মজুরির লড়াই শেষই হয় না

মারুফ কিবরিয়া, ঢাকা
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ১১: ০৮

রাজধানীর বিজয়নগরে তপা কমপ্লেক্সের সপ্তম তলায় ঢাকার প্রথম শ্রম আদালত। আদালতকক্ষে স্থানসংকুলান না হওয়ায় বাইরে সরু করিডরে বিচারপ্রার্থীদের ভিড়। একটি বেঞ্চে কয়েকজন বসতে পারলেও অন্যদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেখানে নেই কোনো বৈদ্যুতিক পাখাও। গত ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে বেঞ্চে বসে বারবার ঘাম মুছছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আবু মুসা। তিনি জানান, তিনি এসেছেন ভোলা থেকে। পাওনা চেয়ে পাঁচ বছর আগে মামলা করেছিলেন জুলফার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

আবু মুসা বলেন, ‘কিছুদিন পরপরই আসতে হচ্ছে আদালতে। আর এখন যে গরম, তাও আবার বসার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। মামলার জন্য এখানে আসাটা আমার মতো সবার জন্যই ভোগান্তির।’ তিনি জানান, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি একপর্যায়ে বিক্রি হয়ে গেলে তাঁর মতো অনেকের চাকরি চলে যায়। কিন্তু তাঁদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। একটি মামলায় মুসাসহ ৪০ জন বাদী। মুসা বলেন, ‘কোম্পানির কাছে ১৯ লাখ টাকা পাই।’

আরেক বাদী কাজী মো. হোসনে মোবারক জানান, তিনি ১৪ লাখ টাকা পেতেন। ২ লাখ দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকার জন্য মামলা করেছেন। মোবারক বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে আসতে হয়। কী যে ভোগান্তি বলে বোঝানো যাবে না।’

গত ২৫ এপ্রিল প্রথম শ্রম আদালতে কথা হয় সিলেট থেকে আসা বিচারপ্রার্থী মো. সোহেলের সঙ্গে। শেভরন বাংলাদেশ নামের একটি কোম্পানিতে তিনি গাড়িচালক ছিলেন। একপর্যায়ে তাঁকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তার আগেই তিনি চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য মামলা করেছিলেন। কিন্তু ৯ বছরেও মামলা শেষ হয়নি। সোহেল বলেন, ‘২০১৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর মামলা করি। কিন্তু ২০১৯ সালে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’ 

একই কোম্পানির আরেক সাবেক গাড়িচালক আজিজ নূর বলেন, ‘৯ বছর ধরে মামলা চলছে। কত কষ্ট করে যে আসি! এখানে গরমে টিকা কঠিন। অনেক সময় শুনানিও হয় না।’

ময়মনসিংহ থেকে একই দিন দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে আসেন মাহতাব হাওলাদার। তিনি সামিট গ্রুপের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। ২০২২ সালে তাঁকে বাধ্য করা হয় চাকরি ছাড়তে। মাহতাব বলেন, ‘১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পাই। মামলা করে এক বছরের বেশি সময় ধরে ঘুরছি।’

সাভারের হেমায়েতপুরে দীপ্ত অ্যাপারেলসের এজিএম ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। হঠাৎ ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে চাকরি চলে যায়। বুঝে পাননি ৬ লাখ টাকা। মামলা করেছেন এক বছরের বেশি সময় আগে। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘এখানে খুব ভোগান্তি। ন্যায্য পাওনার জন্য মামলা করেছি। শুনানির পর শুনানি।’

বেলা দেড়টায় ষাটোর্ধ্ব মো. সোলায়মান কবীর বলেন, ‘পারফেক্ট সোয়েটারে চাকরি করতাম। কিন্তু ১৫ দিনের টাকা না দিয়ে বিদায় করে দিছে। ১৫ হাজার টাকা হবে। মামলা শেষ হওয়ার নাম নেই।’

একই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী ঝর্ণা বেগম বলেন, ‘বাসায় বাচ্চাদের রাইখা আইছি। আরেক জায়গায় চাকরি করতাম, ছুটি নিছি। শুনানি হইব কি না জানি না।’ তিনি জানান, ১৩ মাসের বেতন বকেয়া রেখেই ছাঁটাই করেছে। 

বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা যায় ঝর্ণাদের মামলার শুনানি আর হয়নি। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের চিত্রসাংবাদিক সৈয়দ শওকত আলী মামলা করে বছরের পর বছর ঘুরছেন। পাঁচ বছর আগে কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই তাঁকে ছাঁটাই করা হয়েছিল। তৃতীয় শ্রম আদালত সম্প্রতি তাঁকে ৪ লাখ টাকা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু টাকা পাননি। শওকত বলেন, ‘এবার ফৌজদারি মামলা করেছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত