সঞ্জীব দ্রং
মহাশ্বেতা দেবী ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিষয়ে তাঁর লেখালেখি ও কর্মযজ্ঞের কারণে। ভারতের বহু উপেক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে মূলধারার মানুষের সেতুবন্ধন রচনায় তাঁর লেখা অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। কে মূলধারা, কে মূলধারার বাইরে—এই নিয়েও মহাশ্বেতা দেবীর অসাধারণ ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল ঢাকায়।
প্রথমবার মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়েছিলাম। সেটা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন আমি সাপ্তাহিক খবরের কাগজে ‘আদিবাসী মেয়ে’ কলাম লিখতাম; আর দিদির লেখার কিছু অংশ মাঝেমধ্যে তুলে ধরতাম আমার লেখার ভেতরে। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। তখন প্রতি সপ্তাহে আমার লেখা বের হতো। তখন তরুণ আমি কী রোমাঞ্চ ও শিহরণ নিয়ে নিজেই নিজের লেখা পড়তাম। আমিও জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার আয়োজনের কথা বলতাম। মাঝেমধ্যে লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বেদনা ও অস্ফুট কান্না দেখে লেখার মাঝখানে থেমে যেতাম। বুকটা হাহাকার করে উঠত আবেগে। মাঝে মাঝে অজান্তে চোখ ফেটে জল ঝরে পড়ত। আজ অবাক হয়ে সেসব দিনের কথা ভাবি। মনে প্রশ্ন আসে—আমরা কি এগিয়েছি আসলে? নাকি সভ্যতায়, মানবিকতায়, সৌজন্যবোধে, মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে, জ্ঞানে ও সংস্কৃতি চেতনায় পিছিয়ে গেছি অনেক দূর?
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখতাম, অন্য রকম অনুভূতি হতো। সেই সময় বিখ্যাত সব লেখক এই কাগজে লিখতেন। সেই সময় আমি মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় অনুপ্রাণিত হতাম। ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘শালগিরার ডাকে’, ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’, ‘বিছন’, ‘অপারেশন বসাই টুডু’, ‘ঝাঁসির রাণী’, ‘রুদালি’, ‘টেরোড্যাকটিল’, ‘পিরথা ও পূরণ সহায়’ আরও কত উপন্যাস আমি পড়েছি। ‘রুদালি’ নিয়ে ছায়াছবি হয়েছে। মূলধারা নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা মূলস্রোত-চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। মূলস্রোত ও ভারতের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-তপসিলীদের জীবনস্রোত চিরকালই বিচ্ছিন্ন থেকেছে, বিচ্ছিন্ন করে রেখেছি আমরাই। কিন্তু এটা জানবেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো নিজেদের ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করে। ভারতের সভ্যতায় ওদের অবদান আছে মিলেমিশে। ভারতের সংস্কৃতি অনেক নিয়েছে। এসব স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। মূলস্রোত এর স্বীকৃতি দেয়নি কখনো। ব্যবহার করে গেছে, শুধু ব্যবহার।’ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্যও কথাগুলো প্রযোজ্য।
মহাশ্বেতা দেবী আবার বলছেন, ‘এই যে এত কিছু করা হয়নি আজও, এর ফলে কী আশা করে মূলস্রোত? উপেক্ষা করেই চলব এবং উপেক্ষিত মানুষ তা মেনে চলবেন নীরবে? যদি ওদের মনে “বিচ্ছিন্নতাবোধ” থাকে, সে জন্য দায়ী মূলস্রোত। বহু বছর ধরে ওদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এই মূলস্রোত। মূলস্রোতকেই তো বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে হয় তাহলে। আসলে এখন নম্র, অনুতপ্ত, চিন্তাশীল, আত্মানুসন্ধানী হওয়ার সময়। ক্রুদ্ধ গর্জন ও কথার কচকচির সময় নয়। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে ডুলুং, নেংসাই, চাকা—এসব নদ-নদীকে মেলাবার কাজ তো শুরুই হয়নি এখনো। কবে হবে, তা-ও জানি না। শুধু এটা জানি যে পরিণামে মূলস্রোতকে, সমগ্র দেশকে ভীষণ দাম দিতে হবে এই উপেক্ষার। আর কাদের উপেক্ষার? যারা সত্যিই তো অনেক, অনেক সভ্য আমাদের চেয়ে। মেয়ের বাপ পণ দেয় না, সতীদাহ বা পণের কারণে বধূ হত্যা জানে না, কন্যাসন্তানকে হত্যা করে না, বিধবা-বিবাহ স্বীকৃত, উপযুক্ত কারণ থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত, এমন উন্নত সামাজিক প্রথা যাদের, তাদের উপেক্ষা করলাম। তারা যে সভ্য, উন্নত, শ্রদ্ধেয়, মূলস্রোত, সেটা জানার চেষ্টাই করল না। এর দাম আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে, হবে। কোনো দিন ভারতের সত্যি ইতিহাস লেখা হবে। সে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না, যদি এখনো না বুঝি।’
মহাশ্বেতা দেবীর কাছ থেকে শিখে আমি এই কথাগুলো অনেকবার বলেছি।
অনেক জায়গায়, আমার লেখায়, টিভি টক শোতে, তরুণদের জন্য বক্তৃতায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গানের সভায়, মহড়ায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবন এক মহাদেশ, নানা সম্পদে শোভিত ও সমৃদ্ধ সেই মহাদেশ। অনাবিষ্কৃত, অজানিত রেখেই আমরা সব শেষ করে দিচ্ছি। আমাদের দেশে পাহাড়-পর্বত-নদী-ঝরনা-বন-অরণ্য-পরিবেশ কে রক্ষা করেছে এতকাল? এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ সংরক্ষণ করে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা, ইনডিজিনাস পিপলস। ইউনেসকো পৃথিবীর যে ৬ হাজার মাতৃভাষার কথা বলছে, সেগুলোর মধ্যে ৫ হাজার ভাষা হলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের, যাদের সংখ্যা ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নীতিমালা দরকার, একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিকার আইন দরকার। ইনডিজিনাস পলিসি দরকার। কবে হবে এসব, জানি না।
দুই.
আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করলাম। অনেক উৎসব হলো। প্রান্তিক মানুষসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মানবাধিকার, আত্মপরিচয়, মৌলিক স্বাধীনতা, ঐতিহ্যগত ভূমি ও বনের ওপর প্রথাগত অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তবে দেখব আশাহত হওয়ার ঘটনা। সরকারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করেছে। সেখানে পাওয়া গেছে, দেশে আছে ৪১টি ভাষা। উর্দু ও বাংলা বাদ দিলে বাকি প্রায় সব ভাষাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান নিজে বলছে, এদের মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। আমি দুঃখ ও বিস্ময় নিয়ে দেখি, ভাষার জন্য আবেগভরা জীবন উৎসর্গ করা মূলধারার মানুষের মধ্যে অন্যের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই। আমি দেখিনি। মিডিয়াও এ নিয়ে কোনো হইচই করেনি। সম্ভবত আমি কয়েকটি কলাম লিখেছিলাম। বক্তৃতায় ও টিভি টক শোতে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি মানুষের হৃদয়ে একটু সহানুভূতির অশ্রু ঝরাতে।
তারপরও বলব, অনেক ইতিবাচক অর্জন হয়েছে আমাদের গত পাঁচ দশকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করব। বাঙালি জাতির পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোও মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে অবর্ণনীয় কষ্ট সইতে হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর। আমি একাত্তরে পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়েছিলাম ভারতের মেঘালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে গ্রামে ধ্বংসস্তূপ দেখেছিলাম। সেই বালক বয়সে উদ্বাস্তু জীবনের পথে আমার মা ও স্বজনদের কান্নার দৃশ্য কোনো দিন ভুলব না আমি।
দেশে ফিরে আমাদের সম্পূর্ণ নতুন করে সব শুরু করতে হয়েছিল। এখন ভাবতে ভালো লাগছে যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এসে আমরা দেখছি, প্রিয় স্বদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে। যদিও অন্যদিকে নাগরিকদের একটি অংশ; ৪০ লক্ষাধিক প্রান্তিক মানুষ সবার সঙ্গে সমানতালে এগোতে পারছে না। একদিকে বিশাল বাজেটের মেগা সব প্রকল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অন্যদিকে সমাজের কিছু মানুষের জীবনে বৈষম্য ও হাহাকারের চিত্র প্রকট হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জনগণ, চা-শ্রমিক, দলিত, দূর পাহাড়, চর ও হাওর অঞ্চলের মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য প্রান্তিক
মানুষের দুয়ারে এই উন্নয়নের সুফল সমভাবে পৌঁছাতে পারছে না।
ইতিবাচক যা কিছু অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছরে, তা হলো, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইস্যু নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, দেশে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এ বিষয়ে অনেক বেশি উচ্চকণ্ঠ। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও ইতিবাচক ভাবনা তৈরি হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় বই রচিত হয়েছে। নারী উন্নয়ন নীতি, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিস্তারিতভাবে। ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন হয়েছে, যেখানে নৃগোষ্ঠী বলতে আদিবাসীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির নাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গেজেটভুক্ত করেছে। সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যাপ্ত না হলেও বাজেট বরাদ্দসহ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। গবাদিপশু বিতরণ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, গৃহহীনদের জন্য ঘর, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সহায়তা, চাকরিতে সীমিত সুযোগ ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জনগণ পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর জাতীয় উৎসবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিল্পীরাও অংশ নিয়েছেন। কঠিন করোনাকালে অপ্রতুল হলেও কিছু সহায়তা পেয়েছে। বলা যায়, এ ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ দেশে আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস গঠিত হয়েছে এবং এই ককাস আদিবাসী অধিকার আইনের খসড়া তৈরি করে সংসদে জমা দিয়েছে। অন্যদিকে এখানে জাতিসংঘসহ অনেকে কাজ করছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংগঠনগুলোর মধ্যেও ঐক্য ও সংহতি জোরদার হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করছে এবং এ বিষয়ে থিমেটিক গ্রুপ রয়েছে।
তিন.
তারপরও কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। কথা ছিল সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। কিন্তু আজ জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কোন স্তরে? কথা ছিল সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এই প্রতিশ্রুতি দিলেও এ নিয়ে কোনো কাজ শুরু হয়নি। দেশ দৃশ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হলেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের চিরায়ত, ঐতিহ্যগত ভূমি থেকে ধীরে ধীরে বিতাড়িত হচ্ছে, নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচার উত্তোলন করে প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন আছে। কেন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের মৌলিক মানবাধিকারকে রাষ্ট্রের চোখে দয়া ও করুণার দৃষ্টিতে দেখা হয়? সমাজকল্যাণে যেসব পদক্ষেপ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া হয়, সেখানে কোথাও কি তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আছে? যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো শোষণ, অবিচার ও বঞ্চনার শিকার; তাই ওরা অনগ্রসর রয়ে গেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য চাকরিতে কোটা ছিল, তা-ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো নিশ্চয় অনন্তকালই ধরে কোটা চায় না। আজ বলি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার হৃদয়ে ধারণ করা, সম্মান করা অথবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার একটু বুঝতে চেষ্টা করার কাজটা আমরা যথাযথভাবে করতে পারিনি। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ সম্পর্কে রাষ্ট্রের সঠিক নীতি প্রণীত হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলেছিল, একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। এই নিয়েও কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। সময় বয়ে যায়।
চার.
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবন জড়িয়ে আছে ওদের সামষ্টিক সংস্কৃতি চেতনায়। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে কোনো প্রবাদ তাদের সংস্কৃতিতে নেই। মানুষ বাঁচে সবার সঙ্গে, সবার জন্য, সামষ্টিক ভাবনা নিয়ে। তাই তো ওরা পাহাড়-বন-নদী-ভূমির মালিকানা, আর বেচাকেনা থেকে অনেক দূরে। ওদের এই মনস্তত্ত্বকে, জীবনভাবনার বিশ্বজনীনতাকে আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে; গায়ের জোরে, শক্তির দাপটে নয়। ওদের জীবনে বহিরাগতরা প্রবল রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে ঢুকে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের মতো চলে গেছে জমি, বন, পাহাড়, প্রাকৃতিক সম্পদ। ওরা এখন অধিকারহীন অসহায় মানুষ। সংবেদনশীল, বিনম্র, প্রচণ্ড ভালোবাসা ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর উন্নয়ন এখন আর সম্ভব নয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবখানে এই ভালোবাসার প্রতিফলন দরকার। তাদের উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন সত্যি নম্র, অনুতপ্ত, চিন্তাশীল ও আত্মানুসন্ধানী হওয়ার সময়।
সঞ্জীব দ্রং, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী
মহাশ্বেতা দেবী ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিষয়ে তাঁর লেখালেখি ও কর্মযজ্ঞের কারণে। ভারতের বহু উপেক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে মূলধারার মানুষের সেতুবন্ধন রচনায় তাঁর লেখা অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। কে মূলধারা, কে মূলধারার বাইরে—এই নিয়েও মহাশ্বেতা দেবীর অসাধারণ ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল ঢাকায়।
প্রথমবার মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়েছিলাম। সেটা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন আমি সাপ্তাহিক খবরের কাগজে ‘আদিবাসী মেয়ে’ কলাম লিখতাম; আর দিদির লেখার কিছু অংশ মাঝেমধ্যে তুলে ধরতাম আমার লেখার ভেতরে। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। তখন প্রতি সপ্তাহে আমার লেখা বের হতো। তখন তরুণ আমি কী রোমাঞ্চ ও শিহরণ নিয়ে নিজেই নিজের লেখা পড়তাম। আমিও জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার আয়োজনের কথা বলতাম। মাঝেমধ্যে লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বেদনা ও অস্ফুট কান্না দেখে লেখার মাঝখানে থেমে যেতাম। বুকটা হাহাকার করে উঠত আবেগে। মাঝে মাঝে অজান্তে চোখ ফেটে জল ঝরে পড়ত। আজ অবাক হয়ে সেসব দিনের কথা ভাবি। মনে প্রশ্ন আসে—আমরা কি এগিয়েছি আসলে? নাকি সভ্যতায়, মানবিকতায়, সৌজন্যবোধে, মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে, জ্ঞানে ও সংস্কৃতি চেতনায় পিছিয়ে গেছি অনেক দূর?
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখতাম, অন্য রকম অনুভূতি হতো। সেই সময় বিখ্যাত সব লেখক এই কাগজে লিখতেন। সেই সময় আমি মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় অনুপ্রাণিত হতাম। ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘শালগিরার ডাকে’, ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’, ‘বিছন’, ‘অপারেশন বসাই টুডু’, ‘ঝাঁসির রাণী’, ‘রুদালি’, ‘টেরোড্যাকটিল’, ‘পিরথা ও পূরণ সহায়’ আরও কত উপন্যাস আমি পড়েছি। ‘রুদালি’ নিয়ে ছায়াছবি হয়েছে। মূলধারা নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা মূলস্রোত-চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। মূলস্রোত ও ভারতের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-তপসিলীদের জীবনস্রোত চিরকালই বিচ্ছিন্ন থেকেছে, বিচ্ছিন্ন করে রেখেছি আমরাই। কিন্তু এটা জানবেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো নিজেদের ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করে। ভারতের সভ্যতায় ওদের অবদান আছে মিলেমিশে। ভারতের সংস্কৃতি অনেক নিয়েছে। এসব স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। মূলস্রোত এর স্বীকৃতি দেয়নি কখনো। ব্যবহার করে গেছে, শুধু ব্যবহার।’ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্যও কথাগুলো প্রযোজ্য।
মহাশ্বেতা দেবী আবার বলছেন, ‘এই যে এত কিছু করা হয়নি আজও, এর ফলে কী আশা করে মূলস্রোত? উপেক্ষা করেই চলব এবং উপেক্ষিত মানুষ তা মেনে চলবেন নীরবে? যদি ওদের মনে “বিচ্ছিন্নতাবোধ” থাকে, সে জন্য দায়ী মূলস্রোত। বহু বছর ধরে ওদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এই মূলস্রোত। মূলস্রোতকেই তো বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে হয় তাহলে। আসলে এখন নম্র, অনুতপ্ত, চিন্তাশীল, আত্মানুসন্ধানী হওয়ার সময়। ক্রুদ্ধ গর্জন ও কথার কচকচির সময় নয়। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে ডুলুং, নেংসাই, চাকা—এসব নদ-নদীকে মেলাবার কাজ তো শুরুই হয়নি এখনো। কবে হবে, তা-ও জানি না। শুধু এটা জানি যে পরিণামে মূলস্রোতকে, সমগ্র দেশকে ভীষণ দাম দিতে হবে এই উপেক্ষার। আর কাদের উপেক্ষার? যারা সত্যিই তো অনেক, অনেক সভ্য আমাদের চেয়ে। মেয়ের বাপ পণ দেয় না, সতীদাহ বা পণের কারণে বধূ হত্যা জানে না, কন্যাসন্তানকে হত্যা করে না, বিধবা-বিবাহ স্বীকৃত, উপযুক্ত কারণ থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত, এমন উন্নত সামাজিক প্রথা যাদের, তাদের উপেক্ষা করলাম। তারা যে সভ্য, উন্নত, শ্রদ্ধেয়, মূলস্রোত, সেটা জানার চেষ্টাই করল না। এর দাম আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে, হবে। কোনো দিন ভারতের সত্যি ইতিহাস লেখা হবে। সে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না, যদি এখনো না বুঝি।’
মহাশ্বেতা দেবীর কাছ থেকে শিখে আমি এই কথাগুলো অনেকবার বলেছি।
অনেক জায়গায়, আমার লেখায়, টিভি টক শোতে, তরুণদের জন্য বক্তৃতায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গানের সভায়, মহড়ায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবন এক মহাদেশ, নানা সম্পদে শোভিত ও সমৃদ্ধ সেই মহাদেশ। অনাবিষ্কৃত, অজানিত রেখেই আমরা সব শেষ করে দিচ্ছি। আমাদের দেশে পাহাড়-পর্বত-নদী-ঝরনা-বন-অরণ্য-পরিবেশ কে রক্ষা করেছে এতকাল? এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ সংরক্ষণ করে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা, ইনডিজিনাস পিপলস। ইউনেসকো পৃথিবীর যে ৬ হাজার মাতৃভাষার কথা বলছে, সেগুলোর মধ্যে ৫ হাজার ভাষা হলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের, যাদের সংখ্যা ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নীতিমালা দরকার, একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিকার আইন দরকার। ইনডিজিনাস পলিসি দরকার। কবে হবে এসব, জানি না।
দুই.
আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করলাম। অনেক উৎসব হলো। প্রান্তিক মানুষসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মানবাধিকার, আত্মপরিচয়, মৌলিক স্বাধীনতা, ঐতিহ্যগত ভূমি ও বনের ওপর প্রথাগত অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তবে দেখব আশাহত হওয়ার ঘটনা। সরকারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করেছে। সেখানে পাওয়া গেছে, দেশে আছে ৪১টি ভাষা। উর্দু ও বাংলা বাদ দিলে বাকি প্রায় সব ভাষাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান নিজে বলছে, এদের মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। আমি দুঃখ ও বিস্ময় নিয়ে দেখি, ভাষার জন্য আবেগভরা জীবন উৎসর্গ করা মূলধারার মানুষের মধ্যে অন্যের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই। আমি দেখিনি। মিডিয়াও এ নিয়ে কোনো হইচই করেনি। সম্ভবত আমি কয়েকটি কলাম লিখেছিলাম। বক্তৃতায় ও টিভি টক শোতে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি মানুষের হৃদয়ে একটু সহানুভূতির অশ্রু ঝরাতে।
তারপরও বলব, অনেক ইতিবাচক অর্জন হয়েছে আমাদের গত পাঁচ দশকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করব। বাঙালি জাতির পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোও মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে অবর্ণনীয় কষ্ট সইতে হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর। আমি একাত্তরে পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়েছিলাম ভারতের মেঘালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে গ্রামে ধ্বংসস্তূপ দেখেছিলাম। সেই বালক বয়সে উদ্বাস্তু জীবনের পথে আমার মা ও স্বজনদের কান্নার দৃশ্য কোনো দিন ভুলব না আমি।
দেশে ফিরে আমাদের সম্পূর্ণ নতুন করে সব শুরু করতে হয়েছিল। এখন ভাবতে ভালো লাগছে যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এসে আমরা দেখছি, প্রিয় স্বদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে। যদিও অন্যদিকে নাগরিকদের একটি অংশ; ৪০ লক্ষাধিক প্রান্তিক মানুষ সবার সঙ্গে সমানতালে এগোতে পারছে না। একদিকে বিশাল বাজেটের মেগা সব প্রকল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অন্যদিকে সমাজের কিছু মানুষের জীবনে বৈষম্য ও হাহাকারের চিত্র প্রকট হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জনগণ, চা-শ্রমিক, দলিত, দূর পাহাড়, চর ও হাওর অঞ্চলের মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য প্রান্তিক
মানুষের দুয়ারে এই উন্নয়নের সুফল সমভাবে পৌঁছাতে পারছে না।
ইতিবাচক যা কিছু অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছরে, তা হলো, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইস্যু নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, দেশে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এ বিষয়ে অনেক বেশি উচ্চকণ্ঠ। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও ইতিবাচক ভাবনা তৈরি হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী ভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় বই রচিত হয়েছে। নারী উন্নয়ন নীতি, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিস্তারিতভাবে। ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন হয়েছে, যেখানে নৃগোষ্ঠী বলতে আদিবাসীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির নাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গেজেটভুক্ত করেছে। সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যাপ্ত না হলেও বাজেট বরাদ্দসহ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। গবাদিপশু বিতরণ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, গৃহহীনদের জন্য ঘর, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সহায়তা, চাকরিতে সীমিত সুযোগ ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জনগণ পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর জাতীয় উৎসবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিল্পীরাও অংশ নিয়েছেন। কঠিন করোনাকালে অপ্রতুল হলেও কিছু সহায়তা পেয়েছে। বলা যায়, এ ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ দেশে আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস গঠিত হয়েছে এবং এই ককাস আদিবাসী অধিকার আইনের খসড়া তৈরি করে সংসদে জমা দিয়েছে। অন্যদিকে এখানে জাতিসংঘসহ অনেকে কাজ করছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংগঠনগুলোর মধ্যেও ঐক্য ও সংহতি জোরদার হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করছে এবং এ বিষয়ে থিমেটিক গ্রুপ রয়েছে।
তিন.
তারপরও কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। কথা ছিল সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। কিন্তু আজ জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কোন স্তরে? কথা ছিল সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এই প্রতিশ্রুতি দিলেও এ নিয়ে কোনো কাজ শুরু হয়নি। দেশ দৃশ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হলেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের চিরায়ত, ঐতিহ্যগত ভূমি থেকে ধীরে ধীরে বিতাড়িত হচ্ছে, নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচার উত্তোলন করে প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন আছে। কেন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের মৌলিক মানবাধিকারকে রাষ্ট্রের চোখে দয়া ও করুণার দৃষ্টিতে দেখা হয়? সমাজকল্যাণে যেসব পদক্ষেপ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া হয়, সেখানে কোথাও কি তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আছে? যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো শোষণ, অবিচার ও বঞ্চনার শিকার; তাই ওরা অনগ্রসর রয়ে গেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য চাকরিতে কোটা ছিল, তা-ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো নিশ্চয় অনন্তকালই ধরে কোটা চায় না। আজ বলি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার হৃদয়ে ধারণ করা, সম্মান করা অথবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার একটু বুঝতে চেষ্টা করার কাজটা আমরা যথাযথভাবে করতে পারিনি। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ সম্পর্কে রাষ্ট্রের সঠিক নীতি প্রণীত হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলেছিল, একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। এই নিয়েও কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। সময় বয়ে যায়।
চার.
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবন জড়িয়ে আছে ওদের সামষ্টিক সংস্কৃতি চেতনায়। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে কোনো প্রবাদ তাদের সংস্কৃতিতে নেই। মানুষ বাঁচে সবার সঙ্গে, সবার জন্য, সামষ্টিক ভাবনা নিয়ে। তাই তো ওরা পাহাড়-বন-নদী-ভূমির মালিকানা, আর বেচাকেনা থেকে অনেক দূরে। ওদের এই মনস্তত্ত্বকে, জীবনভাবনার বিশ্বজনীনতাকে আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে; গায়ের জোরে, শক্তির দাপটে নয়। ওদের জীবনে বহিরাগতরা প্রবল রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে ঢুকে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের মতো চলে গেছে জমি, বন, পাহাড়, প্রাকৃতিক সম্পদ। ওরা এখন অধিকারহীন অসহায় মানুষ। সংবেদনশীল, বিনম্র, প্রচণ্ড ভালোবাসা ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর উন্নয়ন এখন আর সম্ভব নয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবখানে এই ভালোবাসার প্রতিফলন দরকার। তাদের উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন সত্যি নম্র, অনুতপ্ত, চিন্তাশীল ও আত্মানুসন্ধানী হওয়ার সময়।
সঞ্জীব দ্রং, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে