আজকের পত্রিকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিন ধরেই খুব অস্বাভাবিক অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় কোনো নির্বাচন ভালোভাবে হতে পারে না। বিদেশি নানা শক্তিকে আমাদের রাজনীতিতে টেনে আনা হয়। তারা এখানে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আসে।
এখন যে রাজনীতির ধারা চলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ভালো-মন্দ মিলিয়ে আওয়ামী লীগই বেশি শক্তিশালী এবং আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকবে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি খুব দুর্বল অবস্থায় চলে গেছে। জাতীয় পার্টির অন্তর্বিরোধ দলের ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কা তৈরি করছে। আর বিএনপি যে নেতৃত্ব দ্বারা চলছে, মানে তারেক রহমানের নেতৃত্বে, তাতে সাধারণ জনগণ তাঁকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুপযোগী মনে করে।
এগুলো থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি গুণগত মানের দিকে না গিয়ে এক খারাপ থেকে নতুন আরেক খারাপের দিকে যাচ্ছে।আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। যদি দলটি কোনো নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে দেশকে জনগণের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করে, তাহলে ভালো করবে। বিএনপি যদি নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তাদেরও সম্ভাবনা আছে। আর বামপন্থী ধারার উন্নতির তো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ভালোর সম্ভাবনা একেবারেই কম দেখা যাচ্ছে।
আমাদের জাতীয়, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার কারণে কোনো দলই সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে না। বাইরের নানা শক্তির চাপ সরকার ও বিরোধী দল সহ্য করে যাচ্ছে। সার্বিক অবস্থার উন্নতির কথা কেউ ভাবছে না।
আজকের পত্রিকা: এরশাদের পতনের পর দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরেছিল। আমরা সেই ধারা ধরে রাখতে পারলাম না কেন?
ফজলুল হক: জেনারেল এরশাদ তো চরম রাজনৈতিক দুর্বল অবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর ক্ষমতায় আসার জন্য কোনো কোনো শক্তি কাজ করেছিল। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ, যিনি বামপন্থী ধারার লোক ছিলেন এবং একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে সব অবস্থায় পজিটিভ ভূমিকা পালন করেছেন। এরশাদের ক্ষমতায় আসার আগে দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক দুর্যোগ চলছিল, সেই অবস্থায় তিনি এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে একটা লিখিত বক্তব্য দিয়ে বলেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নিয়ে আপনি ক্ষমতায় এলে সমর্থন পাবেন। আর এরশাদের আসার পেছনে আওয়ামী লীগেরও কিছু ভূমিকা ছিল। তাদের এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এসব বিষয়ে সেই সময়ের পত্রিকায় নিউজ ছাপা হয়েছিল।
কিন্তু এরশাদের মতো একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতি রাজনীতিতে আসতে চান—এ কথাটি সম্পূর্ণ ঠিক না। তবে এর মধ্যে আংশিক সত্য আছে। বাকি আংশিক সত্য হলো, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিহীনতা, আদর্শহীনতা ও কর্মসূচিহীনতার ব্যাপারগুলো ছিল।অনেক আগে থেকে আমাদের রাজনীতি পচে গেছে। এই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তো ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’র বাইরে অন্য কোনো বক্তব্য প্রায় ছিল না। এসব দাবির পেছনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছিল। এর সঙ্গে বামপন্থী দলগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছিল। এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী দলগুলো জনগণের কাছে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। অবৈধ সরকার ক্ষমতা দখল করে আছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে—এর বাইরে তেমন কোনো বক্তব্য ছিল না। জাতি ও রাষ্ট্র গঠন, জনজীবনের সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো বক্তব্য ছিল না। রাজনীতির মধ্যে রাজনীতি নেই; মানে তাদের মধ্যে জাতি ও রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কোনো ধরনের চিন্তা-ভাবনা ছিল না। সেই সময়ে কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলার চেষ্টা করেছিলেন, বাংলাদেশে একটা বিরাজনীতিকরণ নীতি কার্যকর করা হচ্ছে। এতে দল ও ক্ষমতার লড়াই থাকবে, কিন্তু রাজনীতি থাকবে না।
আশির দশকে নীরাজনীতিকরণ, বিরাজনীতিকরণ এসব শব্দ বেশি ব্যবহৃত হতো। সেই সময়েই আমরা অনুভব করেছি কোন শক্তি, যার পরিচয় আমরা বুঝতে পারি না—এ রকম পশ্চিমা কোনো বৃহৎ শক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্বল রাষ্ট্রের রাজনীতিকে শেষ করে দেওয়ার একটা চেষ্টা জারি ছিল। বাংলাদেশ সেই ধারায় পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি—এ দুটি দল জাতি, রাষ্ট্র গড়ে তোলার কোনো লক্ষ্য নিয়ে সেই সময়ে রাজনীতি করেনি। নেতারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। তাঁরা যে বৈধ উপায়ে সম্পত্তি করেছেন, সেটাও বলা যাবে না। সেই ধারা এখনো চলমান। এরপর এরশাদের পতনের পরে নতুন করে কোনো কিছু গড়ে তোলার রাজনীতি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে বিকশিত হয়নি।
যে নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ এত দিন ক্ষমতায় আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে নেতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির মধ্যেও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো নেতা নেই। জাতীয় পার্টি চলছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তাই কোনো একটি রাজনৈতিক ধারা ভালোর দিকে যাবে, এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো ভেতর থেকে গড়ে উঠুক। নতুন বক্তব্য নিয়ে প্রতিটি দল নবায়িত হয়ে নতুন জীবন লাভ করুক। তবে বাস্তবে এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে তাদের আদর্শের বিচ্যুতি ঘটার কারণ কী?
ফজলুল হক: রাজনৈতিক দলগুলো ৫২ বছর ধরে যেভাবে কাজ করছে, এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার লড়াই ছাড়া রাজনীতি নেই। যদি থাকে তা এত সামান্য যে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এরশাদ সেই সময় বলেছিলেন, আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাই, কিন্তু কাদের হাতে এবং কীভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেব! যে তিনটি জোট আন্দোলন করছে, তারা জানালে আমি সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এই তিন জোটের রূপরেখায় কিছু ভালো বক্তব্য ছিল। কিন্তু সেই বক্তব্য তো আওয়ামী লীগ, বিএনপি মনেই রাখেনি। সেই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল শুধু এরশাদ সরকারকে উৎখাত করার জন্যই। গোটা দেশ ও জনগণের উপযোগী রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ছিল না। আর বাম দলগুলো তো অনেক আগে থেকে নিজেদের দুর্বলতা থেকে অগ্রসর হতে পারেনি। একটু খারাপ থেকে আরেকটু খারাপ—সেভাবেই চলছে।
বাংলাদেশের নিজস্ব খনিজ সম্পদ আছে, ফসল অনেক ভালো হয়, শ্রমিকেরাও পরিশ্রমী—একটু ন্যায়পরায়ণ সরকার যদি আমরা পেতাম, তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই মাত্র বিশ বছরের মধ্যে অনেক উন্নতির রেকর্ড দেখাতে পারত।
উন্নতি শুধু অবকাঠামোগত হলে তো হবে না। আমাদের শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকা অপরিহার্য। সেই কর্মসূচি দিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্তব্য।সবাই গণতন্ত্রের কথা বলছে, কিন্তু কোনো দলই তো কার্যকরভাবে চিন্তা এবং কাজ করছে না।
আওয়ামী লীগ পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবে—এ রকমটা বলা যায় না। পরিবারতান্ত্রিক এবং উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজনীতি সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিরোধী। এগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই পাশ্চাত্যের দেশগুলোর গণতন্ত্রের আইডিয়া ও চিন্তাগুলো আসে। এরপর এশিয়া, আফ্রিকাসহ সর্বত্র বিস্তৃত হয়। তবে অন্য দেশে আধিপত্য বিস্তার করার রাজনীতি আমেরিকার মধ্যে পুরো মাত্রায় আছে।
আমরা রাজনীতির চিন্তা হারিয়ে ফেলেছি। আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের কথা কেউ চিন্তা করে না। রাজনৈতিক দলগুলো কী যে চায়, তা ভাবলে মন বিষণ্ন হয়ে যায়। এখন রাজনীতি করা মানে টাকাপয়সা আয় করার ধান্দা ছাড়া কিছু নয়। এমপি-মন্ত্রীদের আইনগতভাবে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা আছে—এটা অনেক টাকা আয়ের একটা উৎস। এর বাইরে তাঁদের অন্য ব্যবসাও আছে।এখন কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের সংযম, শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়—এ রকম চিন্তা ও চেষ্টা তাদের মধ্যে নেই। বুদ্ধিজীবী বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা যে ধারায় চিন্তা করছেন, এতে প্রচলিত রাজনীতিকেই পুষ্ট করা হচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: বিএনপির রাজনৈতিক কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি?
ফজলুল হক: বিএনপি সেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা থেকে ক্ষমতার বাইরে। তারা তো এ সময়ের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। আওয়ামী লীগ অনেক দিন থেকে ক্ষমতায় আছে, আর তাদের ক্ষমতায় থাকা উচিত না—এ রকম বক্তব্য নিয়ে তারা এগোচ্ছে। এই বক্তব্য দিয়ে কি তারা সফল হতে পারে? খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান মামলা-মোকদ্দমায় পড়ে আছেন। তাঁদের অনেক নেতা জেলে আছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তিই তো বিএনপির এখন প্রধান দাবি। বিএনপির জনসমর্থন পেতে হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে।
আজকের পত্রিকা: এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
ফজলুল হক: আমাদের রাজনীতিতে ভালো চিন্তা, ভালো কাজের দিকে যাওয়ার যেটুকু চর্চা ছিল, একটু একটু করে সেই চর্চা না করে ভুল পথে ক্রমাগত চলতে চলতে এখন রাজনীতির নতুন ধারা সৃষ্টি করার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। নতুন বক্তব্য নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের নতুন ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তারা নিজেরাই শেষ করে দিয়েছে। আর আমাদের দেশে রাজনৈতিক দুর্বলতা অনেক আগে থেকেই আছে। এখন এসব দুর্বলতা জেনে নতুনভাবে রাজনীতি শুরু করা দরকার। সেটাই আমি কামনা করি।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফজলুল হক: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিন ধরেই খুব অস্বাভাবিক অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় কোনো নির্বাচন ভালোভাবে হতে পারে না। বিদেশি নানা শক্তিকে আমাদের রাজনীতিতে টেনে আনা হয়। তারা এখানে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আসে।
এখন যে রাজনীতির ধারা চলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ভালো-মন্দ মিলিয়ে আওয়ামী লীগই বেশি শক্তিশালী এবং আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকবে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি খুব দুর্বল অবস্থায় চলে গেছে। জাতীয় পার্টির অন্তর্বিরোধ দলের ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কা তৈরি করছে। আর বিএনপি যে নেতৃত্ব দ্বারা চলছে, মানে তারেক রহমানের নেতৃত্বে, তাতে সাধারণ জনগণ তাঁকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুপযোগী মনে করে।
এগুলো থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি গুণগত মানের দিকে না গিয়ে এক খারাপ থেকে নতুন আরেক খারাপের দিকে যাচ্ছে।আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। যদি দলটি কোনো নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে দেশকে জনগণের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করে, তাহলে ভালো করবে। বিএনপি যদি নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তাদেরও সম্ভাবনা আছে। আর বামপন্থী ধারার উন্নতির তো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ভালোর সম্ভাবনা একেবারেই কম দেখা যাচ্ছে।
আমাদের জাতীয়, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার কারণে কোনো দলই সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে না। বাইরের নানা শক্তির চাপ সরকার ও বিরোধী দল সহ্য করে যাচ্ছে। সার্বিক অবস্থার উন্নতির কথা কেউ ভাবছে না।
আজকের পত্রিকা: এরশাদের পতনের পর দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরেছিল। আমরা সেই ধারা ধরে রাখতে পারলাম না কেন?
ফজলুল হক: জেনারেল এরশাদ তো চরম রাজনৈতিক দুর্বল অবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর ক্ষমতায় আসার জন্য কোনো কোনো শক্তি কাজ করেছিল। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ, যিনি বামপন্থী ধারার লোক ছিলেন এবং একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে সব অবস্থায় পজিটিভ ভূমিকা পালন করেছেন। এরশাদের ক্ষমতায় আসার আগে দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক দুর্যোগ চলছিল, সেই অবস্থায় তিনি এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে একটা লিখিত বক্তব্য দিয়ে বলেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নিয়ে আপনি ক্ষমতায় এলে সমর্থন পাবেন। আর এরশাদের আসার পেছনে আওয়ামী লীগেরও কিছু ভূমিকা ছিল। তাদের এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এসব বিষয়ে সেই সময়ের পত্রিকায় নিউজ ছাপা হয়েছিল।
কিন্তু এরশাদের মতো একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতি রাজনীতিতে আসতে চান—এ কথাটি সম্পূর্ণ ঠিক না। তবে এর মধ্যে আংশিক সত্য আছে। বাকি আংশিক সত্য হলো, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিহীনতা, আদর্শহীনতা ও কর্মসূচিহীনতার ব্যাপারগুলো ছিল।অনেক আগে থেকে আমাদের রাজনীতি পচে গেছে। এই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তো ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’র বাইরে অন্য কোনো বক্তব্য প্রায় ছিল না। এসব দাবির পেছনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছিল। এর সঙ্গে বামপন্থী দলগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছিল। এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী দলগুলো জনগণের কাছে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। অবৈধ সরকার ক্ষমতা দখল করে আছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে—এর বাইরে তেমন কোনো বক্তব্য ছিল না। জাতি ও রাষ্ট্র গঠন, জনজীবনের সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো বক্তব্য ছিল না। রাজনীতির মধ্যে রাজনীতি নেই; মানে তাদের মধ্যে জাতি ও রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কোনো ধরনের চিন্তা-ভাবনা ছিল না। সেই সময়ে কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলার চেষ্টা করেছিলেন, বাংলাদেশে একটা বিরাজনীতিকরণ নীতি কার্যকর করা হচ্ছে। এতে দল ও ক্ষমতার লড়াই থাকবে, কিন্তু রাজনীতি থাকবে না।
আশির দশকে নীরাজনীতিকরণ, বিরাজনীতিকরণ এসব শব্দ বেশি ব্যবহৃত হতো। সেই সময়েই আমরা অনুভব করেছি কোন শক্তি, যার পরিচয় আমরা বুঝতে পারি না—এ রকম পশ্চিমা কোনো বৃহৎ শক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্বল রাষ্ট্রের রাজনীতিকে শেষ করে দেওয়ার একটা চেষ্টা জারি ছিল। বাংলাদেশ সেই ধারায় পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি—এ দুটি দল জাতি, রাষ্ট্র গড়ে তোলার কোনো লক্ষ্য নিয়ে সেই সময়ে রাজনীতি করেনি। নেতারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। তাঁরা যে বৈধ উপায়ে সম্পত্তি করেছেন, সেটাও বলা যাবে না। সেই ধারা এখনো চলমান। এরপর এরশাদের পতনের পরে নতুন করে কোনো কিছু গড়ে তোলার রাজনীতি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে বিকশিত হয়নি।
যে নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ এত দিন ক্ষমতায় আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে নেতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির মধ্যেও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো নেতা নেই। জাতীয় পার্টি চলছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তাই কোনো একটি রাজনৈতিক ধারা ভালোর দিকে যাবে, এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলো ভেতর থেকে গড়ে উঠুক। নতুন বক্তব্য নিয়ে প্রতিটি দল নবায়িত হয়ে নতুন জীবন লাভ করুক। তবে বাস্তবে এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে তাদের আদর্শের বিচ্যুতি ঘটার কারণ কী?
ফজলুল হক: রাজনৈতিক দলগুলো ৫২ বছর ধরে যেভাবে কাজ করছে, এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার লড়াই ছাড়া রাজনীতি নেই। যদি থাকে তা এত সামান্য যে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এরশাদ সেই সময় বলেছিলেন, আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাই, কিন্তু কাদের হাতে এবং কীভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেব! যে তিনটি জোট আন্দোলন করছে, তারা জানালে আমি সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এই তিন জোটের রূপরেখায় কিছু ভালো বক্তব্য ছিল। কিন্তু সেই বক্তব্য তো আওয়ামী লীগ, বিএনপি মনেই রাখেনি। সেই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল শুধু এরশাদ সরকারকে উৎখাত করার জন্যই। গোটা দেশ ও জনগণের উপযোগী রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ছিল না। আর বাম দলগুলো তো অনেক আগে থেকে নিজেদের দুর্বলতা থেকে অগ্রসর হতে পারেনি। একটু খারাপ থেকে আরেকটু খারাপ—সেভাবেই চলছে।
বাংলাদেশের নিজস্ব খনিজ সম্পদ আছে, ফসল অনেক ভালো হয়, শ্রমিকেরাও পরিশ্রমী—একটু ন্যায়পরায়ণ সরকার যদি আমরা পেতাম, তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই মাত্র বিশ বছরের মধ্যে অনেক উন্নতির রেকর্ড দেখাতে পারত।
উন্নতি শুধু অবকাঠামোগত হলে তো হবে না। আমাদের শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকা অপরিহার্য। সেই কর্মসূচি দিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্তব্য।সবাই গণতন্ত্রের কথা বলছে, কিন্তু কোনো দলই তো কার্যকরভাবে চিন্তা এবং কাজ করছে না।
আওয়ামী লীগ পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবে—এ রকমটা বলা যায় না। পরিবারতান্ত্রিক এবং উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজনীতি সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিরোধী। এগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই পাশ্চাত্যের দেশগুলোর গণতন্ত্রের আইডিয়া ও চিন্তাগুলো আসে। এরপর এশিয়া, আফ্রিকাসহ সর্বত্র বিস্তৃত হয়। তবে অন্য দেশে আধিপত্য বিস্তার করার রাজনীতি আমেরিকার মধ্যে পুরো মাত্রায় আছে।
আমরা রাজনীতির চিন্তা হারিয়ে ফেলেছি। আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের কথা কেউ চিন্তা করে না। রাজনৈতিক দলগুলো কী যে চায়, তা ভাবলে মন বিষণ্ন হয়ে যায়। এখন রাজনীতি করা মানে টাকাপয়সা আয় করার ধান্দা ছাড়া কিছু নয়। এমপি-মন্ত্রীদের আইনগতভাবে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা আছে—এটা অনেক টাকা আয়ের একটা উৎস। এর বাইরে তাঁদের অন্য ব্যবসাও আছে।এখন কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের সংযম, শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়—এ রকম চিন্তা ও চেষ্টা তাদের মধ্যে নেই। বুদ্ধিজীবী বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা যে ধারায় চিন্তা করছেন, এতে প্রচলিত রাজনীতিকেই পুষ্ট করা হচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: বিএনপির রাজনৈতিক কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি?
ফজলুল হক: বিএনপি সেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা থেকে ক্ষমতার বাইরে। তারা তো এ সময়ের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। আওয়ামী লীগ অনেক দিন থেকে ক্ষমতায় আছে, আর তাদের ক্ষমতায় থাকা উচিত না—এ রকম বক্তব্য নিয়ে তারা এগোচ্ছে। এই বক্তব্য দিয়ে কি তারা সফল হতে পারে? খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান মামলা-মোকদ্দমায় পড়ে আছেন। তাঁদের অনেক নেতা জেলে আছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তিই তো বিএনপির এখন প্রধান দাবি। বিএনপির জনসমর্থন পেতে হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে।
আজকের পত্রিকা: এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
ফজলুল হক: আমাদের রাজনীতিতে ভালো চিন্তা, ভালো কাজের দিকে যাওয়ার যেটুকু চর্চা ছিল, একটু একটু করে সেই চর্চা না করে ভুল পথে ক্রমাগত চলতে চলতে এখন রাজনীতির নতুন ধারা সৃষ্টি করার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। নতুন বক্তব্য নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের নতুন ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তারা নিজেরাই শেষ করে দিয়েছে। আর আমাদের দেশে রাজনৈতিক দুর্বলতা অনেক আগে থেকেই আছে। এখন এসব দুর্বলতা জেনে নতুনভাবে রাজনীতি শুরু করা দরকার। সেটাই আমি কামনা করি।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফজলুল হক: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৯ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে