আজকের পত্রিকা: দেশের মানুষের কাছে আপনার পরিচিতি মূলত একজন গবেষক হিসেবে। তা হঠাৎ রান্নার বিষয়ে বই লিখলেন কেন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার বাজেট, নারীর অধিকার ও মর্যাদার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আমি বছরের পর বছর গবেষণা করেছি। এই সব বিষয় নিয়ে আমার একাধিক প্রকাশনাও আছে। তবে রান্না, বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বণের রান্না নিয়ে বই লিখে আমাকে কারও কারও কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে এই রান্না বা অন্য কথায় রন্ধনশিল্প বিষয়টিকে আমি নারীর ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী উপাদান বলেই মনে করি।
আজকের পত্রিকা: বিষয়টি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: রান্না যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটাও যে নারীর ক্ষমতায়নের একটি হাতিয়ার, এটা আমি প্রথম শিখেছি আমার মায়ের কাছ থেকে। আমার মায়ের হাতের রান্নার খুব সুনাম ছিল। শুধু পরিবারের মধ্যে নয়, পাড়াপড়শিরাও রান্নার বিষয়ে মায়ের কাছে প্রায়ই পরামর্শ নিতেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি এই রান্নার গুণটি কার্যত মাকে আমার বাবার সঙ্গে সমানে সমানে লড়ার ক্ষমতা দিয়েছিল।
আজকের পত্রিকা: সেটা কেমন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের পরিবারে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষেরই ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। কারণ, পুরুষেরাই আয়-রোজগার করতেন আর মেয়েরা সামলাতেন ঘরের কাজ। পরিবারের সবার মুখে খাবার জোগানোর জন্য রান্নাঘর সামলানোর কাজটি করতে হতো নারীদের। কিন্তু এই কাজের কোনো আর্থিক মূল্য ছিল না। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন, কিন্তু এগুলোকে কোনো ‘কাজ’ বলে মনে করা হতো না। আর যে কাজ করে না, অর্থাৎ যার কাজের কোনো অর্থমূল্য নেই, তার কোনো কথা বা মতামতও ছিল পরিবারে মূল্যহীন।
আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখনই আমার বাবা আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু আমি চাইতাম আরও লেখাপড়া করতে। মা ছিলেন আমার পক্ষে। বাবা যতবার আমার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, ততবারই মা বাধা দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।
আজকের পত্রিকা: কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
প্রতিমা পাল মজুমদার: সেটাই বলছি। মা তো আয়-রোজগার করতেন না। তারপরও বাবা কেন তাঁর কথায় প্রভাবিত হতেন? তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। পরিবারের কোনো বিষয়ে মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো না কোনো ক্ষমতা থাকতে হয়। আমার মায়ের ক্ষমতা ছিল রান্না। প্রস্তর যুগে আগুন আবিষ্কারের পর থেকে রন্ধনপ্রক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে। সেই থেকে মানুষের রসনাবিলাসের এই প্রক্রিয়ার প্রধান কলাকুশলী হচ্ছেন নারীগোষ্ঠী। যুগ যুগ ধরে রান্নাকর্মটি এক নারীর কাছ থেকে অন্য নারীর কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। প্রতিটি হাতবদলেই এই কর্মের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে এবং রসনাবিলাসে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বাবার রসনাবিলাস পূরণে মা সক্ষম ছিলেন বলেই তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। আমার বিয়ে আটকে দিয়ে মা এটা প্রমাণ করেছেন রন্ধনশিল্পও নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হতে পারে।
আজকের পত্রিকা: কিন্তু ক্ষমতায়িত নারীরা তো এখন রান্নাঘর থেকে বাইরে আসতে চান?
প্রতিমা পাল মজুমদার: আমি এই মনোভাবের বিরোধী। কারণ আমি মনে করি, রান্না আজ কেবল নারীর রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অর্থকরী মাত্রা এবং পরিণত হয়েছে একটি ব্যবসায়ে। তবে বাণিজ্যক্ষেত্রে নারী তাঁর এই সনাতনি কর্মটি আর নিজের হাতে ধরে রাখতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ করা গেছে, নারী যেন ইচ্ছে করেই পুরুষের হাতে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন এ কর্মটি। কারণ, তাঁরা মনে করছেন নারীর ক্ষমতায়ন, যা অর্জন করার জন্য আজ সারা পৃথিবীর নারীগোষ্ঠী লড়াই করে চলেছেন, তা বহুলাংশে নির্ভর করছে তাঁদের সনাতনি কাজগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার ওপর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রান্না কর্মকাণ্ড ও রান্নাঘর নারীর ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী উৎস। রান্নার ওপর পরিবারের সদস্যদের মনের আনন্দ ও সন্তুষ্টিই কেবল নির্ভর করে না, নির্ভর করে তাঁদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তাও। পরিবার নিয়ে যেহেতু সমাজ গঠিত হয় এবং সমাজ নিয়ে যেহেতু একটি দেশ গঠিত, সেহেতু পুরো দেশের জনগণের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করছে রন্ধন কর্মকাণ্ডের ওপর।
এই সত্য থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে রান্না ও রান্নাঘর একজন নারীর কত শক্তিশালী ক্ষমতার উৎস। এই উৎস থেকে নারী যে কেবল সামাজিক ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেন তা নয়, এই উৎস থেকে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করতে পারেন।
আজকের পত্রিকা: এ বিষয়ে আপনার আর কোনো পরামর্শ আছে কি?
প্রতিমা পাল মজুমদার: যেহেতু এই রন্ধনশিল্প বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মোট বাণিজ্যের এক বিরাট অংশজুড়ে আছে, তাই নারীগোষ্ঠীকে সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে তিনি তাঁর এই সনাতনি একচেটিয়া কর্মটিকে পূর্ণ আয়ত্তে রাখতে পারেন এবং এর বাণিজ্যিকীকরণের পূর্ণ ফল ভোগ করতে পারেন। লক্ষ করা গেছে, রন্ধনপ্রক্রিয়া যত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে এবং স্বল্প সময়সাপেক্ষ হয়েছে, ততই পুরুষ সদস্যরা গৃহের রন্ধনকাজে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই নারীগোষ্ঠীর সচেষ্ট হতে হবে, যাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গৃহের রন্ধনকর্মটিকে স্বল্প শ্রমসাধ্য করা যায় এবং একই সঙ্গে এই কর্মের পরিবেশ রাঁধুনিবান্ধব করা যায়।
আজকের পত্রিকা: আপনি বাংলাদেশের পার্বণের রান্নাকে আলাদা গুরুত্ব দিলেন কেন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: প্রতিটি দেশের রন্ধনপ্রক্রিয়ার একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে, যার সৃষ্টি হয়েছে প্রতিটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যই প্রতিটি দেশের মানুষ তার নিজের দেশের খাবার সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। একটি দেশের বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণকে কেন্দ্র করেও এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সূত্রপাত হয়েছে। কথায় বলে, বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলাদেশ। কারণ, বাঙালিরা খুব আনন্দ ও উৎসবপ্রিয় জাতি।
আবার বাংলাদেশের বেশির ভাগ উৎসব ও পার্বণই ঋতুভিত্তিক। প্রতি ঋতুতে বাংলাদেশে শাকসবজি ও মাছ উৎপাদনে থাকে বৈচিত্র্য। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎসব ও পার্বণ ধর্মভিত্তিক। অবশ্য বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন একটি পীঠস্থান হয়ে উঠছে যে ধর্মীয় পার্বণগুলোও আপামর জনগণের অংশগ্রহণে সর্বধর্মীয় হয়ে উঠেছে। এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋতুভিত্তিক।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এ দেশের উৎসব ও পার্বণের বৈচিত্র্যপূর্ণ সনাতনি রান্নাগুলো আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে, সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের নারী আজ ঘরকন্নাকাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে অর্থকরী কাজেও যোগ দিয়েছেন। ফলে তাঁর সময় নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। উৎসব পার্বণের বেশির ভাগ খাবারের রন্ধনপ্রণালি খুব সময়ঘন, যা করার জন্য আজকের কর্মজীবী নারীদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না। ফলে গৃহ-রন্ধনকৌশলগুলো স্থানান্তরিত হতে পারছে না প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আজ নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেট থেকে আহরণ করে অনেক রন্ধনজ্ঞান। কিন্তু মা, দিদিমা, ঠাকুমা, মাসি, পিসি, খুড়ি, জেঠির যুগ যুগের রন্ধন অভিজ্ঞতা, তাঁদের রন্ধন উদ্ভাবন এবং তাঁদের নিজস্ব রন্ধনকৌশলগুলো ইন্টারনেটের কোথাও স্থান পায় না। এই রন্ধনকৌশলগুলো সংরক্ষণ করে রাখতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
আজকের পত্রিকা: রান্নার সঙ্গে পরিবেশনার কি কোনো সম্পর্ক আছে?
প্রতিমা পাল মজুমদার: খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। বাংলাদেশের উৎসব-পার্বণের রান্নাতেই কেবল বৈচিত্র্য নেই, বৈচিত্র্য আছে খাবার পরিবেশনেও। বর্ষবরণ উৎসবে খাবার পরিবেশন করা হয় মাটির পাত্র, কলাপাতা, শালপাতা এবং বাঁশ-বেতের তৈরি সাজিতে। বর্ষামঙ্গল উৎসবে খাবার পরিবেশন হয় মূলত মাটির বাসনকোসনে। আবার দুর্গোৎসবের চার দিনের খাবার পরিবেশনায় থাকে নানা বৈচিত্র্য। পিতল ও কাঁসার বাসন, স্টিলের বাসন কিংবা পাথরের বাটিতেও পরিবেশন করতে দেখা যায়।
এ দেশের মা-দিদিমাদের বলতে শোনা যায়, ‘খাদ্যের দুটি কাজ। এক. স্বাস্থ্যকে সুস্থ রেখে শরীরকে ঠিক পথে চালিত করা; দুই. রসনাকে তৃপ্ত করে মনকে আনন্দ দেওয়া।’ শরীর সুস্থ রাখার জন্য খাদ্যের পুষ্টি গুণাগুণ জরুরি আর মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য জরুরি হচ্ছে খাদ্যের স্বাদ, বাহার, বৈচিত্র্য এবং ঘ্রাণ। মনকে যথেষ্টভাবে আনন্দ না দিতে পারলে খাদ্য যত পুষ্টিকরই হোক, তা স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে পারে না। ফলে খাদ্য তার দুটি কাজ করতেই অসমর্থ হয়। খাদ্যের ঘ্রাণ এত জরুরি যে এ দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং’; অর্থাৎ খাদ্যের গন্ধেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। তাই এ দেশের মা-দিদিমারা বলেন, ‘রন্ধনে রাঁধুনির মনোযোগ আর নিবিষ্টতা অতি জরুরি বিষয়। রান্না কর্মটিকে ভালোবাসতে হবে এবং তাহলেই রান্না হবে সুস্বাদু।’
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রতিমা পাল মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: দেশের মানুষের কাছে আপনার পরিচিতি মূলত একজন গবেষক হিসেবে। তা হঠাৎ রান্নার বিষয়ে বই লিখলেন কেন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার বাজেট, নারীর অধিকার ও মর্যাদার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আমি বছরের পর বছর গবেষণা করেছি। এই সব বিষয় নিয়ে আমার একাধিক প্রকাশনাও আছে। তবে রান্না, বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বণের রান্না নিয়ে বই লিখে আমাকে কারও কারও কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে এই রান্না বা অন্য কথায় রন্ধনশিল্প বিষয়টিকে আমি নারীর ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী উপাদান বলেই মনে করি।
আজকের পত্রিকা: বিষয়টি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: রান্না যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটাও যে নারীর ক্ষমতায়নের একটি হাতিয়ার, এটা আমি প্রথম শিখেছি আমার মায়ের কাছ থেকে। আমার মায়ের হাতের রান্নার খুব সুনাম ছিল। শুধু পরিবারের মধ্যে নয়, পাড়াপড়শিরাও রান্নার বিষয়ে মায়ের কাছে প্রায়ই পরামর্শ নিতেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি এই রান্নার গুণটি কার্যত মাকে আমার বাবার সঙ্গে সমানে সমানে লড়ার ক্ষমতা দিয়েছিল।
আজকের পত্রিকা: সেটা কেমন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের পরিবারে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষেরই ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। কারণ, পুরুষেরাই আয়-রোজগার করতেন আর মেয়েরা সামলাতেন ঘরের কাজ। পরিবারের সবার মুখে খাবার জোগানোর জন্য রান্নাঘর সামলানোর কাজটি করতে হতো নারীদের। কিন্তু এই কাজের কোনো আর্থিক মূল্য ছিল না। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন, কিন্তু এগুলোকে কোনো ‘কাজ’ বলে মনে করা হতো না। আর যে কাজ করে না, অর্থাৎ যার কাজের কোনো অর্থমূল্য নেই, তার কোনো কথা বা মতামতও ছিল পরিবারে মূল্যহীন।
আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখনই আমার বাবা আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু আমি চাইতাম আরও লেখাপড়া করতে। মা ছিলেন আমার পক্ষে। বাবা যতবার আমার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, ততবারই মা বাধা দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।
