মশা আবার ভয় ধরাচ্ছে

আয়নাল হোসেন ও সাইফুল মাসুম, ঢাকা
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯: ২৭

গভীর রাত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের অষ্টম তলা। কোনো শয্যা খালি নেই। মেঝে-বারান্দা সব জায়গায় শুধু রোগী আর রোগী। সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। একজন চিকিৎসক এক রোগীর ব্যবস্থাপত্র লিখতে লিখতে বললেন, অন্যান্য দিন পাঁচজন রোগী এলে একজনকে ভর্তি নিতে হয়। আজ পাঁচজন আসছে, পাঁচজনকেই ভর্তি নিতে হচ্ছে। ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

ঢামেক হাসপাতালের এ দৃশ্য দুদিন আগের। এরপর গত দুদিনে ডেঙ্গুর চোখরাঙানি আরও বেড়েছে। শুধু এই হাসপাতাল কিংবা রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই নয়, সারা দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালেই এখন ডেঙ্গু রোগীর চাপ। সারা দেশে প্রতিদিন হাজারের কাছাকাছি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। মৃত্যুও ঘটছে। কিন্তু মশকনিধনে এখনো দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোর। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. বে-নজীর আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতির চরম অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার একটি সার্ভে হয়। কিন্তু এ বছর সেটি হয়নি। এডিস মশার প্রজনন ধ্বংস করতে না পারলে রোগী বাড়তেই থাকবে। এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে যেতে পারে।’

তবে মশকনিধন কার্যক্রমে ঘাটতির বিষয়টি মানতে নারাজ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। তারা বলছে, মশকনিধন চলছে এবং তা আরও জোরদার করা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। তাদের ভাষ্য, অধিদপ্তর ঢাকা দক্ষিণের বড় বড় হাসপাতালগুলোর রোগীর হিসাব দক্ষিণ সিটির কোটায় ফেলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৬৫ জন। মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে ২১ হাজার ৭৯ জন এবং মৃত্যু বেড়ে ১১৯ জন হলো।

ডেঙ্গুর মাসভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বছরের প্রথম দিন থেকেই চলছে। গত জানুয়ারিতে দেশজুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন রোগী, মারা গেছে ১৪ জন। এরপর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলক কম ছিল। মৃত্যুও কম হয়েছে। এপ্রিল থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। আর জুলাই থেকে প্রকোপ ভয়াবহ হতে শুরু করেছে। ওই মাসে আগের মাসের তুলনায় তিন গুণ রোগী—২ হাজার ৬৬৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ১২ জন। আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ৬ হাজার ৫২১ জনকে, মৃত্যু হয় ২৭ জনের। আর সেপ্টেম্বরের ১৮ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮ হাজার ২৩৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের।

ডেঙ্গুর বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৬ বছর থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। চলতি বছর এই বয়সসীমার মধ্যে ৮ হাজার ৬৪৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৩৫ জনের। পুরুষেরা আক্রান্ত বেশি হলেও নারীদের তুলনামূলক মৃত্যু বেশি হচ্ছে।

এবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাপকতা বেশি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। গত ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত এই এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৩৩৭ জন। 

নেই মশকনিধন, চাপ বাড়ছে হাসপাতালে
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. সত্যজিত সাহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, জুলাই-অক্টোবর ডেঙ্গুর মৌসুম। সময়ের সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। গতকাল মুগদা হাসপাতালে ১০১ রোগী ভর্তি ছিল। তাদের মধ্যে ২৯ জন শিশু। মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম কম থাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে।

রাজধানীর মাতুয়াইলের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী গোলাম রসুল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আট দিন ধরে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি। তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে মশার উৎপাত বেড়েছে। ঘরে-বাইরে কোথাও মশা থেকে নিস্তার নেই। কয়েল ছাড়া থাকা যায় না। দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়।

একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাজিবা বেগমের নানি আরেসা বেগম বলেন, তাঁরা রামপুরার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা। নাজিবা ১০ দিন ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি।

ঢাকা উত্তর সিটির নতুন ১৮টি ওয়ার্ডেও নাজুক পরিস্থিতি। দক্ষিণখানের জামতলা মুন্সিবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আলিফ হাসান বলেন, গত দেড় মাসে ওই এলাকায় কাউকে মশার ওষুধ দিতে দেখেননি। তাঁর এলাকায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় পুরোদমে মশকনিধন কার্যক্রম চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্টে কিছু সমস্যা রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণে সব বড় বড় হাসপাতাল, তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগী আসে। হাসপাতালের সব রোগীকে তারা ঢাকা দক্ষিণের রোগী বলে উল্লেখ করে।

আর ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডিএনসিসিতে মশকনিধন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী মশকনিধনে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। যেসব ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নেই, সেখানে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা মশকনিধন তদারকি করছেন।

আর মশক নিবারণী দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব দীপ্তিময়ী জামান বলেন, মশকনিধনে সিটি করপোরেশন কাজ করছে। তাদের দপ্তর সরাসরি মশকনিধনে কাজ করে না। তাদের দপ্তরের মশকনিধনে জড়িত লোকদের সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। মেয়র-কাউন্সিলর না থাকলেও প্রশাসকেরা দায়িত্ব নিয়েছেন। নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম চলছে। 
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজীর আহমেদ বলেন, এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার উচিত হবে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে ব্যাপক কার্যক্রম নেওয়া। প্লাস্টিক কনটেইনার অপসারণ করতে পারলেই ৮০ শতাংশ প্রজনন ধ্বংস করা সম্ভব। আগামী ১৫ দিন শুধু প্লাস্টিক কনটেইনার অপসারণের কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত