Ajker Patrika

সিলেট ও সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় চিনি

ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট ও আয়নাল হোসেন, ঢাকা
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ২৩: ১৩
সিলেট ও সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় চিনি

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় চোরাই চিনি। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রাতে ট্রাকে করে চোরাই পণ্য আসছে। সুনামগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তেরই দেড় শতাধিক স্থান দিয়ে ঢুকছে চোরাচালানের পণ্য। তবে ইদানীং বেশি আসছে ভারতীয় চিনি। ওই চিনি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। এতে কিছু লোকের মুনাফা হলেও সাধারণ ভোক্তাদের চড়া দামেই কিনতে হচ্ছে।

গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মুজিববাজারে গিয়ে দেখা যায়, রাত ২টায় ভারতীয় চিনির বস্তা তোলা হচ্ছিল বড় ট্রাকে। চায়ের দোকানের সামনে মোটরসাইকেল থামাতেই একজন জানতে চাইলেন, ‘আপনারা মাল নিবেন?’ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে তিনি আসাদ উদ্দিন নামের একজনকে ডেকে আনেন। আসাদ ইশারায় দোকানের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘এখানে ব্যবসায় কোনো রিস্ক নাই। অর্ডার দিয়ে গাড়ি পাঠাবেন, মাল লোড করে দিব। সবাইকে আমরা ম্যানেজ করি স্লিপের মাধ্যমে। স্লিপ দেন মিলন চেয়ারম্যান। পরদিন সন্ধ্যায় ট্রাকপ্রতি ৭৫ হাজার আর পিকআপ-প্রতি ১৫ হাজার টাকা নেন। চেয়ারম্যান এই টাকা নিয়ে যান বড় নেতার কাছে।’ 
ধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মিলন মিয়া সব অস্বীকার করে বলেন, ‘স্লিপ দেওয়া আমার কাজনি? এটা নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের কাজ। দেখেন তো আমার নামে কোনো স্লিপ আছেনি?’

এর আগে পার্শ্ববর্তী সালুকাবাদ ইউনিয়নের কাপনা গ্রামের ইমরানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি গুচ্ছগ্রাম সীমান্তের কাঁটাতার পর্যন্ত নিয়ে যান। ইমরান বলেন, বিজিবি পাশে থেকে সহযোগিতা করে। তপন চেয়ারম্যান স্লিপ দেন।

সালুকাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকী তপন বলেন, তাঁর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম সীমান্ত দিয়ে চোরাই পণ্য আসে। এতে মানুষের আয়-রোজগারের বিষয় আছে। এ জন্য এটা নিয়ে বেশি কিছু বলাও যায় না। তিনি বলেন, ‘আমি এসবের সঙ্গে কখনোই জড়িত ছিলাম না, ভবিষ্যতেও হব না।’

বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি শ্যামল বনিক বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে একটু শিথিলতা দেখানো হচ্ছে। তবে রোজার পর সব ঠিক হয়ে যাবে।’

গোয়াইনঘাট উপজেলার ডৌবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান এম. নিজাম উদ্দিন বলেন, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিজিবি ও নেতাদের নামে চাঁদা ওঠে। বিনিময়ে এসব চোরাচালানে মদদ দিচ্ছেন তাঁরা। আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জৈন্তাপুর ইউপির মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভায় প্রতিবাদ করে আসছি। প্রভাবশালী চক্র এসবে জড়িত।’

সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। যাঁরা এসব করছেন, মদদ দিচ্ছেন—উভয়েই দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। আমরা দলের হাইকমান্ডে জানিয়েছি।’

সিলেটের পিপি ড. খায়রুল কবির রোমেন বলেন, ‘সীমান্তে চোরাচালান ওপেন হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব। আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রস্তাব করেছি।’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ২৮ ব্যাটালিয়ন সুনামগঞ্জের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের কার্যক্রম আরও জোরদার করেছি। তবে বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে চোরাচালানের পণ্য নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। বস্তাপ্রতি বিজিবি সদস্যের নামে যেটা বলছেন, সেটা সত্য নয়। সুনির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা আইনানুগ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

পুলিশের সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, ‘সীমান্তে চোরাচালান দমন করার দায়িত্ব বিজিবির। তবু বর্ডার পার হয়ে অবৈধভাবে কোনো পণ্য দেশে ঢুকলে পুলিশ শক্তভাবে দমনের চেষ্টা করে। বিষয়টি নজরে আসার পর সতর্ক করে বুধবার সকল সীমান্ত থানার ওসিদের চিঠি দিয়েছি। চোরাচালানের বিষয়ে পুলিশের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি কারও গাফিলতি প্রমাণিত হয়, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগে দু-একজন সাসপেন্ডও হয়েছে।’ 
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী বলেন, ‘চোরাচালানের বিষয়ে আমাদের নীতি জিরো টলারেন্স। এসবে আমরা কখনো প্রশ্রয় দেব না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে গোলবদন মার্কেটের সামনে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে একটি পিকআপ ভ্যানে চিনির বস্তা তুলছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। চটের বস্তায় গায়ে ‘অরিজিনাল ইন্ডিয়া’ লেখা। স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ভারতের চিনি অবাধে ঢুকে পড়ায় তাঁদের বিক্রি অনেকটাই কমে গেছে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দৈনিক ৪০০-৫০০ ট্রাক চিনি দেশে ঢুকছে। বাংলাদেশ পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি আবুল হাসেম বলেন, ভারতের চিনি দেশে ঢুকে পড়ায় বাজারে প্রভাব পড়েছে। পাইকারি পর্যায়ে চিনির চাহিদা অনেক কমেছে।

মেঘনা গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার জানান, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁদের কোম্পানির মোড়ক নকল করে ভারতীয় চোরাই চিনি ঢোকানো হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা বস্তার নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তাতে দেখা যায়, কয়েকটি বস্তার গায়ে প্রস্তুতকারক, মোড়কজাতকারী ও বাজারজাতকারী হিসেবে লেখা ‘মেঘনা ওয়েল অ্যান্ড সুগার কোম্পানী, মৌলভীবাজার ট্রেড সেন্টার, চকবাজার ঢাকা’। যদিও ইংরেজিতে ‘মেঘনা’ নামটি সঠিকভাবে লেখা হয়নি।

তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘চোরাই চিনি আমাদের কোম্পানির নাম ব্যবহার করে প্যাকেটে ভরে বাজারজাত হচ্ছে। এতে আমাদের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছে।’

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, অবৈধভাবে আসা চিনি সিটি গ্রুপের ব্যাগে ভরে বিক্রির বিষয়টি তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে জানিয়েছেন।

একজন চিনি ব্যবসায়ী জানান, প্রতি কেজি চোরাই চিনি সীমান্তে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ঢাকার মৌলভীবাজারে ১২৫-১৩০ টাকায়, অন্যান্য বাজারে ১৪০-১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান অবশ্য বলেন, যেকোনো উপায়ে হোক, বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে। তবে ভারতীয় চোরাই চিনি আসায় মুষ্টিমেয় কিছু লোক উপকৃত হলেও ভোক্তাদের বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাগল বেশে রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সম্পর্কে যা জানা গেল

প্রধান উপদেষ্টার নতুন বিশেষ সহকারী কে এই আনিসুজ্জামান চৌধুরী

হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের উপাধ্যক্ষকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা

ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গ ও স্তন কেটে হত্যা, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল আসামি

এনসিটিবিতে দুর্নীতির অভিযোগে এনসিপি নেতা তানভীরের নাম, সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত