সেন্ট মার্টিনে ভাড়া খাটছে সরকারি বাংলো, রেস্টহাউস

উবায়দুল্লাহ বাদল, সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরে
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯: ৪০

সরকারি নির্দেশিকা অমান্য করে সেন্ট মার্টিনে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাংলোটি ইজারা নিয়ে তিন বছর ধরে ব্যবসা করছেন টেকনাফের শাহপরী দ্বীপের এক ব্যবসায়ী। সরকারি অন্যান্য সংস্থার রেস্টহাউসও পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সাগরপারসহ দ্বীপের রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। জেটিঘাট থেকে শুরু করে উত্তরপাড়ার অলিগলিতে এসব যন্ত্রচালিত যানবাহন চলছে।

গবেষকদের মতে, যানবাহনের চাকায় মারা পড়ছে লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা সামুদ্রিক প্রাণী। অবৈধ মোটরবাইক ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার শব্দদূষণের কারণে কাছিম ডিম দিতে দ্বীপে আসছে না। ছোট ছোট সামুদ্রিক প্রাণী ভয়ে ভিড়ছে না। এতে নষ্ট হচ্ছে সেন্ট মার্টিনের প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নূর আহমদের অভিযোগ, মোটরসাইকেল ও ব্যাটারি-চালিত অটোরিকশার কারণে বাজারে রীতিমতো যানজট তৈরি হচ্ছে। বেসরকারি রিসোর্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোও তাদের রেস্টহাউস ভাড়া দিচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। দ্বীপ রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের ওপর ন্যস্ত, তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করছেন। সরকারি নির্দেশনা মানছেন না খোদ সরকারি কর্মকর্তারাই। এতে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শাহীন ইমরান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সারা দেশের মতো সেন্ট মার্টিনেও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য বেড়েছে। শিগগিরই দ্বীপে মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালনা করা হবে। এ ছাড়া সরকারি কোনো স্থাপনা বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় গত ২৩ মে ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নির্দেশিকা-২০২৩’ জারি করা হয় প্রজ্ঞাপন আকারে। এতে সেন্ট মার্টিনে সরকারি সংস্থার স্থাপনা, রেস্টহাউস, ডরমিটরি ও হোস্টেল বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া নিষিদ্ধ করে শুধু দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করতে বলা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা সালাউদ্দিন ও এরশাদ হোসেনের অভিযোগ, অনেক সরকারি কর্মকর্তা অফিস ভাড়া দেন। তাঁদের ম্যানেজ করেই দ্বীপে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। অপর কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশসহ কয়েকটি সংস্থার রেস্টহাউসও পর্যটক মৌসুমে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশে এসব ভবনে থাকতে দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়।

শব্দদূষণ রোধসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দ্বীপে সব ধরনের আলো, ফানুস, আতশবাজি ও উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক ব্যবহার এবং মোটরসাইকেল, ভটভটিসহ যন্ত্র ও ব্যাটারিচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারির ছয় মাস পরও এর তেমন বাস্তবায়ন নেই। বিষয়টি স্বীকার করে সেন্ট মার্টিন ইউপির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর প্রজ্ঞাপন কার্যকর করলেই সব অনিয়ম দূর হবে।

কক্সবাজার শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে ৯টি গ্রামে অন্তত ১০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রতি পর্যটন মৌসুমে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটকের সমাগম হয় দ্বীপে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাচ্ছে।গবেষকদের মতে, প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ লোক ধারণ করার সক্ষমতা আছে দ্বীপটির।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবেরও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মন্ত্রী নির্বাচনের কারণে এলাকায় আছেন। সচিব এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানিয়েছেন তাঁর একান্ত সচিবের (পিএস) মাধ্যমে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, সেন্ট মার্টিনে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি ছিল। এখন এসব দেখা যাচ্ছে না। পরিবেশদূষণের কারণে কাছিমগুলো ডিম পাড়তে আসছে না। যাঁদের দ্বীপের পরিবেশরক্ষার দায়িত্ব, তাঁরাও এখন ভক্ষকের ভূমিকায় নেমেছেন। এসব কারণে দ্বীপসহ আশপাশের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষণা করেছে সরকার। এই এলাকার জন্য অন্তত তিন ডজন বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলেই রক্ষা পাবে সেন্ট মার্টিন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত