ওপেক্স গ্রুপের ঋণ আদায় নিয়ে বিপাকে ব্যাংকগুলো

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০৮: ৩৯
আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২১, ১১: ৩৭

দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম পথিকৃৎ উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহার ওপেক্স গ্রুপ। বস্ত্র ও পোশাক খাতের বৃহৎ এ শিল্প গ্রুপে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবসা খারাপ যাওয়ায় বিপুল এই বিনিয়োগ ঋণের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটির জন্য। করোনার অভিঘাত, নগদ মূলধনের অভাব, শ্রম অসন্তোষসহ নানামুখী সংকটে অবশেষে ১৮ অক্টোবর নিজের কারখানা কমপ্লেক্সটি স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয় ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপ। এ অবস্থায় গ্রুপটির কাছে পাওনা ঋণের ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা আদায় নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে ডজনখানেক ব্যাংক।

জানা গেছে, ব্যবসা পরিচালনার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয় ওপেক্স গ্রুপ। এত বড় এই শিল্প গ্রুপটি হঠাৎ করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করায় রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। গ্রুপটিকে দেওয়া বিশাল অঙ্কের ঋণ আদায়ে ব্যাংকাররা নানা চেষ্টা চালালেও তা পুনরুদ্ধার নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছেন তাঁরা।

বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা মহামারির মধ্যে কিছু ঋণ বিলম্বিত এবং পুনঃ তফসিল হয়েছে। ওপেক্স গ্রুপের ঋণের কিস্তি এখন অনিয়মিত। তবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির সংকট উত্তরণে ব্যাংক, বিমা, বিজিএমইএ, স্টেকহোল্ডারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আহ্বান জানান তাঁরা।

চলতি বছরের জুনের পর পূবালী ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ১৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে বলে পূবালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্রুপটি কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় তারা খুবই উদ্বিগ্ন। তবে পূবালী ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে শক্তিশালী জামানত রয়েছে বলেও দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

এদিকে সিটি ব্যাংকে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের বকেয়া ঋণ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা বলে ওই ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

চলতি বছরের জুন শেষে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের কাছে ঋণ বাবদ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, আর্থিক সমস্যায় পড়ার কারণে সবচেয়ে বড় ও পুরোনো পোশাক শিল্পটির ব্যবসায়িক ঋণ এখন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

গ্রুপটির কাছে ঢাকা ব্যাংকের ৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ওপেক্স ভালো ও স্বনামধন্য শিল্প গ্রুপ ছিল, কিন্তু এখন এর সব ঋণ অনিয়মিত হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজের কারণে সমস্যায় পড়েছে। এটিকে সংকট উত্তরণে সহযোগিতা করা উচিত।

এ ছাড়া ওপেক্স গ্রুপের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৭০ কোটি টাকা, এবি ব্যাংকের ৭০ কোটি টাকা, মেঘনা ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকা এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ১২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ও ঋণ আদায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মচারীর পোশাক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এত বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে এভাবে শেষ হতে দেওয়া উচিত নয়।

১৯৮৪ সালে ওপেক্স গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন আনিসুর রহমান সিনহা। পাশাপাশি সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের মাধ্যমে স্থাপন করেন পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও। ঢাকার অদূরে কাঁচপুরে ৪৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তাঁর এই শিল্প উদ্যোগ বস্ত্র ও পোশাক খাতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছিল। বিশাল এই শিল্প গ্রুপের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমা ক্রেতাদের নজর কেড়েছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। বিশাল অবকাঠামো গড়তে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে শেষ পর্যন্ত ঋণের বোঝাই বাড়িয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরে বিপুল পরিমাণ ঋণসহ নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরই ধারাবাহিকতায় ‘বিশাল আর্থিক ক্ষতি’ এমন কারণ দেখিয়ে চলতি মাসে তাদের সব পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয় ওপেক্স গ্রুপ।

১৮ অক্টোবর গ্রুপটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) বানিজ আলী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে স্থায়ীভাবে কারখানাগুলো বন্ধের ঘোষণা দেন। ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ, পোশাক কারখানার শ্রমিকদ প্রতিনিধিসহ স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রমিকদের মজুরি ও বকেয়া পরিশোধ করবেন। কিন্তু তাঁরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের বিষয়ে কিছুই জানাননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘ওপেক্সের এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকের কাছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো অনাদায়ি ঋণ রয়েছে বলে আমাদের কাছে অনুমিত হয়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক গভীরভাবে এটি পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত