জেলেপল্লিতে শুধুই হাহাকার

ফরিদ খান মিন্টু, শরণখোলা (বাগেরহাট)
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২২, ০৬: ৩০
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১২: ২০

বাগেরহাটের শরণখোলার মৎস্য আড়ত ও জেলেপল্লিতে চলছে হাহাকার। কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন গভীর সমুদ্রে ইলিশ আহরণকারী ট্রলার মালিক ও মহাজনেরা। গত কয়েক বছরে প্রায় অর্ধশত ট্রলারমালিক ও ব্যবসায়ী ঋণের চাপ ও লোকসানে পড়ে দেউলিয়া হয়েছেন।

এ ছাড়া জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন করে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ইলিশ খাতে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক জেলে তাঁদের ট্রলার সাগরে পাঠাতে পারছেন না। কেউ কেউ কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন জাল, ট্রলার ও শেষ সম্বল বসতভিটাও। ঋণের চাপ সইতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চিত্র।

কথা হয় মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতা ও ক্ষতিগ্রস্ত এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। এদের মধ্যে উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী হেমায়েত খাঁ বলেন, প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে নিজেদের ট্রলারে সাগরে ইলিশ আহরণ করে আসছিলেন তিনি। প্রথম দিকে ভালো মাছ পাওয়ায় ব্যবসাও হয় রমরমা। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে মৌসুমের শুরু থেকেই কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনার প্রভাব আর মৌসুমের অর্ধেক সময় নিষেধাজ্ঞা চলায় ব্যবসায় ধস নামতে থাকে। একপর্যায়ে মহাজন ও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার ও সুদে ঋণগ্রস্ত হয়ে যান প্রায় ৩০ লাখ টাকা। শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে অল্প দামে জাল-ট্রলার বিক্রি করে কিছু দেনা শোধ করেন।

একই গ্রামের আলামিন ঘরামির ছেলে আরিফুল ইসলাম জানান, দেনার চাপে তাঁর বাবা দুই মাস ধরে নিখোঁজ। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না তাঁকে। ব্যবসা না থাকায় এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে তাদের পরিবারের।

খোন্তাকাটা ইউনিয়নের মধ্য খোন্তাকাটা গ্রামের একসময়ের প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক মোল্লা জানান, কয়েক বছর ধরে ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০ লাখ টাকায় তার বসতবাড়ি বিক্রি করে ব্যাংকের ১৮ লাখ টাকা ঋণ শোধ করেছেন। এখনো প্রায় ৪০ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। তাঁর এফবি হাসিনা-সামাদ নামের ফিশিং ট্রলারটি এখন ঘাটে পড়ে আছে। অর্থের অভাবে এ বছর সাগরে যেতে পারেননি তিনি।

রায়েন্দা বলেশ্বর নদের পারের বাসিন্দা সবুজ খলিফা জানান, গত দুই বছরে ৫০-৬০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে এখন পুঁজির সংকটে রয়েছেন। তার মধ্যে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাগরে যেতে না পারায় তাঁর ৬০ লাখ টাকা দামের ট্রলারটি ঘাটে বসেই শেষ হয়ে যাওয়ার পথে।

একই এলাকার রসু ঘরামি জানান, গত বছর বন্যায় তাঁর ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে প্রায় ১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয় তাঁর। ট্রলার না থাকায় ইলিশের ব্যবসাও বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কদমতলা গ্রামের আমিনুর হাওলাদার ৩০ লাখ টাকা এবং ইউনুচ হাওলাদার ১৫ লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

রাজেশ্বর গ্রামের রফিকুল মিয়া দেনার চাপে তাঁর ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ট্রলারটি বিক্রি করেছেন মাত্র ৪ লাখ টাকায়। এ ছাড়া সোবাহান মৃধা, রহমান মৃধা, আবু মৃধা, কামাল মৃধা টাকার অভাবে এখনো ট্রলার খুলতে পারেননি।

শরণখোলার একসময়ের প্রসিদ্ধ মৎস্য ব্যবসায়ী ও আট ভাই ফিশের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার দেনায় পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তিনি জানান, এ বছর তাঁর দুটি ট্রলারের একটিও সাগরে পাঠাতে পারেননি।

শরণখোলার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার মো. কবির হাওলাদার জানান, ছয়টি ট্রলারের মধ্যে এ বছর মাত্র দুটি ট্রলার সাগরে পাঠিয়েছেন। টাকার অভাবে অন্যগুলো পাঠাতে পারেননি। একেকটি ট্রলার সাগরে পাঠাতে তিন-চার লাখ টাকা পুঁজি খাটাতে হয়। কিন্তু তিন ট্রিপে দুই ট্রলারে মাছ বিক্রি করে তেলের দামও ওঠেনি। এভাবে প্রত্যেক ট্রলারমালিক ও মহাজন লোকসানে রয়েছেন।

বাংলাদেশ ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও শরণখোলার বিশিষ্ট মৎস্য ব্যবসায়ী এম সাইফুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘গত বছর আমার প্রায় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এবার ধারদেনা করে দুটি ট্রলার সাগরে পাঠিয়ে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাইনি। তা ছাড়া, জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।’

শরণখোলা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার ফলে ইলিশসহ সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত পাঁচ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী শরণখোলার জেলেদের মাধ্যমে ইলিশ আহরণের হার অনেকটাই বেড়েছে। তবে সাগরের সবখানে ইলিশের সমান প্রাচুর্য না থাকায় সব ট্রলারে সমান ইলিশ ধরা পড়ে না। ফলে অনেক মহাজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত