সম্পদের হিসাব দিতে অনীহা আমলাদের, আইনে চান ছাড়

উবায়দুল্লাহ বাদল ও এস এম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ১১: ৫৪
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৪, ১৮: ১৪

সরকারি চাকুরেদের প্রতি পাঁচ বছর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। বিদ্যমান ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এ এমনটাই বলা আছে। কিন্তু আইনের এই নির্দেশনা মানছেন না সরকারি চাকুরেরা। প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অনেকে চাকরিরত অবস্থায় সম্পদের পাহাড় গড়লেও তার কোনো হিসাব নেই সরকারি দপ্তরে। এতে বেড়েছে দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ে সম্পদ গড়ার প্রবণতা।

সম্প্রতি ছেলের ছাগল-কাণ্ডে ফাঁস হয়েছে শুল্ক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য। এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। উচ্চপদস্থ আরেক কর্মকর্তা এনবিআরের প্রথম সচিব আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি আবার সামনে উঠে এসেছে।

গত ২০ জুন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বার্ষিক হিসাব বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলে দুর্নীতি কমবে। আমলাদের একটি অংশ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে এবং তাতে জনগণের হয়রানি বাড়ছে।’

বিদ্যমান ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবেন। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি এবং ৫০ হাজার টাকা বা ততধিক মূল্যের অলঙ্কারাদিসহ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেবেন।’ কিন্তু ৪৫ বছর আগের আইনটি মানছেন না অধিকাংশ সরকারি চাকরিজীবী।

আইনটি কার্যকর করতে ২০২২ সালের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎকালীন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাবের বিবরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯ হালনাগাদ করা হচ্ছে।’ 

প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর উল্টো সম্পদের হিসাবে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ২০২২ এর খসড়া চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, যাঁরা নিয়মিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, তাঁদের আলাদাভাবে কোনো সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে না। সরকার প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর এনবিআরে দাখিল করা সম্পত্তির হিসাব বিবরণী সংগ্রহ করবে। সম্পদের হিসাব না দিতেই আমলারা এ বিধান সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ২০২২ এর খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, প্রশাসনবিষয়ক বহু গ্রন্থের প্রণেতা ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আয়কর রিটার্নের পাশাপাশি প্রতিবছর সরকারি কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব দিয়ে থাকেন। ভারতে শুধু সম্পদের হিসাব প্রদান তদারকির জন্য একজন উপসচিবের নেতৃত্বে একটি সেল কাজ করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আয়কর রিটার্ন ও সম্পদের হিসাব প্রদান এক নয়। কালোটাকা সাদা করা ও আয়করের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা এনবিআরের কাজ।

আর সম্পদের হিসাব অন্য জিনিস। কীভাবে, কোন উৎস থেকে সম্পদ বাড়ল, তার তদারক করা এনবিআরের কাজ নয়। সুতরাং দুটি দুই জিনিস, উদ্দেশ্যও আলাদা।’ 

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় দুর্নীতি বন্ধে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এগুলোর মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধে কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টিও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পর সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয়ে ২০২১ সালের ২৪ জুন চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এতে সাড়া দেননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর ২০২২ সালের মার্চে আবার তাগিদ দিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারপরও সাড়া মেলেনি। উল্টো দিন দিন বাড়ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা।

সরকারি চাকুরেদের দুর্নীতির বিষয়ে গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। তারপরও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে? তাই সরকারি কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতিতে না জড়ান, সে জন্য আইন আরও কঠোর করতে পরামর্শ দেন হানিফ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে ঢোকার সময় সম্পদের হিসাব দেওয়া এবং প্রতিবছর সেটা হালনাগাদ করার কথা। আমাদের দেশে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি-প্রতারণা, অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিকানা—এসবের অন্যতম কারণ হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ নেই। এখন যেসব বিধিমালা আছে, সেসব মানা হয় না। যারা করে না, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয় না। সে কারণে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি হচ্ছে। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত