আশ্রয়ণের ঘরে রাত কাটে হাতির ভয়ে

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২২, ১৫: ০০

‘চারজন পোলাপান লইয়া প্রায় দেড় বছর আগে এইহানে আইছি। তহন টিনের বেড়ার ঘরটাই শুধু পাইছিলাম। পরে সমিতি থাইক্কা ১০ হাজার টাকা ঋণ কইরা ঘরে কোমর পর্যন্ত মাটি কাটাইছি। ঘরের সামনে কারেন্টের খুঁটি থাকলেও আমগো ঘরে লাইন নাই। একটিমাত্র টিউবওয়েলেও পানি থাহে না। কষ্ট কইরা দিন পার করলেও রাত কাটাই আত্তির (হাতি) ভয়ে। যাওয়ার একটা জায়গা থাকলে এইহানে কষ্ট কইরা দিন কাটাইতাম না।’

আক্ষেপ করে এসব কথা বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বরুঙ্গা পাহাড়ের ঢালে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা শেফালি বেগম (৪৫)। এই কষ্ট ও আতঙ্ক শুধু শেফালির নয়, তাঁর মতো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৫টি পরিবারের দেড় শতাধিক উপকারভোগী একই কষ্ট ও আতঙ্কে দিন পার করছেন।

শেফালী বেগম আরও বলেন, ‘ঈদের পরের রাইত দরজা খুইলা দেহি সামনে আত্তি (হাতি) খাড়াইয়া রইছে। আরও ২০ থেকে ২৫টা আত্তি ঘরের পেছনে খাড়াইয়া রইছে। লগে লগে দরজা বন্ধ কইরা দিছি। পরে স্বামী, পোলাপান লইয়া ভয়ে সারা রাইত চৌকির ওপর বইয়া রইছি। ফজরের আজানের পরে আত্তি সরছে। পরে হুনি সবাই আত্তির ভয়ে রাইত জাইগা কাডাইছে।’

খলচান্দা গ্রামের কৃষক রুহুল আমীন বলেন, ‘প্রতিবছর ফসলের মৌসুমে বন্য হাতির পাল নেমে আসে। ফসল খেয়ে ও মাড়িয়ে নষ্ট করে। হাতি তাড়াতে অনেক সময় আহত হন অনেকে। আমরা ভয় ও আতঙ্ক নিয়েই বেঁচে আছি।’

একই গ্রামের আব্দুল আজিজ বলেন, ‘প্রায়ই সন্ধ্যার পর বন্য হাতির পাল লোকালয়ে নেমে আসে। পাহাড়ের ঢালে আমাদের বসবাস। নানান কষ্ট আর হাতির আতঙ্কেই আমরা দিন পার করছি।’

ময়মনসিংহ বন বিভাগের কর্মকর্তা এ কে এম রুহুল আমিন বলেন, হাতি রক্ষা ও সমতলে আসতে বাধা দেওয়ায় বন বিভাগ থেকে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

হাতির আতঙ্ক ছাড়াও বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে কষ্টে রয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, টিনের ঘরে কোনো জানালা নেই। প্রচণ্ড রোদে ঘরে থাকা যায় না। তখন ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে ঘর থেকে বাইরে গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হয়। আর বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরে রাতে ঠিকমতো ঘুমানো যায় না। দিনমজুর রফিজ উদ্দীন বলেন, ‘সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার অইয়া যায়। প্রায়ই বন্য হাতি আহে। তহন সবাই জেগে ভয়ে রাইত পার করি। যদি আরও কয়েকটা নলকূপ ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা অইত, তাইলে আমগর বিরাট উপকার অইত।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা গৃহবধূ রিনা বেগম (২৫) বলেন, ‘সরকার ঘর দিছে। অহন যদি কারেন্টের একটা ব্যবস্থা কইরা দিত, তাইলে আমগরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা অইত। নতুবা হাতির দাপটে থাহা যাচ্ছে না।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের আঙিনায় মাটি ভরাট না করায় হাতির পায়ের কারণে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। ঘরগুলোর পাশে বিদ্যুতের খুঁটি থাকলেও কোনো ঘরে নেই সংযোগ। ৩৫টি পরিবারের জন্য একটি টিউবওয়েল থাকলেও সেখানে পানি থাকে না। আশপাশের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার ছেলে-মেয়েরা।

২০১৮ সালে উপজেলার বরুঙ্গা পাহাড়ের ঢালে সরকারের ১ একর ৬১ শতক জমিতে নির্মাণ করা হয় এই আশ্রয়ণ প্রকল্প। এতে মোট খরচ হয়েছে ৫২ লাখ টাকা। তবে ৩৫ পরিবারের দেড় শতাধিক মানুষের জন্য আছে মাত্র একটি নলকূপ। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত