সড়ক পরিবহন আইনে চালকদের শাস্তি কমছে

উবায়দুল্লাহ বাদল, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৩, ১০: ১৫
আপডেট : ১৮ মে ২০২৩, ১০: ২০

সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত চালকসহ পরিবহনশ্রমিকদের জেল-জরিমানায় বড় ধরনের ছাড় দিয়ে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যমান আইনের বিধান অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে, দায়ী ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে ‘গুরুতরভাবে আহত’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জরিমানা ৫ লাখ থেকে কমিয়ে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এভাবে সংশোধনীর খসড়ায় প্রায় ১০ জায়গায় শাস্তি কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

খসড়া সংশোধনীতে তিন চাকার মোটরযানের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রস্তাব করা হয়েছে পঞ্চম শ্রেণি পাস। বিদ্যমান আইনে এই যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। এমনকি যন্ত্রচালিত বা বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত যানবাহন, বাইসাইকেল, রিকশা ও রিকশাভ্যানকে মোটরযানের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। সংশোধনীর খসড়াটি যাচাই-বাছাই চলছে। যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে অনুমোদনের জন্য শিগগিরই মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি গত মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ সংশোধনের কাজ চলছে। কিন্তু এর পুরো খসড়া এখনো পড়া হয়নি।’

জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনের পর ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাস করা হয়। সে বছরের ৮ অক্টোবর এর গেজেট জারি করা হয়। তবে আইনে বলা হয়, সরকার আইনটি কার্যকরের তারিখ ঠিক করে এর প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এই সুযোগে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো আইন পরিবর্তনের দাবিতে দুই দফায় ধর্মঘট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে বছরের নভেম্বরে সরকার আইনটি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা নিলে পরিবহন সংগঠনগুলো আইনটির বিভিন্ন ধারা পরিবর্তনের জন্য আবারও ধর্মঘট ডাকে। তাদের মূল দাবি ছিল, আইনের অধীনে সব অপরাধ জামিনযোগ্য করতে হবে। বিভিন্ন ধারায় যে জরিমানার কথা বলা হয়েছে, তা কমাতে হবে। এ অবস্থায় চার বছরের মাথায় আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি মনে করে, চালক ও শ্রমিকদের শাস্তি কমিয়ে আইনটি সংশোধন করা হলে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে পড়বেন। সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংশোধনী পাস হলে পরিবহন সেক্টরের সরকারের অসহায়ত্ব আরও বাড়বে। আইনে শাস্তি কমানোর মধ্য দিয়ে জনগণের স্বার্থ চরমভাবে বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ 

শাস্তি কমানোর আরও কিছু প্রস্তাব 
বিদ্যমান আইনের ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারায় বর্ণিত অপরাধ জামিন অযোগ্য। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবে ৮৪ ও ৯৮ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য এবং ৯৮ ধারার অপরাধকে আপসযোগ্য বলা হয়েছে। আইনের ৯০ ধারায় মোটরযান পার্কিং এবং যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার নির্ধারিত স্থান ব্যবহারসংক্রান্ত বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড উল্লেখ আছে। তাতে বলা আছে, এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা যাবে। কিন্তু সংশোধনীর খসড়ায় এ অপরাধের জন্য মাত্র ১ হাজার টাকা জরিমানা প্রস্তাব করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে চালকের পয়েন্ট কাটার বিষয়টি।

আইনে ভুয়া বা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের দণ্ড নির্ধারিত আছে ছয় মাস থেকে দুই বছরের জেল বা ১ থেকে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। সংশোধনীর খসড়ায় এটিও সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। সংশোধনীর খসড়ায় অর্থদণ্ড কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। ট্রাফিক সংকেত না মানার শাস্তি উল্লেখ আছে, সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে। এ ক্ষেত্রে কারাদণ্ড উঠিয়ে অর্থদণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা। 

মালিকেরা খুশি
শাস্তি কমানোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তবে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা কমানোর প্রস্তাবকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘কম শিক্ষিত কিন্তু রাস্তার রোড সাইন যদি বোঝেন বা অভিজ্ঞতার আলোকে কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেটা খারাপ না। এতে দেশের ১০ লাখ চালক-সংকটের কিছুটা সমাধানও হবে।’

আইনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যাঁদের শৃঙ্খলায় আনতে আইন তৈরি, তাঁদের চাপেই পরিবর্তন করা হলে আইনের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে। তাঁরা বলছেন, যে উদ্দেশ্যে আইনটি করা হয়েছিল, সে উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘এই আইন প্রণয়নের সঙ্গে শুরু থেকেই আমি ছিলাম। ২০১১ সালের খসড়ার সঙ্গে ২০১৮ সালের আইনের ফারাক আকাশ-পাতাল। যে স্পিরিট নিয়ে প্রথম খসড়া হয়েছিল, তার অনেক কিছুই নেই বিদ্যমান আইনে। অনেক ছাড় দিয়েই এটি করা হয়েছিল। তারপরও অংশীজনের মতামতের আলোকেই আইনটি হয়েছিল। একটি পক্ষের নতুন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংশোধন হবে, অন্য কারও পর্যবেক্ষণ থাকবে না, সেটা কোনো দলিল হচ্ছে না। এটি কোনো গোষ্ঠীকে রক্ষা করার সমঝোতার দলিল হচ্ছে। যাঁদের জন্য আইন, তাঁরা অনেক বেশি শক্তিশালী। সংশোধনীতে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে এটা দিয়ে অন্তত সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানো, দুর্ঘটনা রোধ ও আইনভিত্তিক পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত