ট্রেনের টিকিট দালালের হাতে

তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ০৭: ০১
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ১৭: ০২

আগে ট্রেনের টিকিট নিয়ে সক্রিয় ছিল কালোবাজারি চক্র। কিন্তু প্রশাসনের তৎপরতায় এসব চক্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও দালাল সিন্ডিকেটের কারণে ভোগান্তি ফুরায়নি যাত্রীদের।

অভিযোগ রয়েছে, দালাল সিন্ডিকেটের যোগসাজশে বিভিন্ন রুটের ট্রেনের টিকিটের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে রেলস্টেশনের কিছু কর্মীও জড়িত। কাউন্টারে গিয়ে অনেক যাত্রীই টিকিট পান না। তাঁদের টার্গেট করে দালালচক্র। পরে বাড়তি টাকার বিনিময়ে তাঁদের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। উপায় না পেয়ে বেশি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হন যাত্রীরা। এজন্য টিকিটপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা বাড়তি গুনতে হয় তাঁদের। আবার রেলপুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্যরা টিকিট ছাড়াও অনেককে ট্রেনে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেন বলেও অভিযোগ মিলেছে।

এক সপ্তাহ ধরে কমলাপুর রেলস্টেশনে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে এসব অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। এ ছাড়া চোখে পড়েছে নানা অনিয়ম। বেশির ভাগ দিন সকাল থেকেই এই রেলস্টেশনে ভিড় জমে নানা গন্তব্যের যাত্রীদের। টিকিট কাউন্টারগুলোতে দেখা যায় লম্বা লাইন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় বিভিন্ন রুটের টিকিট। কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে অনেক যাত্রী তখন বিকল্প উপায় খোঁজেন। আরএনবির সহায়তায় টিকিট ছাড়াই অনেকে স্টেশনে প্রবেশ করেন। কেউ পড়েন দালালের চক্করে।

যাত্রী পরিচয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দালালের খোঁজে নামেন এই প্রতিবেদক। খুঁজতে খুঁজতে দালালের সূত্র পাওয়া যায় স্টেশনের ভেতরে থাকা ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের গার্ড ইসমাইল হোসেনের কাছে। ষাটোর্ধ্ব এই নিরাপত্তাকর্মীর কাছে মিলল মো. বসির নামে এক দালালের মোবাইল নম্বর। ফোন দেওয়ার পর শুরুতে সন্দেহের কারণে টিকিট দিতে রাজি হচ্ছিলেন না বসির। পরে টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার শর্তে ঢাকা থেকে যশোর রুটের একটি টিকিট জোগাড় করে দিতে রাজি হন তিনি। তবে এ জন্য তাঁকে দিতে হবে ৮০০ টাকা। যদিও ওই টিকিটের গায়ের মূল্য ৪৮৫ টাকা। দর-কষাকষির পর ৭০০ টাকায় রাজি হলেন বসির।

কথা শেষে বসির হাজির হলেন ডাচ্-বাংলার বুথের সামনে। অগ্রিম ৭০০ টাকা নিয়ে তিনি চলে গেলেন ৩ নম্বর টিকিট কাউন্টারের সামনে। অথচ এই কাউন্টার থেকেই বলা হয়েছিল, যশোর রুটের টিকিট শেষ। কিন্তু বসিরকে কোনো লাইনও ধরতে হয়নি। সোজা চলে গেলেন কাউন্টারে এবং কিছুক্ষণ পরই টিকিট নিয়ে এলেন।

দালালের মাধ্যমে কেনা সেই টিকিটকীভাবে তা সম্ভব হলো—জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সাদেকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সব সময় কাজ করছি এসব চক্র ভেঙে দেওয়ার জন্য। প্রতি বৃহস্পতিবার টিকিটের চাহিদা বেশি থাকে। ওই দিন কাউন্টারের মধ্যে আমরা আলাদা লোক রাখি যেন কোনো টিকিট কালোবাজারি না যায়। আমরা সচেতন আছি, তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে এসব চক্র সমূলে উপড়ে ফেলা হবে।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বললেন, ‘স্টেশনে কোনো দালাল দেখলে পুলিশে ধরিয়ে দিন, আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা কোনো অনিয়ম সহ্য করব না।’

এদিকে টিকিট ছাড়া টাকার বিনিময়ে রেল পুলিশের সহযোগিতায় অনেক যাত্রী আন্তনগর ট্রেনে যাতায়াত করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে মো. আজাদ নামের একজন আনসার সদস্যকে দেখা গেল ২০০ টাকার বিনিময়ে টিকিট ছাড়া ভ্রমণের জন্য যাত্রী গোছাতে। মো. মিজান নামের এক যাত্রী টিকিট না পেয়ে আজাদকে ২০০ টাকা দিয়ে ময়মনসিংহের অগ্নিবীণা ট্রেনে উঠে গেলেন। আজাদ অগ্নিবীণা ছাড়াও হাওর, তিস্তা ট্রেনেও দায়িত্ব পালন করেন।

আবার টিকিট ছাড়া স্টেশনের ভেতরে প্রবেশের নিয়ম না থাকলেও টাকার বিনিময়ে অনেককে ভেতরে ঢুকতে দেন আরএনবির কয়েক সদস্য। টিকিট কালেকটর (টিসিদের) ম্যানেজ করে এ কাজ করেন তাঁরা। ১০০-২০০ টাকার বিনিময়ে টিকিট ছাড়া যাত্রীদের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিলেন আরএনবির সদস্য মো. ফারুক।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা জেলা রেলওয়ের পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এসবের মান উন্নয়নে জন্য। তারপরেও কেউ যদি এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে, অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত