ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ: মার্কিন মুলুকে আবার ভিয়েতনাম আবহ

জাহীদ রেজা নূর, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪, ০৮: ৫১
আপডেট : ০৮ মে ২০২৪, ১০: ৩৫

হান্টার কলেজে কৃষ্ণেন্দু বোসের ‘বে অব ব্লাড’ বা ‘রক্তে রাঙা সাগর’ তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী ছিল ৬ মে সন্ধ্যা ছয়টায়। যখন জেনেছি, তখন অনলাইনে আর নিবন্ধন করা যাচ্ছিল না। তারপর পরিচালকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে আমাদের তিনজনের জন্য তিনটি কার্ডের ব্যবস্থা করেন তিনি। হান্টার কলেজে গিয়ে অতিথি কার্ড নিয়ে ঢুকতে হবে, এই ছিল কথা।

সাবওয়েতে ওঠার পরই দেখা গেল, একটা মেসেজ এসেছে। যে পথে সাধারণত ৬৮ নম্বর স্ট্রিট দিয়ে হান্টার কলেজে ঢুকতে হয়, সে পথে যাওয়া যাবে না। যেতে হবে ঘুরপথে। আজ পাঁচটার সময় হান্টার কলেজের সামনে গাজা নিয়ে বিক্ষোভ হবে। এরই মধ্যে নাকি প্রতিবাদকারীরা জড়ো হয়েছেন হান্টার কলেজের মূল ফটকের সামনে। ফলে সেদিক দিয়ে কলেজে ঢোকা যাবে কি না, তা নিয়ে ছিল সংশয়।

১৯৬৮ সালে এভাবেই খেপে উঠেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণেরা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসেছিলেন রাজপথে। তরুণদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নাম লেখানো হয়েছিল। তখনকার মুষ্টিযুদ্ধের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী ভিয়েতনামের যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানান। চিকিৎসক বেঞ্জামিন স্পোকও যুদ্ধে অংশ নিতে অসম্মতি জানান। আলীর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব কেড়ে নিয়েছিল সরকার। জেল হয়েছিল তাঁর ও স্পোকের মতো আরও অনেকের।

ভিয়েতনাম-প্রশ্নেই ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের ওপর আস্থা হারিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রবাসী। রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তা ছিল চমকপ্রদ। রিপাবলিকানদের প্রার্থীর দৌড়ে ছিলেন রকফেলার, নিক্সন আর রোনাল্ড রিগ্যান। ডেমোক্র্যাটদের হয়ে লিন্ডন জনসন আর দাঁড়ালেনই না নির্বাচনে। ম্যাকার্থীও বেশি দূর এগোতে পারলেন না। এরই মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রবার্ট কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করা হলো। শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হুবার্ট হামফ্রেকে হারিয়ে দিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সন নির্বাচিত হন।

মার্কিন দেশে এত দিন পর যেন সেই সময়টা ফিরে এসেছে। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েল-প্রীতি ভালো চোখে দেখছেন না এখানকার শিক্ষার্থীরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার বিকেল পাঁচটা থেকে হান্টার কলেজের সামনে বিক্ষোভ।

সেখানে ইসরায়েলের নৃশংসতা-বিরোধী স্লোগান উঠেছে। এই বিক্ষোভে কণ্ঠ মিলিয়েছে ইহুদিদের একাংশও। পুলিশ কোনো বাধা দিচ্ছে না। তবে লেক্সিংটন-৬৮ স্ট্রিট বন্ধ করে রেখেছিল পুলিশ। সাধারণ মানুষের যাতায়াত ছিল বন্ধ। কিন্তু সে পথে চলছিল বিক্ষোভ।
আমরা যখন এই রাস্তায় অবস্থিত হান্টার কলেজের ফটক দিয়ে কলেজে ঢুকতে চাইলাম, পুলিশ আমাদের ঢুকতে দিল না। বলল ঘুরে অন্যদিক দিয়ে যেতে। 

কিন্তু অন্য কোনো পথ দিয়ে জায়গামতো পৌঁছানো কঠিন। এরই মধ্যে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত ক্যাম্পাস। গাজায় জেনোসাইডের বিরুদ্ধে উঠেছে এই স্লোগান।

আশ্চর্য, আমরা এখানে এসেছি, আমাদের দেশে ১৯৭১ সালে যে জেনোসাইড ঘটেছিল, তার ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখতে। আর কাকতালীয়ভাবে সেখানেই আরও একটি জেনোসাইডের বিরুদ্ধে হচ্ছে বিক্ষোভ। অনেকে বলাবলি করছেন, ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন যেভাবে জনসমর্থন হারিয়েছিলেন, তেমনি ২০২৪ সালে গাজা বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা জো বাইডেনেরও একই অবস্থা হতে পারে।

হান্টার কলেজের সামনে পুলিশি পাহারার কাছে একজন ছিলেন, যাঁকে দেখে হোমরাচোমরা প্রশাসক বলে মনে হলো। তাঁকে জানালাম, আমরা আমাদের দেশে ঘটা জেনোসাইডের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখতে এসেছি। তিনি কি আমাদের এদিক দিয়ে কলেজে ঢোকার অনুমতি দেবেন?

মুহূর্তে কাজ হয়ে গেল। তাঁর ইশারায় খুলে গেল ফটক। আমরা আমাদের পরিচয়পত্র নিয়ে উঠে গেলাম আটতলায়, প্রদর্শনী কক্ষে।
তখনো ভিড় কম। বিক্ষোভের কারণে অনেকে এসে পৌঁছাতে পারেননি। মিনিট বিশেক পরে শুরু হলো তথ্যচিত্রটি। ততক্ষণে আগ্রহী দর্শক-শ্রোতারা পৌঁছে গেছেন। 

কৃষ্ণেন্দু বাংলাদেশে এর আগেই দেখিয়ে এসেছেন ছবিটি। এখানে যাঁরা দেখছেন, তাঁদের প্রায় সবাই প্রবাসী বাংলাদেশি। তরুণদের সংখ্যাই বেশি। অভ্যাগতদের মধ্যে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিবারেল স্টাডিজের নামকরা অধ্যাপক দীনা সিদ্দিকীও ছিলেন। 

ঘটনাবহুল একাত্তর উঠে এসেছে কৃষ্ণেন্দুর তথ্যচিত্রে। ইতিহাসকে খুবই নির্মোহভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। পরিমিতিবোধ ও নান্দনিকতা মুগ্ধ করার মতো। ১৯৭১ সালে ঘটা নৃশংসতা যে জেনোসাইড ছিল, সে কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না ছবিটি দেখে।
প্রদর্শনী শেষে ছিল প্রশ্নোত্তর-পর্ব। রাত সাড়ে নয়টার দিকে যখন শেষ হলো প্রশ্নোত্তর-পর্ব, তখন বাইরে রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা আর নেই। কিন্তু যেভাবে ফুঁসে উঠেছেন তরুণেরা, তাতে আগামী দিনটিতে আবারও স্লোগানে স্লোগানে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হতেই পারে।

নিউইয়র্ক এখন উত্তপ্ত। উত্তপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্যই। দেশটিকে আসন্ন নির্বাচনে ফিলিস্তিন একটি বড় বিষয় হয়ে উঠবে—সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত