সাক্ষাৎকার

ভবিষ্যতের স্বার্থে শিক্ষকদের পেছনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

ওমর শেহাব নিউইয়র্কের আইবিএম থমাস জে ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টারে একজন তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের অনুদানপ্রাপ্ত গবেষক এবং বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটির সদস্য। নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে ই-মেইলে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের পত্রিকার রজত কান্তি রায়। 

আজকের পত্রিকা: নতুন শিক্ষাবর্ষে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় বিভাগ বিভাজন উঠে যাচ্ছে। কারিকুলাম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকা একজন হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কী?
ওমর শেহাব: আসলে উঠে যাওয়ার ধারণাটি ভুল। ব্যাপারটি হলো আগে কিছু শিক্ষার্থী যারা কিনা মানবিক ও ব্যবসায় বিভাগে পড়ত, তারা স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু বিজ্ঞান জানা উচিত, সেটি না জেনেই পাস করে যেত। এখন সবাইকে বিজ্ঞানের ন্যূনতম ধারণা নিয়ে পাস করতে হবে। আমার মনে হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে একটি উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যেখানে অভিভাবকদের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখানো হবে বিজ্ঞান ও গণিত জানা থাকলে কীভাবে নানা ধরনের ক্যারিয়ারের দরজা তাঁদের সন্তানদের জন্য খুলে যাবে। শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয়, একজন ভালো ব্যাংকার, একজন ভালো শিল্পী, একজন ভালো রাজনীতিবিদ সবারই বিজ্ঞান ও গণিতের কিছু প্রাথমিক ধারণা থাকা উচিত।

আজকের পত্রিকা: নতুন কারিকুলামে অভিন্ন বিষয় হওয়ায় নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের অংশ কমে যাচ্ছে বলে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা হোঁচট খেতে পারে। এমন ধারণা করছেন অনেকেই। কীভাবে মূল্যায়ন করবেন বিষয়টিকে?
ওমর শেহাব: বিজ্ঞানের অংশ কমেনি। আমি রূপরেখার ৭৮ পৃষ্ঠা থেকে শিখন সময়ের সারণিটির কথা বলতে পারি। সেই সারণিতে গণিত, বিজ্ঞান ও ডিজিটাল প্রযুক্তি নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে ৩১ থেকে ৩২ শতাংশ।

আজকের পত্রিকা: নিয়মনীতি বদলের যে আধুনিক পন্থা, যেটা পলিসি মডেলিং ও সিনারিও অ্যানালাইসিস নামে পরিচিত, কারিকুলাম বদলের সময় সেটা অনুসরণ করা হয়েছিল কি না? 
ওমর শেহাব: এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রথম ১০ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত বলা আছে। তবে সাধারণ মানুষ ওয়েবসাইটে গিয়ে এসব পড়ে দেখবে না। এ কারণে সরকারের উচিত গণমাধ্যমে এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রচারণা চালানো। এতে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস বাড়বে। এ ছাড়া আমার মনে হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে সমাজ মনস্তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ স্থায়ীভাবে নিয়োগের সময় হয়েছে। তাঁদের একমাত্র কাজ হবে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক-সংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগ কীভাবে অভিভাবকদের না চমকিয়ে নেওয়া যায়, সেই উপায়গুলো বাতলে দেওয়া।

আজকের পত্রিকা: বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর শিক্ষকেরা বলছেন, পর্যাপ্ত ট্রেনিং, উপকরণসহ অন্যান্য সুবিধা না হলে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। সে বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ওমর শেহাব: আমি শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সঙ্গে একমত। পর্যাপ্ত ট্রেনিং ও উপকরণ ছাড়া আসলেই এটি বাস্তবায়ন অসম্ভব। এখন পর্যন্ত সরকার যেভাবে কাজ করছে তাতে আমার বিশ্বাস, এ সবকিছুই সরবরাহ করা হবে। তবে আমার মনে হয়, পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও শিক্ষাসংক্রান্ত এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রতিদিন কোন নায়ক কোন নায়িকাকে কেন বিয়ে করছেন না, এসব ব্যক্তিগত জীবন অনুসন্ধানে প্রচুর সময় খরচ করে। আমার মনে হয়, সুস্থ বিনোদনসংক্রান্ত খবর রেখে বিনোদন পাতার বাকি পুরো বাজেট নতুন শিক্ষাক্রমের প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতাসংক্রান্ত অনুসন্ধানে দিয়ে দেওয়া উচিত। 

আজকের পত্রিকা: সরকারের নতুন এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জগুলো কী বলে মনে করেন? 
ওমর শেহাব: নতুন শিক্ষাক্রম মূল্যায়নের মূল চ্যালেঞ্জ দুটি। শিক্ষকদের চাকরির সন্তুষ্টি আর অভিভাবকদের আস্থা বাড়ানো। সবার মাথায় যা রাখতে হবে সেটি হলো, শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য আর চাকরির সন্তুষ্টির ওপর আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। আমরা যদি বুড়ো বয়সে সন্তানদের ওপর নির্ভর করতে চাই, তাহলে আমাদের দরকার চিত্তে আর বিত্তে সচ্ছল সন্তান। কাজেই শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোকে দান-খয়রাতের দৃষ্টিতে দেখলে হবে না। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের স্বার্থে শিক্ষকদের পেছনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনের নেতৃত্বে যারা আছেন, তাঁরা এসব বিবেচনায় রাখবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমাদের একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাব্যবস্থায় থাকে ১০ থেকে ১২ বছর। আর বড় বড় আমলারা থাকেন ৩ থেকে ৫ বছর। কিন্তু শিক্ষকেরা এই ব্যবস্থায় থাকেন ৩০ থেকে ৪০ বছর। কাজেই সরকারের শিক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগে আমাদের কিছু প্রশ্ন করতে হবে। যেমন:

১. আমরা কি নিশ্চিত, এ উদ্যোগটি শিক্ষকদের প্রতিদিনের কাজের চাপ আরেকটু বাড়াবে না?
২. মন্ত্রণালয় হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে অনেক ব্যর্থতার ইতিহাস। মানুষ কেন বিশ্বাস করবে যে এ উদ্যোগটি সফল হবে?
৩. এ উদ্যোগটি সবচেয়ে দরিদ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কি বাস্তবসম্মত?
৪. এ উদ্যোগটি সফল হলো না ব্যর্থ, তার পরিসাংখ্যিক মাপকাঠি কী?
৫. পরিসাংখ্যিক মাপকাঠিতে সাফল্য বা ব্যর্থতার হার স্বচ্ছভাবে কখন মানুষকে জানানো হবে? 
৬. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আগামী ১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কি এমন কোনো প্রকল্প নেওয়ার সম্ভাবনা আছে, যার কারণে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি মাঝপথে অপ্রাসঙ্গিক বা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেতে পারে? 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি আমরা শুরুতেই দিয়ে দিই, তাহলে আমরা শিক্ষকদের আস্থা আর অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা—দুই ক্ষেত্রেই আগের চেয়ে একটু ভালো করতে পারব।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের রেকর্ড ভাঙল ১৪ বছর পর

৩ মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা

যানজটে গুলি করে ফেঁসে গেলেন জাপার সাবেক এমপি, অস্ত্রসহ আটক

শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরীমনি, কী ঘটেছিল সেখানে

এয়ারক্র্যাফটে স্বর্ণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত