মুসলমান: বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলন

আলতাফ পারভেজ
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭: ৪৬
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১: ৪৮

সম্প্রতি দেশে আবার জাতীয় সংগীত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এ প্রসঙ্গটি জেগে ওঠে বা জাগিয়ে তোলা হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে বাংলা-ফেসবুকে এ রকম বিতর্ক অনেক তারকা ফেসবুকারের ভালো এক ‘পণ্য’। সেই ঢেউ অনেক সময় মূলধারার প্রচার মাধ্যমেও মনোযোগ পায়। 

তবে ফেসবুকে সচরাচর যা হয়—প্রতিনিয়ত নতুন ইস্যু চলে আসে, পুরোনোর জায়গা নিয়ে নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় এই বিতর্কটাও ইতিমধ্যে আপাতত অতীত হয়ে গেছে। ওই বিতর্কের একটা পার্শ্ব-টীকা হিসেবে এই লেখা। 

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে ওই বিতর্ককালে অনেকের তরফ থেকে এ রকম ইঙ্গিত দেখেছি, বঙ্গের হিন্দুসমাজ বঙ্গভাগের বিরোধী ছিলেন এবং মুসলমানরা পুরোপুরি পক্ষে ছিলেন। একই ফর্মুলা অনুযায়ী অনেকে বলেছেন, প্রথমোক্তরা স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং শেষোক্তরা সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। 

আমার বক্তব্য এই শেষের দাবিটা নিয়ে। ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ বলছে, এই দাবিটা সত্য নয়। বরং তখনকার মুসলমান সমাজের অনেকেই শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে থাকা বা বিরোধিতার ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক চোখ দিয়ে বোঝা বা বোঝানোর চেষ্টা বিপজ্জনকভাবে একপেশে। 

সবাই জানেন, বাংলা ভাগ হয় ১৯০৫-এ এবং আবার সেই ভাগের সিদ্ধান্ত সংশোধন হয় ১৯১১ সালে। এটাই ‘স্বদেশি আন্দোলনে’র সময়। কেন ব্রিটিশ প্রশাসন তখন বাংলা ভাগে আগ্রহী হলো, এর পেছনে তাদের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতির কোনো ইন্ধন ছিল কি না সেই আলোচনা এখানে তোলা হচ্ছে না। বঙ্গভঙ্গের আরও নানা কারণ ও পটভূমি আছে। সেসবও এখানে করা হচ্ছে না। এখনকার একমাত্র প্রশ্ন হলো, এটা সত্য কি না মুসলমানদের সবাই বঙ্গভঙ্গ চাইছিল? নাকি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও ছিল? 

এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সেখান থেকে কেবল মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর কথা বলছি। বড় এক আলেম তিনি তখন। অনেক জনপ্রিয়, অনেক প্রভাব। ইসলামাবাদী বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন এবং এ ধারায় বিচ্ছিন্ন কেউ ছিলেন না। এ রকম অবস্থানে তখন আরও অনেক প্রভাবশালী মওলানা ছিলেন। 

আবার এও সত্য, বঙ্গভঙ্গের বিরোধী মওলানাও তখন অনেক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে হাজি শরীয়তুল্লাহর উত্তরসূরি পীর বাদশা মিয়ার মতো মওলানাও ছিলেন। এ ছাড়া ঢাকার নবাব পরিবার তো ছিলই। বিশেষ করে সদ্য জন্ম নেওয়া ‘মুসলিম লীগ’ তখন বাংলা ভাগকে সমর্থন করছিল। মুসলিম লীগে জমিদার ও ধনীদের জোটবদ্ধতা দেখে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মতো নেতারা বঙ্গভঙ্গের শুরুর দিকে মনে করতেন এই সংগঠনের দ্বারা বাংলার নিচুতলার মুসলমানদের মুক্তি সম্ভব নয়। মুসলমান সমাজে তখন ‘আশরাফ’, ‘আতরাফ’ একটা বৈষম্য ছিল। অনেক আলেমের কাছে শেষোক্তদের স্বার্থ বাড়তি বিবেচনা পেয়েছিল বলেই মনে হয়। 

প্রভাবের দিক থেকে এবং বক্তব্যের যৌক্তিকতায় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীরাও তখন বাংলা ছাড়িয়েও বেশ প্রভাবশালী। যদিও ইসলামাবাদী তখনকার বাংলার এক অর্থে প্রান্তিক জনপদ চট্টগ্রামের চন্দনাইশের মানুষ, কিন্তু তাঁর তৎপরতার পরিসর ছিল বহু জনপদজুড়ে। জালালউদ্দীন আফগানির শিষ্য ছিলেন তিনি। প্রথমে কংগ্রেস করলেও পরে ১৯৩৬ সাল নাগাদ তিনি কৃষক প্রজা দলের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি হন। ’৩৭-এর নির্বাচনে তিনি প্রজা দল থেকেই জিতেছিলেন। মাঝখানে খেলাফত আন্দোলনের খ্যাতনামা সংগঠক ছিলেন। জমিয়ত-উল-উলেমা-চট্টগ্রামেরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আজাদ-হিন্দ-ফৌজেরও চট্টগ্রামের প্রধান এক সংগঠক তিনি। 

শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে ‘সোলতান’ নামে বিখ্যাত পত্রিকা ছিল ইসলামাবাদীর। যেখানে তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ পেত। ‘সোলতান’ ও ‘দ্য মুসলমান’ (ইংরেজি) বাংলা ভাগ চেতনার বিপক্ষে অনেক কিছু ছেপেছে। ‘দ্য মুসলমান’ ছিল মৌলভি মুজিবর রহমানের কাগজ। 

সোলতান ওই দফায় ১৯১০ পর্যন্ত চলেছিল। এই পত্রিকার খরচ জোগাতেন রাজশাহীর ইউসুফ আলী সাহেব। যিনি পাঁচ খণ্ডে ইমাম গাজ্জালির ‘কিমিয়ায়ে সাআদাত’ অনুবাদ করে বিখ্যাত হন। অর্থাৎ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীদের সাংগঠনিক জোরের পাশাপাশি একাডেমিক সামর্থ্যের পরিসরও বেশ বড় ছিল। এ রকম ভাবার তাই কোনো কারণ নেই, আর্থসামাজিক-ধর্মীয় যৌক্তিকতা ছাড়া এই আলেমরা হিন্দুদের সঙ্গে মিলে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে আজকে স্বদেশি আন্দোলনের পক্ষ নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মরণোত্তর জেরা করতে গেলে এ প্রশ্নেরও সদুত্তর দিতে পারতে হবে—মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীরা কেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন? 

প্রসঙ্গক্রমে এও বলা দরকার, হিন্দুসমাজের ভেতর বঙ্গভঙ্গের যে বিরোধিতা ছিল সেটাও সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় ছিল না। হিন্দুসমাজের সবাই এক ধরনের অবস্থান থেকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলেন, বিষয়টা এমন নয়। যদিও একচেটিয়াভাবে সেভাবে ব্যাখ্যাটা দেওয়া হয়। 

এটা ঠিক, স্বদেশি আন্দোলনের অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু সংগঠক এ রকম বিবেচনা থেকে এই সংগ্রামে নেমেছিলেন যে বাংলা ভাগ হলে তাঁদের পুরোনো আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবের পরিসর ছোট হয়ে যাবে। ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশে তাঁরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। এই আন্দোলনের ভেতর হিন্দু পুনর্জাগরণবাদেরও অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান ছিল। অর্থাৎ আন্দোলনের ভেতর চরমপন্থী এবং মধ্যপন্থী নানা ধারা ছিল। শেষ দিকে এতে চরমপন্থী ধারা প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল। যাকে অনেকে ‘বিপ্লববাদী’ ধারা নামেও উল্লেখ করেন। এ পর্যায়ে এসে স্বদেশি আন্দোলন থেকে মুসলমানদের বাড়তি দূরত্ব তৈরি হয়। এসবও মিথ্যা নয়। 

কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য, স্বদেশি আন্দোলনে অনেক হিন্দু যুক্ত ছিলেন মুখ্যত বাংলার অখণ্ডতার প্রেম থেকে। তাঁরা চাইছিলেন ভারতীয় পরিসরে ‘বাংলা’ অবিভক্ত থাকুক। প্রায় একই ধরনের বিবেচনা থেকেই মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মতো অনেকেও শুরুতে বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী ‘নবউদ্দীপনা’র (১৯০৭) মতো কবিতাগ্রন্থও তার বড় এক সাক্ষী হয়ে আছে। 

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীরা মনে করতেন ব্রিটিশবিরোধী অবস্থান নিয়ে বাঙালিত্বের ভেতর দিয়েই মুসলমানের স্বার্থ হাসিল করতে হবে। কৌশল হিসেবে এটা কতটা সঠিক-বেঠিক ছিল সেটা নিয়ে এখন বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু তখনকার মুসলমান রাজনীতিতে এ রকম একটা ধারার অস্তিত্ব আমরা নিশ্চয়ই গায়েব করে দিতে পারি না। সিরাজী এ রকম অবস্থানের কারণে ১৯১০-এ গ্রেপ্তারও হলেন। 

হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের জায়গাটা ওনারা বাংলাকে অখণ্ড রেখেই সমাধা করতে চাইছিলেন। এক থাকতে পারলে বাংলার শক্তির জায়গাটা অনেক দৃঢ় থাকবে বলে সাধারণ একটা বিবেচনা কাজ করত তাঁদের মাঝে। এ রকম অনেকের মাঝে তখন ‘স্বরাজ’ ও ‘আত্মনির্ভরতা’র চৈতন্য কাজ করতে শুরু করে। তাঁরা মনে করতেন বাংলার বিভক্তি একটা ‘জাতিগত দুর্যোগ’। এ রকম বিবেচনা থেকেই পরে খোদ বাংলা-মুসলিম লীগের আবুল হাশিম এবং সোহরাওয়ার্দীকেও অখণ্ড বাংলার জন্য লড়তে দেখি আমরা। কিন্তু এও সত্য, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীদের মতো বড় বড় আলেমের বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই ছিল বাংলার কৃষি সমাজের দরিদ্র মুসলমানরা। এই ধর্মের মধ্যবিত্তদের বড় অংশও সম্ভাব্য নতুন প্রদেশে নিজেদের অধিকতর অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা দেখছিল। 

এভাবে দেখার পেছনে স্থানীয় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের তীব্র প্রচারণাও ছিল। ১৯০৯-এ তারা ভোটব্যবস্থাকে সম্প্রদায়ভিত্তিক (সেপারেট ইলেকটোরেট ব্যবস্থা) করে সেই ‘উদ্যোগ’কে আরও এগিয়ে নেয়। ব্রিটিশদের এ রকম ভূমিকা আবার তখনকার হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করেছিল। এসবের মিলিত ফল হিসেবে আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দীরাও শেষ পর্যন্ত হেরেই গেছেন রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু ইতিহাস বয়ানের সময় আমাদের কেবল মুদ্রার একদিকটা দেখালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুলভাবে ঘটনাবলি জানবে এবং কখনো-না-কখনো কোথাও গিয়ে প্রচণ্ড হোঁচট খাবে।  

যেকোনো বড় গণ-আন্দোলনে নানা ধারা থাকে। সময়ের ধারাবাহিকতায় তাকে তুলে ধরার সময় সেভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করাই ইতিহাসচর্চাকারীদের দায়। তা না হলে একধরনের অসততার সংস্কৃতি তৈরি হয়।

লেখক: আলতাফ পারভেজ
গবেষক ও লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত