দুজনের যত মিল

মইনুল হাসান 
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ১০: ৩৯

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান—দুজনের বয়সের ব্যবধান এক বছর। পুতিনের বর্তমান বয়স ৭০ বছর। এরদোয়ান এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ৬৯ পূর্ণ করে ৭০-এর ঘরে পা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট পদে শক্তিশালী দেশ দুটির ক্ষমতার মূল চাবিটি একাধারে গত দুই দশকের বেশি নিজেদের দখলে রেখেছেন। দোর্দণ্ড প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চ। তারপরও তাঁরা দুজনই আমৃত্যু ক্ষমতার মোহমুক্ত হতে পারছেন না এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দুজনই প্রায় একই পন্থা, একই কৌশল অবলম্বন করেছেন। দুজনের চিন্তা-ভাবনা, কাজে এবং পরিকল্পনায় 
রয়েছে অনেক মিল। যেমন—

সংবিধান সংস্কার
২০২০ সালে ভ্লাদিমির পুতিন সংবিধান সংস্কার করেছেন। এর ফলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তাঁর। তখন তাঁর বয়স হবে ৮৪ বছর। এরদোয়ানও ২০১৭ সালে তেমনি সংবিধানে ছুরি চালিয়েছেন। ফলে আরও ৫ বছর করে দুই মেয়াদে ১০ বছর তাঁর প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রাখতে তেমন কোনো বাধা থাকছে না। ২০৩৩ সাল পর্যন্ত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদ নিজের দখলে রাখার আগাম ব্যবস্থা করে রেখেছেন এবং সে বছর তাঁর বয়স হবে ৭৯ বছর।

সাম্রাজ্য পুনঃপত্তনের স্বপ্ন
হারানো গৌরব ফিরে পেতে অতীত সাম্রাজ্য পুনঃপত্তনের অলীক স্বপ্নে বিভোর রাশিয়া ও তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান। আর তাই দুজনই সম্প্রসারণবাদকে মূলমন্ত্র করেছেন।

এরদোয়ান নিজেকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের (১৮৪২-১৯১৮) উত্তরসূরি ভাবতে পছন্দ করেন। হামিদীয় যুগের হারানো গৌরব, মহিমা ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তিতে তিনি আপত্তি তুলেছেন।
পুতিন ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনকে একটি কালো অধ্যায় এবং ‘ভীষণ দুঃখজনক’ ঘটনা হিসেবেই মনে করেন। অনেকেই মনে করেন, তিনি নিজেকে রুশ সম্রাট এবং সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা একনায়ক স্তালিনের সুযোগ্য প্রতিনিধি ভাবেন। রাশিয়ান জনগণের আধিপত্যের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন বহু জনগোষ্ঠীকে একত্র করে বহুজাতিক রাশিয়ার স্বপ্ন দেখেন পুতিন।

দুজনই সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী অভিলাষ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। তুরস্ক ১৯৭৪ সাল থেকে সাইপ্রাসের উত্তরের বিশাল একটি অংশ দখল করে আছে। অধুনা উত্তর সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং দক্ষিণ ককেশাসের দিকে নজর দিয়েছে। আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন ছাড়াও, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিস এবং সাইপ্রাস দেশটির বিরুদ্ধে উসকানি, আক্রমণাত্মক আচরণ এই অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টির কারণ হয়েছে।

পুতিন মস্কোর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার অভিপ্রায়ে ২০০৮ সালে জর্জিয়া আক্রমণে দ্বিধা করেননি। তেমনি ২০১৪ সালে ইউক্রেনের একটি অংশ দখল নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করেন। এতেও তুষ্ট না থেকে ২০২২ সালে পুরো ইউক্রেন দখলে নিতে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন। ইউক্রেন, সিরিয়া এবং সুদানসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ খুবই সক্রিয়। 

কর্তৃত্ববাদী আচরণ
মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে দুজনই দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে দমন-পীড়নে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ২০১৬ সালে এরদোয়ানকে উৎখাতে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরপরই রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং তাঁর একচ্ছত্র শাসন শুরু হয়। দেশব্যাপী ধরপাকড়সহ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। সে সময় সন্দেহভাজনদের সরিয়ে দিয়ে প্রশাসনের সব স্তরে নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বিপুলসংখ্যক বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। গণমাধ্যমের রাশ টেনে ধরা হয় কঠিন হাতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং এরদোয়ানের সমর্থনপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী বাহিনীর জুলুম-নিপীড়ন থেকে লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও রেহাই পাননি।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে স্তালিনের ভাবশিষ্য পুতিনের বিরুদ্ধে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ আছে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার এবং সেই সঙ্গে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করার অপবাদ আছে দুজনের নামেই। অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় কেন্দ্রে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসক পরিচয় আড়াল করতে পারছেন না দুজনই।

সাংবাদিকদের অধিকারবিষয়ক সংগঠন রিপোর্টার উইদাউট বর্ডারস কর্তৃক এ বছর ৩ মে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে তুরস্ক ১৬৫তম এবং রাশিয়া সেখানে ১৬৪তম।

অলিগার্চ 
ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির এরদোয়ানকে ঘিরে আছে স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী মহল। এরদোয়ানের একান্ত কৃপায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে এই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে, বিশেষ করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সামনে এসেছে এবং এগুলোর 
কটাক্ষ করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘পাঁচ লুটেরা’। তাঁরা তুর্কি প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর দলের জন্য নিয়মিত মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে থাকেন। এরদোয়ানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে এসব ধনকুবের প্রচুর অর্থ জুগিয়েছেন। বলা চলে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।

এককালের সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় পুতিনের ছত্রচ্ছায়ায় একদল অলিগার্চ বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পেরেছে। একটি সুসংগঠিত মাফিয়া চক্র রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো নির্মাণের সব চুক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। পুতিন এদের থেকে নিয়মিত বখরা পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। 

ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি
কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকদের সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে একদল তোয়াজকারী স্বার্থবাজ মানুষ। এদের কঠিন ব্যূহের কারণে ধীরে ধীরে তাঁরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন এবং সে সময় তাঁরা সস্তা রাজনীতির পথ ধরেন, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি শুরু করেন। এরদোয়ান ও পুতিন এর ব্যতিক্রম হতে পারেননি।

এরদোয়ান তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহত করতে ধর্ম আর পুঁজিবাদকে মিশিয়ে নতুন এক অর্থনীতির জন্ম দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ধর্মীয় নেতাদের মাসোহারা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। ফলে তিনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে পাশ কাটিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তার পাল্লা নিজের দিকে ভারী করতে পেরেছেন।

পুতিন নিজের দেশের অর্থোডক্স ধর্মগুরুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন এবং সুযোগ পেলেই ধর্ম বিষয়ে পশ্চিমের উদারপন্থী ‘বিভ্রান্ত’ নীতির সমালোচনায় সরব হন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে নাগরিকদের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগাতে প্রাচীন কৌশল অবলম্বনে এরদোয়ান এবং পুতিন দুজনই সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন।

অনেকেই মনে করেন, ভ্লাদিমির পুতিন এবং রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দুজন মোটেই বন্ধু নন। তাই বলে দুজন একে অন্যের শত্রুও নন। তাঁরা দুজনই ইতিমধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রপ্রধানদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নিজেদের নাম চিরস্থায়ী করেছেন। এখন দেখার বিষয়, আর কত দিন তাঁরা তাঁদের মসনদ ধরে রাখতে এবং ক্ষমতার অক্লান্ত দৌড়ে দুজনই কতটা মিল রাখতে পারবেন।

মইনুল হাসান, ফ্রান্সপ্রবাসী লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত