বাড়তি করের খড়্গে তলানিতে জমির নিবন্ধন

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৩, ১০: ২০
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৩, ২১: ০৫

জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে উৎসে কর বাড়িয়ে দ্বিগুণ করায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে। অনেক ক্রেতা জমি ও ফ্ল্যাটের টাকা জোগাড় করলেও নিবন্ধনের টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ জমি কেনার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছেন। এতে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়গুলোতে জমির দলিল নিবন্ধন অনেক কমে গেছে। আগে একেকটি সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে দিনে ৭০ থেকে ১০০টি দলিল নিবন্ধন হলেও এখন হচ্ছে ১০-১৫টি। ফলে সরকারের রাজস্ব কমার পাশাপাশি দলিল লেখক ও স্ট্যাম্প বিক্রেতাদের আয়ও কমেছে। গত কয়েক দিন ঢাকার তেজগাঁও রেজিস্ট্রি অফিস, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জসহ কয়েকটি সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় ঘুরে কর্মকর্তা, দলিল লেখক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এমনিতেই আবাসন খাতে খারাপ অবস্থা চলছিল। বাড়তি করের বোঝায় পরিস্থিতি শোচনীয় হবে। ঢাকা ডেভেলপারস এন্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপের (ডি,ডি, রেগ) মহাসচিব মোঃ সামির উল্লাহ বাবুল বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আবাসন খাতে আগেই কাস্টমার ছিল না, এখন অবস্থা আরও খারাপ।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ পূর্ব সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার সোহরাব হোসেন শিকদার বলেন, এক কাঠা জমির মূল্যের ওপর আগে উৎসে কর ছিল ৪ শতাংশ, এখন তা ৮ শতাংশ। এই কর বাড়ায় দলিল নিবন্ধন কমে গেছে। আগে মাসে গড়ে ৩৩ কোটি টাকা রাজস্ব আসত দলিল নিবন্ধন থেকে। এ মাসে দুই কোটি আসবে কি না, সন্দেহ। এ ছাড়া নতুন আইনে ঢাকার কিছু এলাকার সঙ্গে ঢালাওভাবে নারায়ণগঞ্জের নাম দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে নতুন করহার নির্ধারণ করে গত ২৬ জুন উৎসে কর বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করেছে। বিধিমালা অনুযায়ী, দেশের যেকোনো এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা হস্তান্তরে এলাকাভেদে ২৪ গুণ বা কোথাও আরও বেশি কর দিতে হবে। জমি, ফ্ল্যাট বা যেকোনো স্থাপনা নিবন্ধনের জন্য শুধু উৎসে কর হিসেবে কাঠাপ্রতি ৬০ হাজার থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। আগে এর পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা। বিধিমালায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি নিবন্ধন কর ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকাসহ জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভায় এই কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যান্য পৌরসভায় কর ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ এবং বাকি এলাকাগুলোতে ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, উৎসে কর বাড়ানোর প্রভাব পড়বে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর বেশি। জমি কেনা তাঁদের সামর্থ্যে হয়তো কুলাবে না।

জমি কেনাই স্থগিত
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ (পূর্ব) সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের সামনে মঙ্গলবার কথা হয় সবজি ব্যবসায়ী জালাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, জমানো ১৭ লাখ টাকা দিয়ে রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে ১২ শতক জমি কেনার জন্য সব ঠিক করে নিবন্ধন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। কারণ, জমি নিবন্ধনের জন্য তাঁর বাড়তি ৮০ হাজার টাকা লাগবে। এই টাকা জোগাড় করা তাঁর জন্য সময়সাপেক্ষ।
রূপগঞ্জের দলিল লেখক কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি শাহিনুজ্জামান জানান, তাঁর এক গ্রাহক ভুলতা ইউনিয়নে ৯৫ লাখ ৮৩ হাজার টাকা দিয়ে জমি কেনার বায়না করেছেন। নিবন্ধনের জন্য দলিল প্রস্তুতও করা হয়েছে। এখন নিবন্ধনের কর আগের চেয়ে চার লাখ টাকা বেশি লাগবে। তাই জমি কেনা তিনি স্থগিত রেখেছেন। দলিল লেখক মহসিন বলেন, আগে ভ্যাট-ট্যাক্স মিলিয়ে জমির মূল্যের সাড়ে ৯ শতাংশ জমা দিতে হতো। এখন উৎসে কর বাড়ায় দিতে হচ্ছে সাড়ে ১৩ শতাংশ।

খুলনা জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে মো. সাগর নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি জমি কেনার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু উৎসে কর বাড়ায় আপাতত কিনছেন না। সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, গত মাসে ২৩৫টি জমির নিবন্ধন হয়েছিল। চলতি মাসের ১২ দিনে মাত্র ৩০টি হয়েছে।

রেজিস্ট্রি অফিসে ভিড় কমে গেছে
বাড্ডা, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ ঢাকার ১০টি থানার দলিল নিবন্ধন করা হয় তেজগাঁও রেজিস্ট্রি অফিসে। প্রায় তিন হাজার দলিল লেখক কাজ করেন। গত বুধবার দুই ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে আগের মতো কর্মব্যস্ততা দেখা যায়নি। স্ট্যাম্প ভেন্ডার আবুল খায়ের জানান, অন্য সময় দলিল লেখকদের কক্ষগুলোতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকত না। এখন সব কক্ষই ফাঁকা। তাঁর কাছে থাকা স্ট্যাম্প, নোটিশ, নীল কাগজ বিক্রি হতো দিনে ৫০ হাজার টাকার। গত কয়েক দিন জমি বিক্রি অনেক কমে যাওয়ায় ভেন্ডারদের কাছে থাকা নিবন্ধন-সম্পর্কিত

সরঞ্জাম বিক্রিও কমে গেছে। বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক যোবায়ের আহমেদ বলেন, সরকার কর বাড়িয়েছে। মানুষ জমি কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। দলিল লেখকদের বলার কিছু নেই।

জানা গেছে, সাভার ও কেরানীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়েও দলিল নিবন্ধন অনেক কমেছে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার মো. শাহাজাহান আলী অবশ্য বলেন, ঈদের পর দলিল নিবন্ধন কমেছে ঠিকই। তবে কর বাড়ার প্রভাব কতটা, তা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

চট্টগ্রাম নগরীতে আগে প্রতিদিন শতাধিক দলিল নিবন্ধন হতো, এখন হচ্ছে তিন-চারটি।  

অর্থ পাচার বাড়ার শঙ্কা
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এবং বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) দেশের স্বার্থে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে কর কমানোর দাবি জানিয়েছে। বিএলডিএ বলছে, বেশি কর নির্ধারণের কারণে মানুষ দেশের বাইরে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। এতে বিদেশে অর্থ পাচার বাড়বে।

রিহ্যাবের সহসভাপতি কামাল মাহমুদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিগত দিনে করের বোঝা এত বাড়েনি। দুই কোটি টাকার জমি কিনতে কর দিতে হবে ৫০ লাখ টাকা। মানুষ এত টাকা দেবে কোথা থেকে?’

[প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সবুর শুভ (চট্টগ্রাম) ও শামিমুজ্জামান (খুলনা)]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত