাসিনা অবশ্যই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। কিন্তু তিনি অন্যদের ভালো পরামর্শ শোনেন না, সেটা মোটেও ঠিক নয়। সমস্যা বরং অন্যখানে, আমাদের অনেকের মধ্যেই তোয়াজ-তোষামদের প্রবণতা প্রবল। শেখ হাসিনা কোনো বিষয় নিয়ে যেভাবে ভাবেন, কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে তাঁর যে পদ্ধতি, সেটা সব সময় শতভাগ সঠিক না-ও হতে পারে। কিন্তু এ কথা যদি তাঁকে বলা না হয়, তাহলে তিনি পুনর্বিবেচনা করবেন কীভাবে? আমি মনে করি, মন্ত্রিসভার বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে খোলামেলা আলোচনার ব্যবস্থা অবারিত হওয়া উচিত।
এবার মন্ত্রিসভায় সৎ, রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব, নানা বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয় ঘটেছে। এই মন্ত্রিসভা শেখ হাসিনার স্বপ্নযাত্রার যোগ্য সহযোগী হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করছেন। আমাদের দেশের রাজনীতি যে সুস্থ ধারায় অগ্রসর হচ্ছে না, সেটা সবারই জানা। দেশের একটি বড় জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের যে রাজনীতি করছে, তা থেকে বেরিয়ে না এলে সংকট সমাধান সহজে হবে না।
এক বছর ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র-জুনিয়র নেতারা বলে আসছেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না’—অথচ ৭ জানুয়ারি যথারীতি নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচন ঠেকানো দূরের কথা, সরকারকে বড় ধরনের কোনো চাপে ফেলতে পারেনি বিএনপি ও তার মিত্ররা। ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই দ্বাদশ নির্বাচন সমাপ্ত করেছে। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে চরমভাবে হেরেছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থেকে ভুল করেছে দলটি। দেশে আর কখনো নির্দলীয় সরকার ফিরে আসবে না। আবার নাশকতায় জড়িয়ে হোঁচট খেয়েছে বিএনপির আন্দোলনও। তবে দলটির নেতারা তা মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, ‘একতরফা ভোট’ বর্জনে বিএনপির ডাক সফল হয়েছে। সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপি সঠিক পথেই আছে। পাঁচ বছরের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সম্ভাবনা যারা দেখে, তারা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনার ‘ডিজাইন’ ছাড়া বাংলাদেশে এখন কিছুই হয় না।
সরকার পতনের আন্দোলন সফল হলো না, আবার নির্বাচনও ঠেকাতে পারল না বিএনপি। তাহলে দলটি কী পেল? দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির কিছু লাভ হয়নি; হতাশায় ডুবেছেন দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। আগামী পাঁচ বছর এর জের টানতে হবে দলটিকে। বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে দল ও রাজনীতি ছাড়তে পারেন কেউ কেউ। রাজনীতির মাঠে নিজেদের পোক্ত অবস্থানে ধরে রাখতে না পারলে ভোটারদের স্মৃতি থেকেও দলটি হারিয়ে যেতে পারে; নতুন প্রজন্ম থেকেও দলটির দূরে সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এরা ১৭ বছর ধরেই বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেনি।
সে জন্য কেউ কেউ এমনও বলছেন, বিএনপির এবারের নির্বাচনী কৌশল অনেকটা খেলার আগেই হার স্বীকারের মতো। বিএনপির আন্দোলন ছিল ভুল লক্ষ্যের। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকারের পতন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সমাধান নয়, তা এই ভোটেই প্রমাণিত হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই নেতৃত্বের সংকট নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে দলের ভেতরে ও বাইরে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বও। দলের কূটনৈতিক বৈঠকে তারা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কাছে বহুবার জানতে চেয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? নির্বাচনের আগেও একাধিক বৈঠকে কূটনৈতিক নেতারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বলে শোনা যায়।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ কনস্টেবল হত্যা, পিস্তল ছিনতাই, পুলিশের কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, নাশকতা, ভাঙচুর, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, গাড়ি পোড়ানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিরুদ্ধে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী এখনো কারাগারে।
এমন পরিস্থিতিতেও লন্ডনে বসে সরকার পতনের লক্ষ্যে একের পর এক কঠোর কর্মসূচির নির্দেশনা দিয়ে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অথচ এসব কর্মসূচি পালন না করে গ্রেপ্তার এড়াতে দলের প্রথম সারির অনেক নেতা আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় প্রথম সারির নেতারা জেলে থাকলে দ্বিতীয় সারির নেতারা দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেবেন—এমন দলীয় সিদ্ধান্ত থাকলেও মাঠের কর্মসূচিতে কোনো উল্লেখযোগ্য নেতাকে দেখা যায়নি। সরকার পতনের আন্দোলনে কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে তারেক রহমানের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয়েছে দলের নেতা-কর্মীদের। টানা নিষ্ফল হরতাল-অবরোধ ডেকে বিএনপি কেবল সাধারণ মানুষকে দুর্দশার মধ্যে ফেলেনি; একটানা কঠোর কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা হাঁপিয়ে উঠেছেন; হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি ডেকে ঢাকা মহানগরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকলেও ঢাকার বাইরের নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। মামলা ও গ্রেপ্তারের আতঙ্ক পাশ কাটিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে তাঁরা দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন। তৃণমূল থেকে বারবার কর্মসূচি পরিবর্তনের দাবি উঠলেও তারেক রহমান এতে কর্ণপাত করেননি। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিনিয়র নেতারাও কর্মসূচি পরিবর্তনের ব্যাপারে বহুবার নিজেদের মত দিয়েছেন; কিন্তু তারেক রহমান তা আমলে নেননি। ফলে বর্তমান অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মিত জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আন্দোলন সমন্বয়ের চেষ্টা করেও খুব একটা সাড়া পাচ্ছেন না বলে শোনা যাচ্ছে।
বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছেন ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার কৌশল যে সঠিক ছিল না, এই নির্বাচনী ফলাফলে তা প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কারও কারও কাছে প্রত্যাশিত মনে হলেও আমি মনে করি, কিছু হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। পরাজিতদের মধ্যে দুই-তিনবারের সংসদ সদস্য, কেউ কেউ সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, দলের কেন্দ্রীয় নেতা, আবার কেউ রাজনৈতিক দলের প্রধান। তাঁদের পরাজয়ের প্রধান কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। নিজেকে মনে করতেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দলের তৃণমূল এমনকি জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীদেরও তোয়াক্কা করতেন না তাঁরা। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেননি। নির্বাচনী এলাকায় জোটের শরিক দলের নেতা-কর্মীদের থেকেও ছিলেন বিচ্ছিন্ন। শরিকেরাও সংগঠনকে শক্ত কাঠামোয় দাঁড় করায়নি। সব সময় নজর ছিল কেন্দ্রের দিকে। দলীয় হাইকমান্ডের সন্তুষ্টির দিকে। ভেবেছিলেন, দলীয় প্রতীক পেলেই তাঁরা বিজয়ী হবেন। কিন্তু এবার ব্যতিক্রমী কৌশলের অনন্য নির্বাচনে হেরেছেন তাঁরা। কেউ তিন যুগের, কেউ দেড়-দুই যুগের সাম্রাজ্য হারিয়েছেন। এ ধরনের দেড় ডজনেরও বেশি হেভিওয়েট রাজনীতিকের বিস্ময়কর পরাজয় ও সাম্রাজ্য হারানোর নেপথ্যের কারণ চিহ্নিত করা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যই প্রয়োজন।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক; চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২১ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে