পাহাড়ের গায়ে যন্ত্রের তাণ্ডব

আবু বকর ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম ও ইমরান হোসেন (কর্ণফুলী)
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২২, ১২: ৪২

চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর দেয়াং পাহাড়ে অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (কেইপিজেড) দিনের পর দিন পাহাড় কাটা হচ্ছে। এ কারণে ঐতিহ্যবাহী দেয়াং পাহাড়টির অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। ইতিমধ্যে পাহাড়ের বেশির ভাগ অংশ কেটে কারখানা নির্মাণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আট বছর আগে কেইপিজেড অঞ্চল, আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মধ্য বন্দর, উত্তর বন্দর, মোহাম্মদপুর, ফকির কিল ও হাজীগাঁও এলাকায় পাহাড় কাটা শুরু হয়। তবে কয়েক বছর আগে হাজীগাঁও ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধ হলেও কেইপিজেড অঞ্চল এলাকায় এখনো চলছে পাহাড় কাটা। প্রতিদিনই খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে বড় উঠান এলাকা থেকে বৈরাগ পর্যন্ত উঁচু উঁচু পাহাড় কেটে মাটি অপসারণ করে সমতল করছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।

গত রোববার সরেজমিনে কেইপিজেডের অভ্যন্তরে অন্তত ১০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তিন থেকে চারটি স্থানে অন্তত ১০টি এক্সকাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যেই পাহাড় কাটার কাজ চলছে। যেখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে, সেখানে নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী বসিয়ে রাখা হয়। কেউ সেদিকে গেলে নিরাপত্তাকর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। শুধু পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করছে না কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ, পাহাড় থেকে কাটা সেসব মাটিতে ভরাট হচ্ছে আশপাশের প্রাকৃতিক খাল ও জলাধার।

দেয়াং পাহাড়টি ঐতিহ্যবাহী উল্লেখ করে বৈরাগ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নোয়াব আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পাহাড় কেটে শিল্পায়ন আমরা চাই না।’
এদিকে মামলা দিয়েও থামছে না পাহাড় কাটা। ২০১২ সালে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসসহ পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কেইপিজেডের তিন শীর্ষ কর্মকর্তার পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আরও সাত-আটজনকে আসামি করে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। সেই মামলার পরেও ইপিজেড কর্তৃপক্ষ পাহাড় কাটা বন্ধ করেনি।

জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৩৩টি শর্তে কেইপিজেডকে পাহাড় কাটার অনুমতি দিয়েছিল। সেই শর্তে লেখা ছিল, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পাহাড় কর্তন ও মোচন করা যাবে। পাহাড়, টিলা কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানাতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ সেই শর্ত ভেঙেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মফিদুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেয়াং পাহাড়ে একসময় থাকত হাতির পাল। এই পাহাড়ের গায়ে খননযন্ত্রের আঘাত লাগার আগে কখনো সেই হাতিরা লোকালয়ে নেমে আসত না। একের পর এক পাহাড় কাটার পর হাতি তাদের বাসস্থান হারিয়ে দিনদুপুরেও নেমে আসছে লোকালয়ে। 
পাহাড় কাটা নিয়ে পরিবেশবিদ অধ্যাপক ইদ্রিস আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেইপিজেড আগেই পাহাড় কেটে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করেছে। এখন নতুন করে পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশের আরও ক্ষতি হবে। কেননা, দেয়াং পাহাড়ে অনেক জীববৈচিত্র্য আছে। পাহাড় কাটার ফলে এসব জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’

তবে পাহাড় কাটার বিষয়টি জানা নেই বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিনা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
কেইপিজেডের মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ কোনো পাহাড় কাটছে না। তবে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি গ্যাস লাইনের কাজ করতে কিছু পাহাড় কাটছে।’

এদিকে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন অংশে কেইপিজেডের শিল্পায়নের নামে পাহাড় কাটা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে। ওই নির্দেশের পর গত মঙ্গলবার দুপুরে আনোয়ারা উপজেলার প্রশাসন পাহাড় কাটা বন্ধে অভিযান চালায়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মুমিন এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন।

আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত