স্বাভাবিক প্রসবে আস্থার ঠিকানা

আনিসুল হক জুয়েল, দিনাজপুর
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২২, ০৮: ৪৬
আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২২, ১৬: ০৬

বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ হাজার ৭০০-এর বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এর বেশির ভাগের অবস্থা শোচনীয়। তবে কোনো কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এরই একটি পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিক। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার পলাশবাড়ী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের এই ক্লিনিক সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও হয়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের ভরসার জায়গা।

হুসনি আরার গল্প 
মধ্য নভেম্বরের রাত। হালকা শীতের আমেজে রাতের গ্রামীণ পরিবেশে তখন মেলা বসেছে। কেউ কেউ সারা দিনের ব্যস্ততা সেরে রাতের খাবার শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন। দিনাজপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দুর্গাপুর। পূর্ব আর পশ্চিম—এ দুই ভাগে বিভক্ত। উপজেলা শহর থেকেও এর দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। পূর্ব দুর্গাপুরের বাসিন্দা হুসনি আরার প্রসববেদনা শুরু হয় রাত ৮টায়।

থানা সদরে নিতে হলেও যানবাহন পাওয়া দুরূহ। তাই প্রসববেদনা ওঠায় বিচলিত হয়ে ওঠেন হুসনি আরার স্বামী ও স্বজনেরা। একখানা ভ্যান জোগাড় করে কোনোমতে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে। সেখানে ধাত্রী সাবানু খাতুন হুসনি আরার গর্ভকালীন ইতিহাস শুনে এবং প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে বুঝতে পারেন, হুসনি আরা যমজ সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন। কিছুটা জটিলতা থাকায় প্রয়োজন হতে পারে অপারেশনের। হুসনি আরাকে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পরামর্শ দেন সাবানু খাতুন। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তাঁর স্বামীর পরিবার বেঁকে বসে। তারা এই কমিউনিটি ক্লিনিকেই সন্তান জন্ম দেওয়ার পক্ষে। তাঁদের জোরাজুরিতে ‘আল্লাহর নাম’ নিয়ে সন্তান প্রসবের কাজ শুরু করেন প্রশিক্ষিত ধাত্রী সাবানু খাতুন। পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেন বিশ্বস্ত আয়া শাহানাজ পারভীন। সাড়ে তিন ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রথম সন্তানের জন্ম দেন হুসনি আরা। তারও দেড় ঘণ্টা পর, রাত ১টায় জন্ম হয় অন্য শিশুটির।

শুধু হুসনি আরার এ ঘটনাই নয়। এ রকম আরও অনেক বিনিদ্র রজনীর সাক্ষী সাবানু খাতুন ও আয়া শাহনাজ পারভীন।

যাত্রা শুরু
দুর্গাপুর গ্রামটি আর দশটি গ্রামের মতো নিতান্তই সাদামাটা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব কৃষক। তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। সেখানে স্বাস্থ্যের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয় করার সামর্থ্য নেই বললেই চলে। ২০১১ সালে পলাশবাড়ী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের পূর্ব অংশে সীমিত সুবিধা নিয়ে যাত্রা শুরু করে পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিক।

সাধারণত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সেবা দিয়ে থাকে। শুক্রবারসহ অন্য ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার বা সিএইচসিপি দিনে একবেলা সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। সিএইচসিপিদের ঠিকমতো অফিস না করা, প্রয়োজনীয় ওষুধ চুরি করা, কমিটির লোকজনের অনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে ওষুধ নিয়ে যাওয়া কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর চিরচেনা চিত্র।

এদিক দিয়ে পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবেশ পুরোই আলাদা। এখানে সিএইচসিপি জনগণের সেবায় যেমন আন্তরিক, তেমনি কমিটির লোকজনের ইতিবাচক মানসিকতা ক্লিনিকটিকে একটি অনন্য অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

ক্লিনিকের সার্বিক সেবার ব্যাপারে কথা বলছেন এলাকার কয়েকজনসচেতন কমিটির ইতিবাচক যাত্রা
সিএইচসিপিদের সীমিত সেবায় উপকৃত হয়ে এলাকার কিছু মানুষ এই ক্লিনিকের সেবার পরিধি বাড়ানোর ব্যাপারে একমত হন। তাঁদের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেয় পার্বতীপুরের বেসরকারি সংস্থা ল্যাম্ব। বিদেশি একটি প্রকল্পের সহায়তায় ২৪ ঘণ্টা নিরাপদে স্বাভাবিক প্রসব এবং গর্ভকালীন সেবা চালু করে তারা। বিষয়টি এই ক্লিনিককে এক ধাপ এগিয়ে দেয় অন্যান্য কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে।

পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে ২০১৫ সালের ৬ মে ল্যাম্বের সহযোগিতায় আগ্রহী স্থানীয় নারীদের ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে বেছে নিয়ে ২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করা হয়। সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী থাকায় নিরাপদে স্বাভাবিক প্রসবসুবিধা, গর্ভকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সেবাদানের ব্যবস্থা বেশ মজবুত হয় ক্লিনিকটিতে। এ ক্ষেত্রে এলাকাবাসীর পাশাপাশি কার্যকর ভূমিকা রাখে কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনা কমিটি। কমিটির সদস্য মরহুম আব্দুর রাজ্জাক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে ক্লিনিকে নিজের ৮ শতাংশ জমি দান করেন। এই জমির ওপর কমিটির লোকজনের প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় নির্মাণ করা হয় পাকা ভবন। কেনা হয় কিছু যন্ত্রপাতী।

৭৫০টি স্বাভাবিক প্রসব 
এই ক্লিনিকের ছয়জন নারী সদস্য পূর্ব দুর্গাপুর ও আশপাশের গ্রামগুলোতে বড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের কমিউনিটি ক্লিনিকে চালু করা সুবিধার কথা জানান এবং সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। দিন কিংবা রাত যেকোনো সময় গর্ভকালীন জটিলতা কিংবা প্রসবসেবায় প্রস্তুত থাকেন ক্লিনিকের সার্বক্ষণিক কর্মীরা। অনবদ্য সেবায় ইতিহাস গড়ে গত সাড়ে সাত বছরে পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে ৭৫০টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে!

সীমিত সুবিধা
রাতের বেলায় রোগী আনা-নেওয়ার জন্য ক্লিনিকটিতে চালু করা হয় ভ্যানের সুবিধা। দুপুর কিংবা রাতে ফোন দেওয়ামাত্রই ভ্যানচালক পৌঁছে যান রোগীর বাড়িতে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোফাখ্খারুল ইসলাম চৌধুরী ইউনিয়নে চালু করেন অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ল্যাম্বের সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। মূলত এ সময় থেকে পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের শক্তি কিছুটা কমে যায়। ফলে স্বাস্থ্যসেবা কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ক্লিনিক পরিচালনা কমিটি এখনো সীমিত পরিসরে সেবাদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তারা জানায়, সাধারণত একটি স্বাভাবিক প্রসবে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা খরচ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই টাকা পরিশোধে অপারগ হলে কমিটির লোকেরাই নির্ধারিত হারে চাঁদা দিয়ে তা পরিশোধ করে দেন। এ চাঁদার টাকা জমা হয় নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে মাস শেষে ধাত্রী ও আয়ার বেতনসহ ওষুধ কেনা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ সম্পন্ন করা হয়।

পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ সুলতান মাহমুদ জানান, সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাতেও তাঁদের বছরে প্রায় ২ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়।

তৃপ্ত মানুষেরা
কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ফরিদা ইয়াসমীন জানান, এটি তাঁর শ্বশুরবাড়ির এলাকা। তাঁর বাবার বাড়িও পাশের ইউনিয়নে। তিনি জানান, কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক কিংবা নার্স না থাকলেও এখানে নিয়ম মেনে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। এমনকি গর্ভবতীদের বিশেষ শারীরিক অবস্থার রেখাচিত্র বা পার্টোগ্রাফ মেনে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সীমিত সামর্থ্যে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা দিতে পেরে গর্বিত বলে জানিয়েছেন ফরিদা ইয়াসমীন।

স্থানীয় ধাত্রী সাবানু খাতুন জানান, প্রথম প্রথম কিছুটা ভয় লাগত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে এখানে যদি সপ্তাহে দুই-তিন দিন মেডিকেল অফিসার বসতেন, এলাকাবাসী খুব উপকৃত হতো।

সহায়তার আশ্বাস
গত ১৯ নভেম্বর ক্লিনিকটি পরিদর্শন করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এইচ এম বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী। তিনি আজকের পত্রিকাকে জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকের যে মূল লক্ষ্য, পূর্ব দুর্গাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকটি সেই লক্ষ্য শতভাগ অর্জন করেছে বলে তিনি মনে করেন। পার্বতীপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ক্লিনিকটি যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ক্লিনিকটি পরিচালনায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে  বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. এ এইচ এম বোরহানুল ইসলাম।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত