মামুনুর রশীদ
এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে আছে। সেখানে কোনো আন্দোলন-প্রতিবাদ হয় না। কিন্তু ২ নভেম্বর যা ঘটে গেল তা কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদ নয়, নয় কোনো সমাবেশ বা বিক্ষোভ। বিষয়টি ছিল একেবারেই হামলা। প্রথমে সন্ধ্যা ৬টায় টিকিট ঘরে গিয়ে কিছু ব্যক্তি টিকিট বিক্রি বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেয়। উপস্থিত নাট্যকর্মীরা সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এরপর তারা গেট ভেঙে মঞ্চে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। এবং নাটক বন্ধের জন্য হুমকি দিতে থাকে। ওই সময় দেশ নাট্যদলের নিত্যপুরাণ নাটকটি চলছিল। সেই উত্তেজিত ব্যক্তিদের কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। শিল্পকলার নিরাপত্তা বিধানের জন্য যে ব্যবস্থা ছিল সেই ব্যবস্থাটিও কোনো কাজে লাগল না। একপর্যায়ে মহাপরিচালক পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে নাটকটি বন্ধ করে দিলেন।
শিল্পকলা একাডেমি বা মহিলা সমিতিতে গত তিপ্পান্ন বছরে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। দুই-একবার কেউ কেউ চেষ্টা করলেও আমরা সম্মিলিতভাবে দাঁড়িয়ে গেলে আর কেউ সাহস পায় না। ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও হয়তো চেষ্টা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটাও সফল হয়নি। নাটক আমরা করে থাকি মানুষের জন্য। মানুষই আমাদের একমাত্র সহায়, রাষ্ট্র বা সরকার নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটা ঘটল তাতে মনে হচ্ছে, সরকারের প্রতিনিধি যখন নাটক বন্ধ করে দেন, তখন বোঝা গেল সরকারও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ।
নাটকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ১৮৭৬ সাল থেকে। তখনকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার তাদের সমালোচনা সহ্য করেনি। তারা অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের ব্যবস্থা করেছিল। এবারে নাট্যমঞ্চে হামলা তার চেয়ে দুই পায়ে এগিয়ে। ওই নাট্যদলের একজন সদস্য নাকি ফেসবুকে সাম্প্রতিক আন্দোলন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেছেন। সেই মন্তব্য ওই দিনের হামলাকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। যেকোনো মন্তব্য কারও কাছে গ্রহণযোগ্য না-ই হতে পারে। তার জন্য আইনি ব্যবস্থা আছে বা গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে যে কেউ গণতান্ত্রিক উপায়েই এর প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু নাটক বন্ধ করে দেওয়া এবং নাট্যমঞ্চে হামলা করা সমাধান যারা ভাবে, তারা কি প্রকৃতই গণতন্ত্রের মানুষ?
নাট্যমঞ্চে শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী বা নেপথ্যের শিল্পীরাই থাকেন না, দর্শকও থাকেন। দর্শক টিকিট কিনে নিতান্তই একটা সুস্থ বিনোদনের জন্য নাটক দেখতে যান। পরিবার-পরিজন নিয়ে এই ধরনের পরিস্থিতিতে তাঁরা খুব অসহায়বোধ করেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা নাট্যমঞ্চের নিরাপত্তার ব্যাপারেও সংশয় প্রকাশ করেন। এই ধরনের হামলা যদি চলতেই থাকে, তাহলে দর্শক নাট্যমঞ্চে আসতেই চাইবেন না।
মনে পড়ে যায় উদীচীর সম্মেলনে হামলার কথা। সেদিনও দর্শক এই হামলার শিকার হয়েছিলেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে আহত হয়ে এখনো তাঁদের জীবন কাটছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। কিন্তু সেদিন একটা মানসিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল দর্শকের মাঝে। অনুষ্ঠান চলেছে এবং সারা দেশে একটা তীব্র প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল। এরপরে রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখে হামলা—সেখানেও অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন, বহু মানুষ আহত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ নয়, সারা দেশে কোথাও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়নি।
এর মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন কিছুটা স্তিমিতও হয়েছে। সাম্প্রতিককালে নাটক এবং নানা ধরনের অনুষ্ঠান চারদিকে নিয়মিতভাবে হতেও পারেনি। শিল্পকলা একাডেমির একটি হলেই নাটক চলছে। দর্শকদের সরব উপস্থিতি দিন দিন বাড়ছে। এটা হচ্ছে ঢাকার অবস্থা। ঢাকার বাইরে ২২টি শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া বাঙালির জীবন অচল। যাত্রাপালা, পালাগান, লোকগান, পুঁথিপাঠ এসব আমাদের লোকশিল্প যা বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উৎসারিত এই সৃজনশীলতা বাঙালির জীবনে একটা স্বস্তিময় আবহ সৃষ্টি করে।
শতাব্দী পেরিয়ে লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমসহ অনেক মরমি শিল্পী আমাদের জীবনে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছেন। বাঙালির মানসিকতায় নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করা ছাড়াও আলোকিত করেছেন তার মানসকে। সম্প্রতি মাজার ভাঙা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে, সেটিও এ দেশের পীর-আউলিয়াদের প্রতি একধরনের হামলার প্রতীক। কিন্তু যাঁরা বিশ্বাসী, শান্তিপ্রিয় মানুষ, তাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পীর-আউলিয়াদের সম্মান করে এসেছেন। এবং এই সম্মানটির চরিত্র অসাম্প্রদায়িক। হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র) বা হজরত শাহজালাল (র)-এর দরগায় যত লোক যায়, তারা ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষেই যায়। বাংলাদেশে যত ছোট-বড় মাজার আছে সেগুলোরও বেশ বড় ধরনের ভক্তকুল আছে। এই ভক্তকুলের আবেগকে সম্পূর্ণভাবে ভাঙচুর করে দিয়েছে সাম্প্রতিক হামলাকারীরা।
শিল্পেরও কিছু ভক্তকুল থাকে এবং তাঁরা অগণিত। শিল্পের তৃষ্ণায় এই অগণিত ভক্তকুল গান শোনেন, নাটক দেখেন, সিনেমা দেখেন। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, একটা কিছু শেখার জন্য, অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার অংশ হিসেবে শিল্পকে গ্রহণ করেন। আমি এর আগে বহুবার লিখেছি শিক্ষায় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের ধস নেমেছে। সেই ধস থেকে উঠে আসার জন্য শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী শিক্ষার্থীর জন্য একটি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই সৃজনশীলতায় যাওয়ার পথে দরকার শিল্প-সাহিত্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের এবং সাধারণ মানুষের আগ্রহ প্রকাশ করা। কিন্তু কোন মনস্তত্ত্ব থেকে একটি শিল্পকর্মের ঘটনা যখন ঘটছে তখন এর ওপর হামলা করা হলো?
সম্প্রতি যারা লাইব্রেরি আর্কাইভ ও শিল্পকলা একাডেমি পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের মনস্তত্ত্বটা বোঝা বড় কঠিন। নানা কারণেই বাংলাদেশে একটি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। যারা ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণ করে মানুষের সুকুমার আকাঙ্ক্ষাগুলো ধ্বংস করতে চায়। অথচ তারা মনে রাখে না যে এই উপমহাদেশে সুফি দর্শনের মাধ্যমে একটি শান্তির বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের নানান সমস্যা থাকে। একটি প্রাত্যহিক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য, যাকে বলা যায় রুটি-রুজির সংস্কৃতি, সেই সমস্যাটাও প্রকট। আজকে দ্রব্যমূল্যের এই উল্লম্ফন মানুষকে শ্বাসরোধ করে তুলছে। সব জায়গায় আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুও তা-ই।
ধর্মীয় শাস্ত্রীরা এ কথাও বলেছেন—যদি দুটি পয়সা থাকে, একটি পয়সা দিয়ে খাবার কিনে নিও, আরেকটি পয়সা দিয়ে একটি ফুল কিনো। ফুল মানে এখানে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা যুগ-যুগান্তর ধরে মানুষের সেই কালের চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। নাটকের মতো একটি শিল্প সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। সেখানে খেয়ে না খেয়ে এই শিল্পের সেবায় বিভিন্ন বয়সের লাখ লাখ মানুষ নিবেদিত। তাঁরা সাধারণত খুব স্পর্শকাতর সমাজের অগ্রণী চিন্তার অংশীদার।
যে নাটকটি সেদিন অভিনীত হচ্ছিল সেটি একটি পুরাণের গল্প। এক হতভাগ্য একলব্যের বঞ্চনার কাহিনি। শ্রেণিবিভক্ত এবং বর্ণপ্রথাশ্রয়ী ভারতবর্ষে যুদ্ধাবস্থার যে অবস্থা তার একটি চিত্র। এই নিষ্ঠুর কাহিনি যেকোনো মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। বহুদিন ধরে নাটকটি অভিনীত হচ্ছে এবং দর্শক প্রশংসিতও হচ্ছে। সেই নাটকটি থেকে দর্শককে বঞ্চিত করা হলো। কয়েক দিনের মধ্যেই আরণ্যকের নাটক আমার নির্দেশনায় ‘কোম্পানী’ অভিনীত হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে আমাদের দেশকে লুটের সংস্কৃতি তৈরি করে গেছে তারই চিত্র এটি। লুট ও অর্থ পাচারের এক সম্যক চিত্র এই ‘কোম্পানী’। ইতিহাসকে সমসাময়িকতার বিচারের মাধ্যমে বিপুল দর্শক এই নাটকটি দেখতে আসেন। এমনই অনেক নাটক তিপ্পান্ন বছর ধরে আমাদের নাট্যমঞ্চে অভিনীত হয়ে আসছে। দর্শকের নতুন এক ভাবনা থাকবে বিশ্লেষণের পথে এবং মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। আশা করি এ দেশের নাট্যকর্মীরা এবং সংবেদনশীল দর্শক এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন এবং শিল্প তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবে। সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না রেখে বলতে চাই—শত হামলা, শত অবরোধ সৃষ্টি করেও শিল্পের অনিরুদ্ধ চাকা সামনের দিকে চলতেই থাকবে।
লেখক: মামুনুর রশীদ
নাট্যব্যক্তিত্ব
এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে আছে। সেখানে কোনো আন্দোলন-প্রতিবাদ হয় না। কিন্তু ২ নভেম্বর যা ঘটে গেল তা কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদ নয়, নয় কোনো সমাবেশ বা বিক্ষোভ। বিষয়টি ছিল একেবারেই হামলা। প্রথমে সন্ধ্যা ৬টায় টিকিট ঘরে গিয়ে কিছু ব্যক্তি টিকিট বিক্রি বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেয়। উপস্থিত নাট্যকর্মীরা সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এরপর তারা গেট ভেঙে মঞ্চে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। এবং নাটক বন্ধের জন্য হুমকি দিতে থাকে। ওই সময় দেশ নাট্যদলের নিত্যপুরাণ নাটকটি চলছিল। সেই উত্তেজিত ব্যক্তিদের কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। শিল্পকলার নিরাপত্তা বিধানের জন্য যে ব্যবস্থা ছিল সেই ব্যবস্থাটিও কোনো কাজে লাগল না। একপর্যায়ে মহাপরিচালক পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে নাটকটি বন্ধ করে দিলেন।
শিল্পকলা একাডেমি বা মহিলা সমিতিতে গত তিপ্পান্ন বছরে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। দুই-একবার কেউ কেউ চেষ্টা করলেও আমরা সম্মিলিতভাবে দাঁড়িয়ে গেলে আর কেউ সাহস পায় না। ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও হয়তো চেষ্টা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটাও সফল হয়নি। নাটক আমরা করে থাকি মানুষের জন্য। মানুষই আমাদের একমাত্র সহায়, রাষ্ট্র বা সরকার নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটা ঘটল তাতে মনে হচ্ছে, সরকারের প্রতিনিধি যখন নাটক বন্ধ করে দেন, তখন বোঝা গেল সরকারও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ।
নাটকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ১৮৭৬ সাল থেকে। তখনকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার তাদের সমালোচনা সহ্য করেনি। তারা অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের ব্যবস্থা করেছিল। এবারে নাট্যমঞ্চে হামলা তার চেয়ে দুই পায়ে এগিয়ে। ওই নাট্যদলের একজন সদস্য নাকি ফেসবুকে সাম্প্রতিক আন্দোলন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেছেন। সেই মন্তব্য ওই দিনের হামলাকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। যেকোনো মন্তব্য কারও কাছে গ্রহণযোগ্য না-ই হতে পারে। তার জন্য আইনি ব্যবস্থা আছে বা গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে যে কেউ গণতান্ত্রিক উপায়েই এর প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু নাটক বন্ধ করে দেওয়া এবং নাট্যমঞ্চে হামলা করা সমাধান যারা ভাবে, তারা কি প্রকৃতই গণতন্ত্রের মানুষ?
নাট্যমঞ্চে শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী বা নেপথ্যের শিল্পীরাই থাকেন না, দর্শকও থাকেন। দর্শক টিকিট কিনে নিতান্তই একটা সুস্থ বিনোদনের জন্য নাটক দেখতে যান। পরিবার-পরিজন নিয়ে এই ধরনের পরিস্থিতিতে তাঁরা খুব অসহায়বোধ করেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা নাট্যমঞ্চের নিরাপত্তার ব্যাপারেও সংশয় প্রকাশ করেন। এই ধরনের হামলা যদি চলতেই থাকে, তাহলে দর্শক নাট্যমঞ্চে আসতেই চাইবেন না।
মনে পড়ে যায় উদীচীর সম্মেলনে হামলার কথা। সেদিনও দর্শক এই হামলার শিকার হয়েছিলেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে আহত হয়ে এখনো তাঁদের জীবন কাটছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। কিন্তু সেদিন একটা মানসিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল দর্শকের মাঝে। অনুষ্ঠান চলেছে এবং সারা দেশে একটা তীব্র প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল। এরপরে রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখে হামলা—সেখানেও অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন, বহু মানুষ আহত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ নয়, সারা দেশে কোথাও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়নি।
এর মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন কিছুটা স্তিমিতও হয়েছে। সাম্প্রতিককালে নাটক এবং নানা ধরনের অনুষ্ঠান চারদিকে নিয়মিতভাবে হতেও পারেনি। শিল্পকলা একাডেমির একটি হলেই নাটক চলছে। দর্শকদের সরব উপস্থিতি দিন দিন বাড়ছে। এটা হচ্ছে ঢাকার অবস্থা। ঢাকার বাইরে ২২টি শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া বাঙালির জীবন অচল। যাত্রাপালা, পালাগান, লোকগান, পুঁথিপাঠ এসব আমাদের লোকশিল্প যা বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উৎসারিত এই সৃজনশীলতা বাঙালির জীবনে একটা স্বস্তিময় আবহ সৃষ্টি করে।
শতাব্দী পেরিয়ে লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমসহ অনেক মরমি শিল্পী আমাদের জীবনে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছেন। বাঙালির মানসিকতায় নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করা ছাড়াও আলোকিত করেছেন তার মানসকে। সম্প্রতি মাজার ভাঙা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে, সেটিও এ দেশের পীর-আউলিয়াদের প্রতি একধরনের হামলার প্রতীক। কিন্তু যাঁরা বিশ্বাসী, শান্তিপ্রিয় মানুষ, তাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পীর-আউলিয়াদের সম্মান করে এসেছেন। এবং এই সম্মানটির চরিত্র অসাম্প্রদায়িক। হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র) বা হজরত শাহজালাল (র)-এর দরগায় যত লোক যায়, তারা ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষেই যায়। বাংলাদেশে যত ছোট-বড় মাজার আছে সেগুলোরও বেশ বড় ধরনের ভক্তকুল আছে। এই ভক্তকুলের আবেগকে সম্পূর্ণভাবে ভাঙচুর করে দিয়েছে সাম্প্রতিক হামলাকারীরা।
শিল্পেরও কিছু ভক্তকুল থাকে এবং তাঁরা অগণিত। শিল্পের তৃষ্ণায় এই অগণিত ভক্তকুল গান শোনেন, নাটক দেখেন, সিনেমা দেখেন। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, একটা কিছু শেখার জন্য, অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার অংশ হিসেবে শিল্পকে গ্রহণ করেন। আমি এর আগে বহুবার লিখেছি শিক্ষায় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের ধস নেমেছে। সেই ধস থেকে উঠে আসার জন্য শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী শিক্ষার্থীর জন্য একটি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই সৃজনশীলতায় যাওয়ার পথে দরকার শিল্প-সাহিত্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের এবং সাধারণ মানুষের আগ্রহ প্রকাশ করা। কিন্তু কোন মনস্তত্ত্ব থেকে একটি শিল্পকর্মের ঘটনা যখন ঘটছে তখন এর ওপর হামলা করা হলো?
সম্প্রতি যারা লাইব্রেরি আর্কাইভ ও শিল্পকলা একাডেমি পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের মনস্তত্ত্বটা বোঝা বড় কঠিন। নানা কারণেই বাংলাদেশে একটি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। যারা ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণ করে মানুষের সুকুমার আকাঙ্ক্ষাগুলো ধ্বংস করতে চায়। অথচ তারা মনে রাখে না যে এই উপমহাদেশে সুফি দর্শনের মাধ্যমে একটি শান্তির বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের নানান সমস্যা থাকে। একটি প্রাত্যহিক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য, যাকে বলা যায় রুটি-রুজির সংস্কৃতি, সেই সমস্যাটাও প্রকট। আজকে দ্রব্যমূল্যের এই উল্লম্ফন মানুষকে শ্বাসরোধ করে তুলছে। সব জায়গায় আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুও তা-ই।
ধর্মীয় শাস্ত্রীরা এ কথাও বলেছেন—যদি দুটি পয়সা থাকে, একটি পয়সা দিয়ে খাবার কিনে নিও, আরেকটি পয়সা দিয়ে একটি ফুল কিনো। ফুল মানে এখানে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা যুগ-যুগান্তর ধরে মানুষের সেই কালের চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। নাটকের মতো একটি শিল্প সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। সেখানে খেয়ে না খেয়ে এই শিল্পের সেবায় বিভিন্ন বয়সের লাখ লাখ মানুষ নিবেদিত। তাঁরা সাধারণত খুব স্পর্শকাতর সমাজের অগ্রণী চিন্তার অংশীদার।
যে নাটকটি সেদিন অভিনীত হচ্ছিল সেটি একটি পুরাণের গল্প। এক হতভাগ্য একলব্যের বঞ্চনার কাহিনি। শ্রেণিবিভক্ত এবং বর্ণপ্রথাশ্রয়ী ভারতবর্ষে যুদ্ধাবস্থার যে অবস্থা তার একটি চিত্র। এই নিষ্ঠুর কাহিনি যেকোনো মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। বহুদিন ধরে নাটকটি অভিনীত হচ্ছে এবং দর্শক প্রশংসিতও হচ্ছে। সেই নাটকটি থেকে দর্শককে বঞ্চিত করা হলো। কয়েক দিনের মধ্যেই আরণ্যকের নাটক আমার নির্দেশনায় ‘কোম্পানী’ অভিনীত হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে আমাদের দেশকে লুটের সংস্কৃতি তৈরি করে গেছে তারই চিত্র এটি। লুট ও অর্থ পাচারের এক সম্যক চিত্র এই ‘কোম্পানী’। ইতিহাসকে সমসাময়িকতার বিচারের মাধ্যমে বিপুল দর্শক এই নাটকটি দেখতে আসেন। এমনই অনেক নাটক তিপ্পান্ন বছর ধরে আমাদের নাট্যমঞ্চে অভিনীত হয়ে আসছে। দর্শকের নতুন এক ভাবনা থাকবে বিশ্লেষণের পথে এবং মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। আশা করি এ দেশের নাট্যকর্মীরা এবং সংবেদনশীল দর্শক এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন এবং শিল্প তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবে। সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না রেখে বলতে চাই—শত হামলা, শত অবরোধ সৃষ্টি করেও শিল্পের অনিরুদ্ধ চাকা সামনের দিকে চলতেই থাকবে।
লেখক: মামুনুর রশীদ
নাট্যব্যক্তিত্ব
স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে দল বা জোট এসেছে, তারা কেউই জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নেয়নি। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যন্ত এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা জনগণের শাসক ও শোষকে পরিণত হয়েছেন। নতুন
৫ ঘণ্টা আগেবৈষম্যবিরোধী সফল ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারেরও তিন মাস পূর্ণ হলো। এ কথা ঠিক, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ছিল মূলত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ। তবে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, এটা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফল। তাঁরা বলার চেষ্টা করেন, আন্দো
৫ ঘণ্টা আগেআবদুল বারেক সরকার ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের একজন পিয়ন ছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালে অবসরে গিয়েও এই অফিসের কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন ৫ আগস্ট পর্যন্ত। তিনি হয়েছেন ২০০ কোটি টাকার মালিক! কীভাবে হলেন? তিনি কি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন?
৫ ঘণ্টা আগেপর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
৯ দিন আগে