আজকের পত্রিকা: কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
প্রতিমা পাল মজুমদার: সেটাই বলছি। মা তো আয়-রোজগার করতেন না। তারপরও বাবা কেন তাঁর কথায় প্রভাবিত হতেন? তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। পরিবারের কোনো বিষয়ে মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো না কোনো ক্ষমতা থাকতে হয়। আমার মায়ের ক্ষমতা ছিল রান্না। প্রস্তর যুগে আগুন আবিষ্কারের পর থেকে রন্ধনপ্রক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে। সেই থেকে মানুষের রসনাবিলাসের এই প্রক্রিয়ার প্রধান কলাকুশলী হচ্ছেন নারীগোষ্ঠী। যুগ যুগ ধরে রান্নাকর্মটি এক নারীর কাছ থেকে অন্য নারীর কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। প্রতিটি হাতবদলেই এই কর্মের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে এবং রসনাবিলাসে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বাবার রসনাবিলাস পূরণে মা সক্ষম ছিলেন বলেই তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। আমার বিয়ে আটকে দিয়ে মা এটা প্রমাণ করেছেন রন্ধনশিল্পও নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হতে পারে।
আজকের পত্রিকা: কিন্তু ক্ষমতায়িত নারীরা তো এখন রান্নাঘর থেকে বাইরে আসতে চান?
প্রতিমা পাল মজুমদার: আমি এই মনোভাবের বিরোধী। কারণ আমি মনে করি, রান্না আজ কেবল নারীর রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অর্থকরী মাত্রা এবং পরিণত হয়েছে একটি ব্যবসায়ে। তবে বাণিজ্যক্ষেত্রে নারী তাঁর এই সনাতনি কর্মটি আর নিজের হাতে ধরে রাখতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ করা গেছে, নারী যেন ইচ্ছে করেই পুরুষের হাতে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন এ কর্মটি। কারণ, তাঁরা মনে করছেন নারীর ক্ষমতায়ন, যা অর্জন করার জন্য আজ সারা পৃথিবীর নারীগোষ্ঠী লড়াই করে চলেছেন, তা বহুলাংশে নির্ভর করছে তাঁদের সনাতনি কাজগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার ওপর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রান্না কর্মকাণ্ড ও রান্নাঘর নারীর ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী উৎস। রান্নার ওপর পরিবারের সদস্যদের মনের আনন্দ ও সন্তুষ্টিই কেবল নির্ভর করে না, নির্ভর করে তাঁদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তাও। পরিবার নিয়ে যেহেতু সমাজ গঠিত হয় এবং সমাজ নিয়ে যেহেতু একটি দেশ গঠিত, সেহেতু পুরো দেশের জনগণের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করছে রন্ধন কর্মকাণ্ডের ওপর।
এই সত্য থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে রান্না ও রান্নাঘর একজন নারীর কত শক্তিশালী ক্ষমতার উৎস। এই উৎস থেকে নারী যে কেবল সামাজিক ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেন তা নয়, এই উৎস থেকে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করতে পারেন।
আজকের পত্রিকা: এ বিষয়ে আপনার আর কোনো পরামর্শ আছে কি?
প্রতিমা পাল মজুমদার: যেহেতু এই রন্ধনশিল্প বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মোট বাণিজ্যের এক বিরাট অংশজুড়ে আছে, তাই নারীগোষ্ঠীকে সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে তিনি তাঁর এই সনাতনি একচেটিয়া কর্মটিকে পূর্ণ আয়ত্তে রাখতে পারেন এবং এর বাণিজ্যিকীকরণের পূর্ণ ফল ভোগ করতে পারেন। লক্ষ করা গেছে, রন্ধনপ্রক্রিয়া যত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে এবং স্বল্প সময়সাপেক্ষ হয়েছে, ততই পুরুষ সদস্যরা গৃহের রন্ধনকাজে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই নারীগোষ্ঠীর সচেষ্ট হতে হবে, যাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গৃহের রন্ধনকর্মটিকে স্বল্প শ্রমসাধ্য করা যায় এবং একই সঙ্গে এই কর্মের পরিবেশ রাঁধুনিবান্ধব করা যায়।
আজকের পত্রিকা: আপনি বাংলাদেশের পার্বণের রান্নাকে আলাদা গুরুত্ব দিলেন কেন?
প্রতিমা পাল মজুমদার: প্রতিটি দেশের রন্ধনপ্রক্রিয়ার একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে, যার সৃষ্টি হয়েছে প্রতিটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যই প্রতিটি দেশের মানুষ তার নিজের দেশের খাবার সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। একটি দেশের বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণকে কেন্দ্র করেও এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সূত্রপাত হয়েছে। কথায় বলে, বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলাদেশ। কারণ, বাঙালিরা খুব আনন্দ ও উৎসবপ্রিয় জাতি।
আবার বাংলাদেশের বেশির ভাগ উৎসব ও পার্বণই ঋতুভিত্তিক। প্রতি ঋতুতে বাংলাদেশে শাকসবজি ও মাছ উৎপাদনে থাকে বৈচিত্র্য। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎসব ও পার্বণ ধর্মভিত্তিক। অবশ্য বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন একটি পীঠস্থান হয়ে উঠছে যে ধর্মীয় পার্বণগুলোও আপামর জনগণের অংশগ্রহণে সর্বধর্মীয় হয়ে উঠেছে। এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋতুভিত্তিক।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এ দেশের উৎসব ও পার্বণের বৈচিত্র্যপূর্ণ সনাতনি রান্নাগুলো আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে, সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের নারী আজ ঘরকন্নাকাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে অর্থকরী কাজেও যোগ দিয়েছেন। ফলে তাঁর সময় নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। উৎসব পার্বণের বেশির ভাগ খাবারের রন্ধনপ্রণালি খুব সময়ঘন, যা করার জন্য আজকের কর্মজীবী নারীদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না। ফলে গৃহ-রন্ধনকৌশলগুলো স্থানান্তরিত হতে পারছে না প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আজ নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেট থেকে আহরণ করে অনেক রন্ধনজ্ঞান। কিন্তু মা, দিদিমা, ঠাকুমা, মাসি, পিসি, খুড়ি, জেঠির যুগ যুগের রন্ধন অভিজ্ঞতা, তাঁদের রন্ধন উদ্ভাবন এবং তাঁদের নিজস্ব রন্ধনকৌশলগুলো ইন্টারনেটের কোথাও স্থান পায় না। এই রন্ধনকৌশলগুলো সংরক্ষণ করে রাখতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
আজকের পত্রিকা: রান্নার সঙ্গে পরিবেশনার কি কোনো সম্পর্ক আছে?
প্রতিমা পাল মজুমদার: খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। বাংলাদেশের উৎসব-পার্বণের রান্নাতেই কেবল বৈচিত্র্য নেই, বৈচিত্র্য আছে খাবার পরিবেশনেও। বর্ষবরণ উৎসবে খাবার পরিবেশন করা হয় মাটির পাত্র, কলাপাতা, শালপাতা এবং বাঁশ-বেতের তৈরি সাজিতে। বর্ষামঙ্গল উৎসবে খাবার পরিবেশন হয় মূলত মাটির বাসনকোসনে। আবার দুর্গোৎসবের চার দিনের খাবার পরিবেশনায় থাকে নানা বৈচিত্র্য। পিতল ও কাঁসার বাসন, স্টিলের বাসন কিংবা পাথরের বাটিতেও পরিবেশন করতে দেখা যায়।
এ দেশের মা-দিদিমাদের বলতে শোনা যায়, ‘খাদ্যের দুটি কাজ। এক. স্বাস্থ্যকে সুস্থ রেখে শরীরকে ঠিক পথে চালিত করা; দুই. রসনাকে তৃপ্ত করে মনকে আনন্দ দেওয়া।’ শরীর সুস্থ রাখার জন্য খাদ্যের পুষ্টি গুণাগুণ জরুরি আর মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য জরুরি হচ্ছে খাদ্যের স্বাদ, বাহার, বৈচিত্র্য এবং ঘ্রাণ। মনকে যথেষ্টভাবে আনন্দ না দিতে পারলে খাদ্য যত পুষ্টিকরই হোক, তা স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে পারে না। ফলে খাদ্য তার দুটি কাজ করতেই অসমর্থ হয়। খাদ্যের ঘ্রাণ এত জরুরি যে এ দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং’; অর্থাৎ খাদ্যের গন্ধেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। তাই এ দেশের মা-দিদিমারা বলেন, ‘রন্ধনে রাঁধুনির মনোযোগ আর নিবিষ্টতা অতি জরুরি বিষয়। রান্না কর্মটিকে ভালোবাসতে হবে এবং তাহলেই রান্না হবে সুস্বাদু।’
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রতিমা পাল মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে