জাহীদ রেজা নূর
মার্চ মাস মানেই আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের বাঁকবদলের মাস। এ মাসটি এলেই নতুন করে ভাবতে হয় ইয়াহিয়া-ভুট্টোর নৃশংসতার কথা। এ মাসেই, অর্থাৎ ৭ মার্চ এক অনন্য ভাষণে ঋদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্ব। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এ মাসেই যে বজ্রকণ্ঠ ভাষণ দিলেন, তা বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি হয়ে উঠল। এ মাসেই ইয়াহিয়া এলেন ঢাকায়, ভুট্টো এলেন ঢাকায় এবং বৈঠকের ছলে বাঙালিদের হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের প্রাণের অংশ হয়ে উঠেছিলেন তত দিনে।
কিন্তু সেই শেখ মুজিবুর রহমানের নামে যে কুৎসা রটনা হয়েছে, তা ধরে ধরে উত্তর হয়তো দেওয়া যায়, কিন্তু তার আগে যেটা করা দরকার তা হলো, এই রটনাকারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন।
অনেকেই হয়তো লক্ষ করেছেন, ইদানীং কেউ কেউ ধূর্ততার সঙ্গে এমন কিছু কথা বলছেন, যার উদ্দেশ্য প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করা। আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে অন্তত দুজন বাঙালিকে বেছে নেওয়া হয়। তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ও শেখ মুজিবুর রহমান।
এই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেউ লড়াই করছে না। তবে যে দুজনের নাম বলা হলো, তাঁদের বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যা বয়ান তৈরি করলে একসময় মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে—এ রকম গোয়েবলসীয় ভাবনা দিয়েই হয়তো তাড়িত হচ্ছেন এই কালিমা রটনাকারী লোকেরা।
এমন যদি হতো, এটা শুধু পাতিনেতা ধরনের লোকদের হিংসা আর কুচুটেপনা থেকে উত্থিত, তাহলে তা অগ্রাহ্য করা যেত। কিন্তু যাঁরা বলছেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকেরাও রয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ যখন অন্যকে ছোট করার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামেন, তখন দেখা যায়, সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিলিয়ে-মিশিয়ে এমন এক বয়ান তাঁরা তৈরি করেছেন, যা শুনে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন শ্রোতা। বলা কথার মধ্যে কিছু সত্য থাকায় এই দ্বন্দ্ব শ্রোতার মনে প্রগাঢ় হয় এবং একসময় তা বিশ্বাস করতে শুরু করে দেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ রকম বেশ কিছু কুৎসা রচনা করা হয়েছে। কুৎসা রচনা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও।
২.
এর বিপরীতে আছে আরেকটি শক্তি, যাঁরা তাঁদের ধ্যান-জ্ঞানের সবটাই উৎসর্গ করে দেন রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে। বলে রাখা ভালো, রক্ত-মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথ বা শেখ মুজিবকে যখন এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁরা কোনোভাবেই কোনো ভুল করতে পারেন না, তাঁদের কোনো সিদ্ধান্তই ভুল হতে পারে না, তখন সংকটের সৃষ্টি হয়। যেহেতু সেই বর্ণনায় সত্যের সঙ্গে ভক্তি মিশে যায়, সেহেতু তাতে অতিকথন দৃশ্যমান হয়। তারই ফায়দা নেয় কুৎসাকারীরা। কারণ, মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ করলে তাতে মানুষটি বিতর্কিত হয়ে পড়েন, এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সর্বত্রই। অথচ কোনো রকম অতিকথন ছাড়াই যে তাঁদের জীবন বিস্ময়করভাবে মহৎ, সে কথা বুঝতে পারেন না এই ভক্তরা।
আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য হয়েছিল, তা আমি জানি না, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ১০ বছর আমি ছিলাম, সে সময়টির প্রথম পাঁচ বছর আমি সোভিয়েত শাসন দেখেছি, পরের পাঁচ বছর দেখেছি গণতান্ত্রিক রাশিয়ার জীবন। বলা বাহুল্য, সমাজতান্ত্রিক দেশটিতে ব্যক্তি-বন্দনা সেই ব্যক্তির ইমেজকে একেবারেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমি লেনিনের কথাই বলছি। লেনিন নিজে কখনো চাননি, তাঁকে দেবতা বানানো হোক। কিন্তু লেনিনের ওপর দেবত্ব চাপিয়ে দিয়ে বাহ্যিকভাবে হয়তো লাভবান হয়েছে সোভিয়েত সরকার, কিন্তু সাধারণ মানুষের অন্তরে লেনিনকে সেভাবে আর পাওয়া যায়নি। এ জন্য লেনিন নিজে দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিল কমিউনিস্ট পার্টি এবং সেই পার্টির নেতৃত্ব।
৩.
রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারী হিসেবে যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে কেউ কেউ উপস্থাপন করেছেন, তা শুধু একদেশদর্শীই নয়, একেবারে ডাহা মিথ্যা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রচুর কাজ করা একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক অকারণেই একসময় রবীন্দ্রনাথের নামে কালিমা লেপন করার চেষ্টা করেছিলেন। বামপন্থী সেই অধ্যাপকের তথ্য-উপাত্তগুলো একেবারেই ভ্রান্ত ছিল, কিন্তু সে সময় অনেকে তা বিশ্বাস করেছিল স্রেফ এই কারণে যে, এই অধ্যাপক বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাস নিয়ে ঈর্ষণীয় কাজ করেছেন। কিন্তু কী কারণে তাঁর মনে রবীন্দ্রবিদ্বেষ জায়গা করে নিয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও খুঁজে পাই না। তাঁরই অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছেন আরেক জনপ্রিয় অধ্যাপক। তিনি সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান করে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথের সাফাই গাওয়ার জন্য এই লেখা নয়। এই লেখা হলো অকারণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো মানুষদের ব্যাপারে পাঠককে সতর্ক করে দেওয়া।
৪.
হাতে এসেছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একটি বই। এই অর্থনীতিবিদ আমাদের ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত, সেটা বোধ হয় ইতিহাসে উৎসাহী প্রতিটি মানুষেরই জানা। তিনি সদ্যোজাত বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ যখন সংকটকাল অতিক্রম করছে, সে সময়টি তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে থেকে দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়েই অল্প কয়েকটি কথা বলা যাক।
অনেকেই বলে থাকেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো শেখ মুজিব একা নিতেন; অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। শেখ মুজিব কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের চেয়ে সচিবদের সরাসরি নির্দেশনা দিতেন। তাতে মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর দিয়ে দিতেন। কিন্তু এ ব্যাপারটা সিনিয়র মন্ত্রীদের সঙ্গেও ঘটত, এটা সত্য নয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাকদের মতো সিনিয়রদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নিতেন শেখ মুজিব। আইন ও পররাষ্ট্র-সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্ভর করতেন ড. কামাল হোসেনের ওপর। গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে তিনি আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। এ ঘটনার আলোকেই বাকশাল গঠন করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে এবং তখন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাও ফুটে উঠবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কাজে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি হস্তক্ষেপ কি করেছিলেন কখনো? নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করেন বলে যে রটনা ছিল, সে ব্যাপারে নুরুল ইসলাম কী বলছেন? তিনি যা বলছেন, তা সমালোচনাকারীদের খুশি করবে না। তিনি বলছেন, কমিশনের সদস্যদের নিয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। প্রশাসনিক নিয়োগের দায়িত্বও তখন পালন করেছেন কমিশনের সচিব ও সদস্যরা।
এই নির্বাচন-প্রক্রিয়া ও কোনো কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে নুরুল ইসলামের কাছে কোনো অনুরোধ আসেনি। কোনো মন্ত্রীও কোনো তদবির করেননি। অন্য কোনো কমিশন সদস্যের কাছেও অনুরোধ এসেছে বলে নুরুল ইসলাম কোনো অভিযোগ পাননি। পরিকল্পনা কমিশন মন্ত্রণালয়গুলো থেকে পেশ করা প্রস্তাব অনুমোদন করত। সেই পরিকল্পনাগুলো অনুমোদনের ব্যাপারে শেখ মুজিব কখনো হস্তক্ষেপ করেননি এবং পরিকল্পনা পরিষদের কোনো সিদ্ধান্ত তিনি বাতিল করে দিয়েছেন—এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি।
৫.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গণভবন নিয়ে একটি ঘটনা বলে আজকের আলোচনা শেষ করব। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বাসা, অর্থাৎ গণভবন নির্মাণের ব্যাপারে পূর্ত মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিল। দেশে সম্পদের স্বল্পতা ছিল তখন। তাই পরিকল্পনা কমিশন থেকে পূর্ত মন্ত্রণালয়কে প্রাক্কলিত ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধুকে খুশি করার জন্য পূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির ডিজাইন ও নির্মাণ মানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। বঙ্গবন্ধুও প্রকল্পের কাগজপত্র দেখেছিলেন আগে। তারপরও পরিকল্পনা কমিশন এই কাটছাঁটের পরামর্শ দিয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল এ কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর অফিস থেকে এই ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে কুৎসা রটনাকারীদের দিকে। আর হ্যাঁ, উল্টোদিকে এটাও মনে রাখতে হবে, অতি ভক্তি বড় মানুষদের ক্ষতি করে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
মার্চ মাস মানেই আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের বাঁকবদলের মাস। এ মাসটি এলেই নতুন করে ভাবতে হয় ইয়াহিয়া-ভুট্টোর নৃশংসতার কথা। এ মাসেই, অর্থাৎ ৭ মার্চ এক অনন্য ভাষণে ঋদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্ব। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এ মাসেই যে বজ্রকণ্ঠ ভাষণ দিলেন, তা বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি হয়ে উঠল। এ মাসেই ইয়াহিয়া এলেন ঢাকায়, ভুট্টো এলেন ঢাকায় এবং বৈঠকের ছলে বাঙালিদের হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের প্রাণের অংশ হয়ে উঠেছিলেন তত দিনে।
কিন্তু সেই শেখ মুজিবুর রহমানের নামে যে কুৎসা রটনা হয়েছে, তা ধরে ধরে উত্তর হয়তো দেওয়া যায়, কিন্তু তার আগে যেটা করা দরকার তা হলো, এই রটনাকারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন।
অনেকেই হয়তো লক্ষ করেছেন, ইদানীং কেউ কেউ ধূর্ততার সঙ্গে এমন কিছু কথা বলছেন, যার উদ্দেশ্য প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করা। আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে অন্তত দুজন বাঙালিকে বেছে নেওয়া হয়। তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ও শেখ মুজিবুর রহমান।
এই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেউ লড়াই করছে না। তবে যে দুজনের নাম বলা হলো, তাঁদের বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যা বয়ান তৈরি করলে একসময় মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে—এ রকম গোয়েবলসীয় ভাবনা দিয়েই হয়তো তাড়িত হচ্ছেন এই কালিমা রটনাকারী লোকেরা।
এমন যদি হতো, এটা শুধু পাতিনেতা ধরনের লোকদের হিংসা আর কুচুটেপনা থেকে উত্থিত, তাহলে তা অগ্রাহ্য করা যেত। কিন্তু যাঁরা বলছেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকেরাও রয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ যখন অন্যকে ছোট করার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামেন, তখন দেখা যায়, সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিলিয়ে-মিশিয়ে এমন এক বয়ান তাঁরা তৈরি করেছেন, যা শুনে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন শ্রোতা। বলা কথার মধ্যে কিছু সত্য থাকায় এই দ্বন্দ্ব শ্রোতার মনে প্রগাঢ় হয় এবং একসময় তা বিশ্বাস করতে শুরু করে দেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ রকম বেশ কিছু কুৎসা রচনা করা হয়েছে। কুৎসা রচনা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও।
২.
এর বিপরীতে আছে আরেকটি শক্তি, যাঁরা তাঁদের ধ্যান-জ্ঞানের সবটাই উৎসর্গ করে দেন রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে। বলে রাখা ভালো, রক্ত-মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথ বা শেখ মুজিবকে যখন এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁরা কোনোভাবেই কোনো ভুল করতে পারেন না, তাঁদের কোনো সিদ্ধান্তই ভুল হতে পারে না, তখন সংকটের সৃষ্টি হয়। যেহেতু সেই বর্ণনায় সত্যের সঙ্গে ভক্তি মিশে যায়, সেহেতু তাতে অতিকথন দৃশ্যমান হয়। তারই ফায়দা নেয় কুৎসাকারীরা। কারণ, মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ করলে তাতে মানুষটি বিতর্কিত হয়ে পড়েন, এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সর্বত্রই। অথচ কোনো রকম অতিকথন ছাড়াই যে তাঁদের জীবন বিস্ময়করভাবে মহৎ, সে কথা বুঝতে পারেন না এই ভক্তরা।
আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য হয়েছিল, তা আমি জানি না, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ১০ বছর আমি ছিলাম, সে সময়টির প্রথম পাঁচ বছর আমি সোভিয়েত শাসন দেখেছি, পরের পাঁচ বছর দেখেছি গণতান্ত্রিক রাশিয়ার জীবন। বলা বাহুল্য, সমাজতান্ত্রিক দেশটিতে ব্যক্তি-বন্দনা সেই ব্যক্তির ইমেজকে একেবারেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমি লেনিনের কথাই বলছি। লেনিন নিজে কখনো চাননি, তাঁকে দেবতা বানানো হোক। কিন্তু লেনিনের ওপর দেবত্ব চাপিয়ে দিয়ে বাহ্যিকভাবে হয়তো লাভবান হয়েছে সোভিয়েত সরকার, কিন্তু সাধারণ মানুষের অন্তরে লেনিনকে সেভাবে আর পাওয়া যায়নি। এ জন্য লেনিন নিজে দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিল কমিউনিস্ট পার্টি এবং সেই পার্টির নেতৃত্ব।
৩.
রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারী হিসেবে যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে কেউ কেউ উপস্থাপন করেছেন, তা শুধু একদেশদর্শীই নয়, একেবারে ডাহা মিথ্যা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রচুর কাজ করা একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক অকারণেই একসময় রবীন্দ্রনাথের নামে কালিমা লেপন করার চেষ্টা করেছিলেন। বামপন্থী সেই অধ্যাপকের তথ্য-উপাত্তগুলো একেবারেই ভ্রান্ত ছিল, কিন্তু সে সময় অনেকে তা বিশ্বাস করেছিল স্রেফ এই কারণে যে, এই অধ্যাপক বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাস নিয়ে ঈর্ষণীয় কাজ করেছেন। কিন্তু কী কারণে তাঁর মনে রবীন্দ্রবিদ্বেষ জায়গা করে নিয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও খুঁজে পাই না। তাঁরই অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছেন আরেক জনপ্রিয় অধ্যাপক। তিনি সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান করে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথের সাফাই গাওয়ার জন্য এই লেখা নয়। এই লেখা হলো অকারণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো মানুষদের ব্যাপারে পাঠককে সতর্ক করে দেওয়া।
৪.
হাতে এসেছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একটি বই। এই অর্থনীতিবিদ আমাদের ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত, সেটা বোধ হয় ইতিহাসে উৎসাহী প্রতিটি মানুষেরই জানা। তিনি সদ্যোজাত বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ যখন সংকটকাল অতিক্রম করছে, সে সময়টি তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে থেকে দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়েই অল্প কয়েকটি কথা বলা যাক।
অনেকেই বলে থাকেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো শেখ মুজিব একা নিতেন; অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। শেখ মুজিব কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের চেয়ে সচিবদের সরাসরি নির্দেশনা দিতেন। তাতে মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর দিয়ে দিতেন। কিন্তু এ ব্যাপারটা সিনিয়র মন্ত্রীদের সঙ্গেও ঘটত, এটা সত্য নয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাকদের মতো সিনিয়রদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নিতেন শেখ মুজিব। আইন ও পররাষ্ট্র-সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্ভর করতেন ড. কামাল হোসেনের ওপর। গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে তিনি আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। এ ঘটনার আলোকেই বাকশাল গঠন করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে এবং তখন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাও ফুটে উঠবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কাজে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি হস্তক্ষেপ কি করেছিলেন কখনো? নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করেন বলে যে রটনা ছিল, সে ব্যাপারে নুরুল ইসলাম কী বলছেন? তিনি যা বলছেন, তা সমালোচনাকারীদের খুশি করবে না। তিনি বলছেন, কমিশনের সদস্যদের নিয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। প্রশাসনিক নিয়োগের দায়িত্বও তখন পালন করেছেন কমিশনের সচিব ও সদস্যরা।
এই নির্বাচন-প্রক্রিয়া ও কোনো কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে নুরুল ইসলামের কাছে কোনো অনুরোধ আসেনি। কোনো মন্ত্রীও কোনো তদবির করেননি। অন্য কোনো কমিশন সদস্যের কাছেও অনুরোধ এসেছে বলে নুরুল ইসলাম কোনো অভিযোগ পাননি। পরিকল্পনা কমিশন মন্ত্রণালয়গুলো থেকে পেশ করা প্রস্তাব অনুমোদন করত। সেই পরিকল্পনাগুলো অনুমোদনের ব্যাপারে শেখ মুজিব কখনো হস্তক্ষেপ করেননি এবং পরিকল্পনা পরিষদের কোনো সিদ্ধান্ত তিনি বাতিল করে দিয়েছেন—এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি।
৫.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গণভবন নিয়ে একটি ঘটনা বলে আজকের আলোচনা শেষ করব। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বাসা, অর্থাৎ গণভবন নির্মাণের ব্যাপারে পূর্ত মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিল। দেশে সম্পদের স্বল্পতা ছিল তখন। তাই পরিকল্পনা কমিশন থেকে পূর্ত মন্ত্রণালয়কে প্রাক্কলিত ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধুকে খুশি করার জন্য পূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির ডিজাইন ও নির্মাণ মানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। বঙ্গবন্ধুও প্রকল্পের কাগজপত্র দেখেছিলেন আগে। তারপরও পরিকল্পনা কমিশন এই কাটছাঁটের পরামর্শ দিয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল এ কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর অফিস থেকে এই ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে কুৎসা রটনাকারীদের দিকে। আর হ্যাঁ, উল্টোদিকে এটাও মনে রাখতে হবে, অতি ভক্তি বড় মানুষদের ক্ষতি করে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে