রাজপথে রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষার পরিস্থিতি অনেকটাই যেন রবিঠাকুরের কবিতার সেই লাইন দুটির মতো: ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
বড় দুটি রাজনৈতিক দল একটি অপরটিকে নিচে ফেলার কিংবা পশ্চাতে বা পেছনে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে আর আওয়ামী লীগ ও সরকার চেষ্টা করছে বিএনপিকে পেছনে ফেলে টপকে সামনে যেতে।
রাজপথে শক্তির পরীক্ষা দিতে গত ২৮ অক্টোবর মুখোমুখি অবস্থানে গিয়ে বিএনপি কি এগিয়ে যেতে পেরেছে? নাকি বিএনপিকে কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তথা সরকার এগিয়ে গেছে? রাজপথে সমস্যা সমাধানের কৌশলের যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
বিএনপি ও তার মিত্ররা ২৮ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার মাধ্যমে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের মহাযাত্রার যে কথা বলেছিল, তা অর্জনে তারা কতটুকু সফল হলো? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এক বছর ধরে সারা দেশে বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বিএনপি সংগঠনের শক্তি যতটা সংহত করতে পেরেছিল, ২৮ অক্টোবর তা অনেকটাই আবার তছনছ হয়ে গেছে।
তাই ২৮ অক্টোবর বিএনপি এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। ২৮ অক্টোবর বিএনপি বড় জমায়েত করতে সক্ষম হলেও শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি এবং মহাসমাবেশও পণ্ড হয়ে গেছে। এর বড় কারণ, এত বড় জমায়েত সুশৃঙ্খল রাখার জন্য ছিল না পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক। যাঁরা জমায়েত হয়েছিলেন, তাঁদের কাছে করণীয় সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট বার্তা ছিল না। ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতা-কর্মীরা গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘যা হওয়ার এবারই হবে।’ ফলে তাঁদের অনেকেরই মনোভাব ছিল বেপরোয়া।
ওই দিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য বিএনপি সরকারের ওপর দোষারোপ করলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সব তথ্য বিশ্লেষণ করলে অনেকের কাছেই এটা স্পষ্ট যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রাথমিকভাবে দায় বিএনপির। সকাল থেকে নয়াপল্টন এলাকায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা মিছিল নিয়ে জমায়েত হতে থাকেন।
রাজপথে বিএনপিকে ‘পাহারা’ দেওয়ার যে কথা আওয়ামী লীগ বলেছিল, বাস্তবে তা দেখা যায়নি। বিএনপির মিছিলে কেউ কোথাও বাধা দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকলেও সমাবেশে যোগদানকারীদের বাধাদানের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে যায় দুপুর সোয়া ১২টার দিকে। মগবাজারের দিক থেকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বহনকারী একটি বাস ও দুটি পিকআপ কাকরাইল মসজিদ ও মৎস্য ভবন হয়ে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের দিকে যাওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে।
প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন ও বিপরীত পাশের মসজিদের সামনে পৌঁছায় বাসটি। তখন পেছন থেকে বিএনপির একটি মিছিল নয়াপল্টনের দিকে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল। বাসের ভেতর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দলীয় স্লোগান দেন। তখনই বিএনপির নেতা-কর্মীরা হঠাৎ হামলা চালান। মূলত এই হামলা থেকেই শনিবার সংঘর্ষ শুরু হয় এবং এর রেশ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরাপত্তায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের মতে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাসে হামলা চালালে বাস ও পিকআপ থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দ্রুত নেমে দৌড়ে পালাতে থাকেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁদের হাতে থাকা লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ধাওয়া করেন। এ সময় সেখানকার পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। সড়কের একপাশে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও অপর পাশে জাজেস কমপ্লেক্স থাকায় সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে এসে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা রাস্তার আইল্যান্ডের গাছের ডাল ভেঙে এবং হাতে থাকা লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে তাঁরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালান। বাসভবনের ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও নামফলক ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে বিএনপির সমর্থকেরা কাকরাইল ট্রাফিক পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাকালে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে লাগাতার কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপে করতে থাকে। এ সময় বিএনপিকর্মীরা দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেন।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার রেশ অল্প সময়ের মধ্যেই কাকরাইল, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী লেন, মালিবাগ, বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষ চলে দিনভর।
প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী রাফসান গালিব সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে লিখেছেন:
‘শান্তিনগর মোড় ও আশপাশের অলিগলি—সবখানেই বিএনপির কর্মী। সবার মধ্যে মারমুখী মনোভাব, অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে, আর তাকে ঘিরে চলছে স্লোগান। এসবের মাঝখানেই মোড়ের সঙ্গে বেইলি রোডের মুখে আল মদিনা প্যালেস, যেটিকে অনেকে বলছিলেন, বিএফসি ভবন, সেটির নিচে একদল পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে।...
রাস্তার পাশে একজন লোককে দেখলাম আরেকজনের মাথায় কাফনের সাদা কাপড় পরিয়ে দিতে। দুজনেরই পঞ্চাশের কমবেশি বয়স। জানালেন, নতুন বাজার থেকে এসেছেন। দলের কোনো পদ-পদবি জানাতে চাইলেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, সাদা কাফন পরছেন, আজকে কি আপনারা রাস্তায় থেকে যাবেন? তাঁরা জানালেন, ঢাকা ছেড়ে তাঁরা নড়বেন না।...
শান্তিনগর মোড়ে যেতেই দেখলাম, বিএনপির কর্মীরা সড়কের ওপরে হাতের কাছে যা পাচ্ছেন, তা-ই ভাঙচুর করছেন; বিশেষ করে ট্রাফিক লাইট। রাস্তার পাশে ভবনের ওপর থেকে যাঁরাই ভিডিও করছেন বা ছবি তুলছেন, তাঁদের দিকে তেড়ে গিয়ে ইটপাটকেল মারার ভয় দেখাচ্ছেন।...
এরপর আরেক তরুণের সঙ্গে কথা হলো, কক্সবাজার থেকে এসেছেন। বললেন, ৭০-৮০টি মাইক্রোবাসে করে সকাল ৬টার দিকে তাঁরা ঢাকায় ঢুকেছেন। পথে কোথাও বাধার মুখে পড়েননি। যদিও সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ঢাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে সব গাড়িকে তল্লাশির মুখে পড়তে হয়েছে।...
সোজা রাজমণি মোড়ের দিকে তাকিয়ে গোটা রাস্তা ফাঁকা দেখতে পেলাম। রাস্তাজুড়ে ইটপাটকেল পড়ে আছে। সবখানে সংঘর্ষের চিহ্ন। পুলিশ বক্স আগুনে জ্বালানো। সড়ক বিভাজকের গাছ ছিন্নভিন্ন।...
পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, বিএনপির কাছ থেকে তাঁরা এমন কর্মকাণ্ড আশা করেননি। বিএনপি বলেছিল, সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। সেটি থাকল না। সেখানেই জানতে পারলাম, বিএনপি সমাবেশ করতে পারেনি। অন্যদিকে জামায়াত শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে বেরিয়ে গেছে।...
বিএনপির মারমুখী আচরণের দুটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে হলো: শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বা যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার বার্তা বিএনপির হাইকমান্ড তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছে ঠিকঠাকমতো পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। অথবা বারবার ঢাকায় এসে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নাখোশ ছিলেন কর্মীরা। মাঠ দখল করে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাওয়াই তাঁদের মনোভাব ছিল। সেখানে হাইকমান্ডের নির্দেশনা তাঁদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।...
বিএনপির নেতা-কর্মীরা আদৌ কি চূড়ান্ত সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন? শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নাকি সংঘর্ষ—এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল বললে ভুল হবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাফল্য হচ্ছে, হাইকমান্ড থেকে তাঁদের নেতা-কর্মীদের প্রতি সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছিল। সেই অর্থে বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষে তাঁরা যাননি।
সবকিছু মিলিয়ে দেখলে প্রশ্ন জাগতে পারে, মারমুখী আচরণ করে বিএনপি কি ভুল করল না?... তাদের কর্মীদের হামলায় একজন পুলিশ নিহত হলেন। সাংবাদিকদের ওপরেও হামলা চালানো হয়েছে। নিজেদের একজন কর্মীও নিহত হলেন।...
অন্যদিকে পুলিশ ও সরকারি দলের অবস্থান ও আচরণ দেখলে যে কারও মনে হতে পারে, তারা বিএনপিকে সহিংস হয়ে উঠতেই সুযোগ করে দিয়েছে। তার মানে কি বিএনপি সরকারের ফাঁদে পা দিল?’
প্রথম আলোর সাংবাদিকের দীর্ঘ বয়ান উদ্ধৃত করা হলো এ জন্যই যে এই পত্রিকাটিকে নিশ্চয়ই কেউ সরকার ও আওয়ামী লীগ দরদি বলে মনে করেন না। রাজনীতিকে বলা হয় কৌশলের খেলা। অভিজ্ঞতা বলছে, এই কৌশলের খেলায় বিএনপি বরাবরই আওয়ামী লীগের কাছে হেরেছে।
রোববার হরতাল ডেকেও বিএনপি কি এগিয়ে গেছে? সংবাদপত্রের খবর: রোববারও রাজপথ ছিল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি, জামায়াত এবং সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতাল ‘প্রতিরোধে’ মোড়ে মোড়ে লাঠি হাতে ছিলেন দলটির নেতা-কর্মীরা। বিপরীতে বিএনপি ও জামায়াতের ঝটিকা পিকেটিং ছাড়া হরতালের সমর্থনে তেমন একটা তৎপরতা ছিল না রাজধানীতে; বরং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গ্রেপ্তার হওয়ায় জ্যেষ্ঠ নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এরপর মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিএনপি টানা যে অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, সেটাও বিএনপিকে এগিয়ে নেবে বলে অতি আশাবাদী সরকারবিরোধীও কি মনে করছেন?
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রাজপথে রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষার পরিস্থিতি অনেকটাই যেন রবিঠাকুরের কবিতার সেই লাইন দুটির মতো: ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
বড় দুটি রাজনৈতিক দল একটি অপরটিকে নিচে ফেলার কিংবা পশ্চাতে বা পেছনে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে আর আওয়ামী লীগ ও সরকার চেষ্টা করছে বিএনপিকে পেছনে ফেলে টপকে সামনে যেতে।
রাজপথে শক্তির পরীক্ষা দিতে গত ২৮ অক্টোবর মুখোমুখি অবস্থানে গিয়ে বিএনপি কি এগিয়ে যেতে পেরেছে? নাকি বিএনপিকে কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তথা সরকার এগিয়ে গেছে? রাজপথে সমস্যা সমাধানের কৌশলের যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
বিএনপি ও তার মিত্ররা ২৮ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার মাধ্যমে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের মহাযাত্রার যে কথা বলেছিল, তা অর্জনে তারা কতটুকু সফল হলো? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এক বছর ধরে সারা দেশে বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বিএনপি সংগঠনের শক্তি যতটা সংহত করতে পেরেছিল, ২৮ অক্টোবর তা অনেকটাই আবার তছনছ হয়ে গেছে।
তাই ২৮ অক্টোবর বিএনপি এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। ২৮ অক্টোবর বিএনপি বড় জমায়েত করতে সক্ষম হলেও শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি এবং মহাসমাবেশও পণ্ড হয়ে গেছে। এর বড় কারণ, এত বড় জমায়েত সুশৃঙ্খল রাখার জন্য ছিল না পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক। যাঁরা জমায়েত হয়েছিলেন, তাঁদের কাছে করণীয় সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট বার্তা ছিল না। ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতা-কর্মীরা গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘যা হওয়ার এবারই হবে।’ ফলে তাঁদের অনেকেরই মনোভাব ছিল বেপরোয়া।
ওই দিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য বিএনপি সরকারের ওপর দোষারোপ করলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সব তথ্য বিশ্লেষণ করলে অনেকের কাছেই এটা স্পষ্ট যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রাথমিকভাবে দায় বিএনপির। সকাল থেকে নয়াপল্টন এলাকায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা মিছিল নিয়ে জমায়েত হতে থাকেন।
রাজপথে বিএনপিকে ‘পাহারা’ দেওয়ার যে কথা আওয়ামী লীগ বলেছিল, বাস্তবে তা দেখা যায়নি। বিএনপির মিছিলে কেউ কোথাও বাধা দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকলেও সমাবেশে যোগদানকারীদের বাধাদানের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে যায় দুপুর সোয়া ১২টার দিকে। মগবাজারের দিক থেকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বহনকারী একটি বাস ও দুটি পিকআপ কাকরাইল মসজিদ ও মৎস্য ভবন হয়ে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের দিকে যাওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে।
প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন ও বিপরীত পাশের মসজিদের সামনে পৌঁছায় বাসটি। তখন পেছন থেকে বিএনপির একটি মিছিল নয়াপল্টনের দিকে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল। বাসের ভেতর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দলীয় স্লোগান দেন। তখনই বিএনপির নেতা-কর্মীরা হঠাৎ হামলা চালান। মূলত এই হামলা থেকেই শনিবার সংঘর্ষ শুরু হয় এবং এর রেশ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরাপত্তায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের মতে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাসে হামলা চালালে বাস ও পিকআপ থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দ্রুত নেমে দৌড়ে পালাতে থাকেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁদের হাতে থাকা লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ধাওয়া করেন। এ সময় সেখানকার পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। সড়কের একপাশে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও অপর পাশে জাজেস কমপ্লেক্স থাকায় সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে এসে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা রাস্তার আইল্যান্ডের গাছের ডাল ভেঙে এবং হাতে থাকা লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে তাঁরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালান। বাসভবনের ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও নামফলক ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে বিএনপির সমর্থকেরা কাকরাইল ট্রাফিক পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাকালে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে লাগাতার কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপে করতে থাকে। এ সময় বিএনপিকর্মীরা দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেন।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার রেশ অল্প সময়ের মধ্যেই কাকরাইল, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী লেন, মালিবাগ, বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষ চলে দিনভর।
প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী রাফসান গালিব সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে লিখেছেন:
‘শান্তিনগর মোড় ও আশপাশের অলিগলি—সবখানেই বিএনপির কর্মী। সবার মধ্যে মারমুখী মনোভাব, অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে, আর তাকে ঘিরে চলছে স্লোগান। এসবের মাঝখানেই মোড়ের সঙ্গে বেইলি রোডের মুখে আল মদিনা প্যালেস, যেটিকে অনেকে বলছিলেন, বিএফসি ভবন, সেটির নিচে একদল পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে।...
রাস্তার পাশে একজন লোককে দেখলাম আরেকজনের মাথায় কাফনের সাদা কাপড় পরিয়ে দিতে। দুজনেরই পঞ্চাশের কমবেশি বয়স। জানালেন, নতুন বাজার থেকে এসেছেন। দলের কোনো পদ-পদবি জানাতে চাইলেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, সাদা কাফন পরছেন, আজকে কি আপনারা রাস্তায় থেকে যাবেন? তাঁরা জানালেন, ঢাকা ছেড়ে তাঁরা নড়বেন না।...
শান্তিনগর মোড়ে যেতেই দেখলাম, বিএনপির কর্মীরা সড়কের ওপরে হাতের কাছে যা পাচ্ছেন, তা-ই ভাঙচুর করছেন; বিশেষ করে ট্রাফিক লাইট। রাস্তার পাশে ভবনের ওপর থেকে যাঁরাই ভিডিও করছেন বা ছবি তুলছেন, তাঁদের দিকে তেড়ে গিয়ে ইটপাটকেল মারার ভয় দেখাচ্ছেন।...
এরপর আরেক তরুণের সঙ্গে কথা হলো, কক্সবাজার থেকে এসেছেন। বললেন, ৭০-৮০টি মাইক্রোবাসে করে সকাল ৬টার দিকে তাঁরা ঢাকায় ঢুকেছেন। পথে কোথাও বাধার মুখে পড়েননি। যদিও সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ঢাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে সব গাড়িকে তল্লাশির মুখে পড়তে হয়েছে।...
সোজা রাজমণি মোড়ের দিকে তাকিয়ে গোটা রাস্তা ফাঁকা দেখতে পেলাম। রাস্তাজুড়ে ইটপাটকেল পড়ে আছে। সবখানে সংঘর্ষের চিহ্ন। পুলিশ বক্স আগুনে জ্বালানো। সড়ক বিভাজকের গাছ ছিন্নভিন্ন।...
পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, বিএনপির কাছ থেকে তাঁরা এমন কর্মকাণ্ড আশা করেননি। বিএনপি বলেছিল, সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। সেটি থাকল না। সেখানেই জানতে পারলাম, বিএনপি সমাবেশ করতে পারেনি। অন্যদিকে জামায়াত শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে বেরিয়ে গেছে।...
বিএনপির মারমুখী আচরণের দুটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে হলো: শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বা যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার বার্তা বিএনপির হাইকমান্ড তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছে ঠিকঠাকমতো পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। অথবা বারবার ঢাকায় এসে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নাখোশ ছিলেন কর্মীরা। মাঠ দখল করে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাওয়াই তাঁদের মনোভাব ছিল। সেখানে হাইকমান্ডের নির্দেশনা তাঁদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।...
বিএনপির নেতা-কর্মীরা আদৌ কি চূড়ান্ত সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন? শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নাকি সংঘর্ষ—এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল বললে ভুল হবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাফল্য হচ্ছে, হাইকমান্ড থেকে তাঁদের নেতা-কর্মীদের প্রতি সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছিল। সেই অর্থে বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষে তাঁরা যাননি।
সবকিছু মিলিয়ে দেখলে প্রশ্ন জাগতে পারে, মারমুখী আচরণ করে বিএনপি কি ভুল করল না?... তাদের কর্মীদের হামলায় একজন পুলিশ নিহত হলেন। সাংবাদিকদের ওপরেও হামলা চালানো হয়েছে। নিজেদের একজন কর্মীও নিহত হলেন।...
অন্যদিকে পুলিশ ও সরকারি দলের অবস্থান ও আচরণ দেখলে যে কারও মনে হতে পারে, তারা বিএনপিকে সহিংস হয়ে উঠতেই সুযোগ করে দিয়েছে। তার মানে কি বিএনপি সরকারের ফাঁদে পা দিল?’
প্রথম আলোর সাংবাদিকের দীর্ঘ বয়ান উদ্ধৃত করা হলো এ জন্যই যে এই পত্রিকাটিকে নিশ্চয়ই কেউ সরকার ও আওয়ামী লীগ দরদি বলে মনে করেন না। রাজনীতিকে বলা হয় কৌশলের খেলা। অভিজ্ঞতা বলছে, এই কৌশলের খেলায় বিএনপি বরাবরই আওয়ামী লীগের কাছে হেরেছে।
রোববার হরতাল ডেকেও বিএনপি কি এগিয়ে গেছে? সংবাদপত্রের খবর: রোববারও রাজপথ ছিল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি, জামায়াত এবং সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতাল ‘প্রতিরোধে’ মোড়ে মোড়ে লাঠি হাতে ছিলেন দলটির নেতা-কর্মীরা। বিপরীতে বিএনপি ও জামায়াতের ঝটিকা পিকেটিং ছাড়া হরতালের সমর্থনে তেমন একটা তৎপরতা ছিল না রাজধানীতে; বরং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গ্রেপ্তার হওয়ায় জ্যেষ্ঠ নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এরপর মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিএনপি টানা যে অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, সেটাও বিএনপিকে এগিয়ে নেবে বলে অতি আশাবাদী সরকারবিরোধীও কি মনে করছেন?
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১২ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে