নতুন মার্কিন জোট, চাপে বাংলাদেশ

সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২২, ০৮: ৪৯
আপডেট : ০৫ জুন ২০২২, ১৩: ১৮

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত উদ্যোগে (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি) বাংলাদেশকে পেতে বেশ কয়েক বছর ধরেই চেষ্টা করছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার চীন-বিরোধী মিত্রদেশগুলো। তবে সামরিক ও কৌশলগত উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এত দিন অনীহা প্রকাশ করে এসেছে বাংলাদেশ। কেবল অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্যোগেই বাংলাদেশের শামিল হওয়ার সম্ভাবনার কথা যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ) নামে নতুন এক অর্থনৈতিক জোটের সূচনা করার পর চাপ বেড়েছে বাংলাদেশের ওপর। এই চাপ জোটে যোগ দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে সব তরফেই আছে।

ঢাকা, ওয়াশিংটন ও বেইজিংভিত্তিক কূটনীতিকেরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চাইছে বাংলাদেশ আইপিইএফে যোগ দিক। অন্যদিকে এসব দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিপক্ষ চীন এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

কূটনীতির এই খেলায় আপাতত শেষ চাল দিয়েছে চীন। ১ জুন বেইজিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন, চীন চায় বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের ও এই অঞ্চলের মৌলিক স্বার্থ রক্ষা এবং স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার কথা বিবেচনায় রাখবে। স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা এবং ব্লক-ভিত্তিক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবে। সত্যিকারের বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা মেনে চলবে। বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক লিউ জিনসং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামানকে যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেনের বক্তব্যের সূত্রে এসব কথা বলেছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গতকাল শনিবার বলেন, ‘চাপ তো আছেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের প্রতি সবার আগ্রহ আছে। এ কারণে টানাটানিও আছে খানিকটা।’ বঙ্গোপসাগর, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ প্রায় অভিন্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব দেশ ইতিমধ্যে আইপিইএফে যোগ দিয়েছে, সেগুলোসহ এই অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়। এখন বাংলাদেশ যোগ দিলেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কৌশলগতভাবে যা অর্জন করতে চাইছে, তা অনেকখানি সহজ হয়ে যায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ আইপিইএফ বিষয়ে আরও তথ্য চেয়েছে। যথেষ্ট তথ্য আসার পর এ বিষয়ে ভেবে দেখা হবে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২৩ মে জাপান সফরকালে আইপিইএফের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। একই দিন হোয়াইট হাউস থেকে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আইপিইএফ যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের মিত্রদের কাজের নিয়ম-নীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে, যাতে মার্কিন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং খামারিরা ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে প্রতিযোগিতা করতে পারে।’

আপাতত অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামকে নিয়ে এই সংস্থা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশসহ একাধিক দেশকে এই জোটে যোগ দিতে জোরালো তদবির করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্র দেশগুলো।

বাংলাদেশ আইপিইএফের বিষয়ে আগ্রহী হবে আশা প্রকাশ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস গত ৩১ মে ঢাকায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সরবরাহ ব্যবস্থার সহনশীলতা, পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ কমানো, দুর্নীতি প্রতিরোধে কর ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্রম প্রসারের ধারণা নিয়ে এগোচ্ছে। কিছু দেশকে নিয়ে শুরুতে একটি চুক্তি হবে। দেখতে হবে কী রকম চুক্তি হয়, আর সময়ের সঙ্গে কীভাবে এর সদস্য বাড়ানো যায়।

গত ২ জুন ওয়াশিংটনে এক দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক আলোচনায় আইপিইএফ বিষয়ে বাংলাদেশকে অবহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর জবাবে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সরবরাহ ব্যবস্থার সহনশীলতা এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় কার্বন নিঃসরণ কমানো ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত ২৮ মে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এবং মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে সড়ক পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোয় বড় মাপে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে শুধু আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো ও জাপান নয়, ক্রমবিকাশমান আইপিইএফ ধারণা বাস্তবায়নের পথে বড় রকম অগ্রগতি ঘটবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের উপস্থিতিতে দেওয়া জয়শঙ্করের এই বক্তব্যকে “পরোক্ষ চাপ” বলে মনে করছেন কূটনীতিকেরা।

এর আগে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বাস্তবায়নাধীন বহুমুখী গভীর সমুদ্রবন্দরকে উন্মুক্ত ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য জাপানি পরিকল্পনার অংশ বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত ইতো নাউকি। মাতারবাড়ির সাফল্য বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানে বড় মাপের পরিবর্তন ঘটাবে বলে তিনি গত বছর ১৪ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছিলেন।

গত বছর এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী উই ফেনঘি বলেছিলেন, বাংলাদেশের উচিত চীনের সঙ্গে হাত মেলানো যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক জোট গঠনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের মার্কিন চেষ্টা প্রতিহত করা যায়।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হ‌ুমায়ুন কবির বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই চীন চাপে ছিল। আইপিইএফের আনুষ্ঠানিক সূচনার পর চীনারা বুঝতে পেরেছে সামনে বেশ বড় [কূটনৈতিক] ঢেউ আসবে। তাই বাংলাদেশ যাতে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাকারী কোনো ব্লকে না যায়, সে জন্য তারা বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে। আইপিইএফে যোগ দিলে এবং না দিলে বাংলাদেশের কী দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা ও অসুবিধা হতে পারে, সে বিষয়ে এখন চুলচেরা বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হুট করে এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।

চীনের উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের আইপিএস (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি) –যাই হোক না কেন, “বন্ধুত্ব” ও “সম্পর্ক” কার সঙ্গে কেমন, এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্র খুশি হবে কি হবে না, এসব না ভেবে বাংলাদেশ সরকারকে দেশের স্বার্থে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মত দেন এই প্রবীণ কূটনীতিক।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত