Ajker Patrika

আলঝেইমার রোগ সচেতনতা জরুরি

হাসান আলী
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯: ৩৭
আলঝেইমার রোগ সচেতনতা জরুরি

২১ সেপ্টেম্বরকে আলঝেইমার দিবস আর পুরো সেপ্টেম্বর মাসকে আলঝেইমার মাস হিসেবে পালন করা হয়। আলঝেইমার হলো মস্তিষ্কের একধরনের রোগ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি স্মৃতিশক্তি, মেধা, বিচারক্ষমতা, যুক্তিসংগত আবেগ, সামাজিক দক্ষতা হারাতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের কোষগুলো সংকুচিত হতে থাকে, জট লাগে, ফলক বা অনাকাঙ্ক্ষিত স্তর পড়ে। মস্তিষ্কের যে অংশ আক্রান্ত হবে, রোগের লক্ষণ সেভাবেই প্রকাশ পাবে। রোগটির আবিষ্কারক জার্মান মানসিক রোগের চিকিৎসক আলঝেইমার। তাঁর নামানুসারে রোগটির নামকরণ করা হয়।

সব বয়সী মানুষের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী মানুষের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

আলঝেইমার রোগের সাধারণত তিনটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ে এই রোগের সূত্রপাত হয় খুবই ধীরগতিতে। প্রায় অনেকেই প্রথম দিকে বুঝতে পারে না যে এ ধরনের একটি রোগে সে আক্রান্ত হয়েছে। শুরুতে ব্যক্তি একটু বেশি উদাসীন থাকে। কোনো কিছুতেই আগ্রহ বোধ করে না। তার মাঝে কোনো আনন্দ লক্ষ করা যায় না। মেজাজটা প্রায় বিগড়ে যায়, খিটখিটে থাকে। একটুতেই হতাশা হয়ে পড়ে। কথা গুছিয়ে বলতে পারে না, সঠিক শব্দ বা বাক্য ব্যবহারে বিলম্ব করে। নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একই কথা বারবার বলে। চিন্তাভাবনা দ্রুত করতে পারে না। প্রতিদিনের কাজকর্ম শেষ করতে দেরি হয়। বর্তমানে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করতে পারে না, কিন্তু অতীতের ঘটনা স্পষ্ট মনে করতে পারে। টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে না, প্রায়ই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ নিয়ে গেছে বলে সন্দেহ করে। নিয়মিত ওষুধ-পথ্য খেতে ভুলে যায়। এমন সব সিদ্ধান্ত নেয়, যা নিজের অথবা পরিবারের জন্য ক্ষতিকর। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর কিছু কিছু সক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকলেও বেশির ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। রোগীর সেন্স, যেমন স্পর্শ, শোনার ক্ষমতা, স্নেহের দৃষ্টি, হাসিমুখ—এসব আবেগে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকে। স্থান ও সময় সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের নাম মনে করতে পারে না। নিজের ঘর কোনটা, বুঝতে পারে না। অতীতের কথা মনে করতে পারে, কিন্তু কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভুলে যায়। রাতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রোগীর মনে হয়, তাকে কেউ মেরে ফেলতে চায়, তার কাছে জিন-ভূত এসেছিল। কেউ বলে, তার আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। অনেক আগে মৃত মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনেরা দেখা করতে এসেছে বলে জানায়। আবার কেউ কেউ বলে, সে অনেক যোগ্য কিন্তু তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। সবাই তার ক্ষতি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অপরিচ্ছন্ন থাকা, ময়লা কাপড়চোপড় পরা, হতাশা প্রকাশ করা, মাঝেমধ্যে উত্তেজিত হয়ে সহিংস আচরণ করা দ্বিতীয় পর্যায়ের রোগীদের লক্ষণ।

শেষ পর্যায়ে রোগী নিজে নিজের যত্ন নিতে পারে না। মা-বাবা, ছেলেমেয়ে, ভাইবোনকে পর্যন্ত চিনতে পারে না। কথাবার্তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। গোসল, টয়লেট ব্যবহার, কাপড় পরা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে অন্যের সাহায্য লাগে। খাবার চিবিয়ে খেতে পারে না। মুখে খাবার নিয়ে বসে থাকে। বেশি খাবার গ্রহণ করে। খাওয়া শেষ হলেও আবার খেতে চায়। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র চিনতে পারে না। হাঁটাচলা করতে পারে না। কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, অসংযত আচরণ করে।

এ সময় রোগীর সংক্রমণ, জ্বর, ব্যথাবেদনা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা, ডিহাইড্রেশন ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

আলঝেইমার রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি নানা রকমের প্রচারণা চালায়। এতে মনে হতে পারে চিকিৎসা অতি নিকটে। আলঝেইমার রোগীকে কীভাবে সেবা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। সাধারণত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, গৃহকর্মীরা এই রোগীর সেবা দিয়ে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি সেবা দেওয়া কঠিন। ক্লান্তিময়, বিরক্তিকর হতে পারে। তাই সেবাদানকারীকে প্রশিক্ষিত, ধৈর্যশীল-সহনশীল, সংবেদনশীল ও কৌশলী হতে হবে। রোগীর দরকার সযত্নে সেবা, অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। সেবাযত্নের জন্য পর্যায়ক্রমে সার্বক্ষণিক সেবাকর্মীর প্রয়োজন। রোগীকে ব্যায়াম করানো, পছন্দের কাজ করতে সহায়তা করা, বই পড়ে শোনানো, গান শুনতে দেওয়া, পছন্দের খাবার খেতে দেওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, খেলাধুলা করতে সহায়তা করা, শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে বা খেলতে দেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডার ব্যবস্থা করা, শখের কাজ করতে দেওয়া, আপনজনের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া, ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা, হাত-পা ম্যাসাজ করে দেওয়া, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, হাসিমুখে সামনে দাঁড়ানো, স্পর্শ করা, কপালে চুমু দেওয়া, ডায়েরি লিখতে দেওয়া, পুরোনো ডায়েরি পড়তে দেওয়া, ছবির অ্যালবাম খুলে দেখানো, আদরের চাহনিতে তাকানো, কোনো ধরনের প্রশ্ন না করা, নিজের পরিচয় আগে দেওয়া, একাকী না রাখা এবং সদা সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।

আলঝেইমার রোগ নিয়ে আমাদের সচেতনতা তৈরি হলে রোগী ঠিক সময়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে। শুরুতেই রোগীকে সতর্কভাবে সেবাযত্ন করা সম্ভব হবে। পরিবারের সদস্যসহ অন্যরাও রোগীকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারবে। রোগী সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাবে। তাই পরিবারের সদস্যদের আলঝেইমার বিষয়ে কাউন্সেলিং করে নেওয়া জরুরি।

আলঝেইমার রোগের সেবাযত্ন ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দিতে বিশেষায়িত আলঝেইমার হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল নিশ্চিত করবে কারও আলঝেইমার রোগ হয়েছে কি না; অনেকটা বারডেম হাসপাতালের মতো।

লেখক: প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত