পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের। আর এই সীমান্ত পথ দিয়েই এ জেলায় অবাধে প্রবেশ করছে ইয়াবা, গাঁজা, আফিমসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। দুর্গমতার সুযোগে মাদক কারবারি ও পাচারকারীরা বান্দরবানের বিভিন্ন পথকে তাদের মাদক বহনের রাস্তা হিসেবে বেছে নিয়েছে।

সীমান্তের অনেক স্থানে সীমান্ত চৌকি (বিওপি-বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) কম থাকার সুযোগ নিয়ে ওইসব পথ দিয়েই মাদক দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। আর মিয়ানমার থেকে বান্দরবানের সীমানা দিয়ে মাদক প্রবেশ করে তা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে (২০২১ সাল) জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল ইয়াবা, বিয়ার, আফিম, গাঁজা ও মদ উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থমূল্যে যা প্রায় ৪৩ কোটি টাকার মতো। আর এ সময়ে ২৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১৭৯টি, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছি ১৫টি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, মিয়ানমার থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করছে মাদকদ্রব্য ইয়াবা। আকারে ছোট হওয়ায় বহন করা সহজ, তাই লোকজন ইয়াবা পাচার করছে বেশি। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম, থানচি উপজেলাই মূলত মাদক বহনের পথ হিসেবে বেশি ব্যবহার হয়। তবে সম্প্রতি বান্দরবানের রুমা উপজেলা দিয়েও ভারত হতে কিছু মাদক প্রবেশ করছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে (ক্যাম্পে) থাকা মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। ক্যাম্পের বাইরে কী করে রোহিঙ্গারা বের হয়ে মাদক ব্যবসায় ও পাচারে জড়াচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে বান্দরবান জেলা পুলিশ গত বছরে পৃথক অভিযানে ৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৬২ ইয়াবা জব্দ করা হয়। একই সময়ে দুহাজার ৩২৩ লিটার চোলাই (দেশীয় তৈরি) মদ, প্রায় দুই কেজি গাঁজা, ৪০ ক্যান বিয়ার এবং মদ তৈরির উপকরণ ৬০ লিটার ওষুধ জব্দ করে। এ সময়ে পুলিশ ২১২ জনকে গ্রেপ্তার করে। আর এসব মাদক জব্দের ঘটনায় ১৩৬টি মামলা ও ১৫টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে।

অপরদিকে র‍্যাব চট্টগ্রাম ৭ ও র‍্যাব কক্সবাজার ১৫-এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে এক বছরে ৫ লাখ ২১ হাজার ৫৬০ ইয়াবা এবং প্রায় ১৭ কেজি আফিম জব্দ করেছে।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবি সদস্যরাও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। ২০২১ সালে বিজিবি জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন লাখ ৪৯ গাহার ৫৭৬ ইয়াবা, প্রায় ৫৫ লিটার দেশীয় মদ, ১০ বোতল বিদেশি মদ এবং দুই কেজি গাঁজা জব্দ করে। এ সময় বিজিবি ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করে, মামলা করে ২৪টি।

অপরদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গত এক বছরে জেলায় বিভিন্ন অভিযানে চার হাজার ৯৯০টি ইয়াবা, ৫৩ লিটার চোলাই মদ এবং আধা কেজি গাঁজা জব্দ করে। এক বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযানে ২২ জনকে গ্রেপ্তার ও ১৯টি মামলা দায়ের করে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, জব্দ করা এসব মাদকের আনুমানিক মূল্য ৪২ কোটি ৭৫ লাখ ৪৮৫ টাকা।

জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক কেলু মং মারমা বলেন, ‘মাদকদ্রব্য ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা যুবলীগের এক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া আলীকদমে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন মাদক ব্যবসা, পাচার বা সেবনকারীদের কোনো ছাড় দিচ্ছে না।’

জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্ত জেলা হওয়ায় মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন মাদক দ্রব্য বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সহযোগিতা দিচ্ছে।’

বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, মাদক পাচারে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ায় নিয়ন্ত্রণে কিছুটা কঠিন হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকদ্রব্য পাচার, ব্যবসা ও সেবনের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।