উচ্চ শব্দ, আলোয় ক্ষতি সুন্দরবনের

রাশেদ নিজাম ও শেখ আবু হাসান, খুলনা থেকে
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ০৩
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ০৯

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ৬ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনের মাত্র ২০ কিলোমিটার এলাকায় যেতে পারেন পর্যটকেরা। করোনা মহামারির আগে-পরে মিলিয়ে এখানে কমেছে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা। পর্যটন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, পর্যটক আকৃষ্ট করতে মহাপরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরা। তবে গবেষকেরা বলছেন, বনকে যত কোলাহলমুক্ত রাখা যাবে, ততই মঙ্গল।

ট্যুর পরিচালনাকারী সংস্থা ও বিভিন্ন পর্যটন গ্রুপের মতে, সুন্দরবনে বছরে প্রায় সোয়া লাখ পর্যটক যান। গবেষক ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সুন্দরবনে পর্যটন বিকাশ লাভ করে। পর্যটকেরা কখনো কখনো অভয়ারণ্যেও ঢুকে পড়ছেন। মাইক, গানের উচ্চ শব্দ আর অতিরিক্ত পর্যটকের কোলাহলে বনের নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে। লঞ্চ-জাহাজের স্পটলাইট, লেজার লাইটে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ। এ ছাড়া প্লাস্টিক ও বর্জ্য পানিতে ফেলায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। অথচ করোনার সময়ে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ থাকায় সুন্দরবন নতুন রূপ পেয়েছিল। হয়ে উঠেছিল সতেজ। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে সংখ্যাবৃদ্ধির ধারণা করেছিল বন বিভাগ।

সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রকৃতিবিদ খসরু চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি স্থানীয় কিছু লঞ্চ-হোটেলের মালিক পর্যটন চালু করে বন বেহাল করছেন। ধারণক্ষমতার বেশি পর্যটক বনে যাচ্ছেন। বনের অভয়ারণ্যগুলো পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে, যা দুর্ভাগ্যজনক। মাইক বাজছে, উচ্ছিষ্ট খাবার-বর্জ্য পানিতে ফেলা হচ্ছে। বন বিভাগের মুষ্টিমেয় কর্মচারীর পক্ষে এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সুন্দরবনকে পিকনিক স্পট বানানো হয়েছে। সেটা বদলাতে হবে। প্রথম কথা হলো, সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পর্যটকবাহী লঞ্চগুলোতে প্লাস্টিক নেওয়া, জোরে গান বাজানো, লেজার লাইট আর স্পটলাইট নেওয়া এবং ইঞ্জিনচালিত জাহাজের শব্দ থামাতে হবে। ট্যুরিস্ট পুলিশকে পরিবেশসম্মত পর্যটনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

জানা গেছে, শখানেক ট্যুর অপারেটর সুন্দরবনে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লঞ্চ ও জাহাজ রয়েছে। ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) হিসাবে, খুলনা ও মোংলা থেকে প্রায় ৫৫টি লঞ্চ ও জাহাজ পর্যটকদের সুন্দরবনে নিয়ে যায়। গড়ে ৭ থেকে ২০ হাজার টাকার প্যাকেজ রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির। বিদেশিদের জন্য প্যাকেজ ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার বাজার।

টোয়াসের সভাপতি মঈন জমাদ্দার বলেন, ‘আমাদের একেকটি লঞ্চে ৭৫ জনের বেশি পর্যটক নেওয়া যায় না। কিন্তু বিভিন্ন সময় বড় জাহাজে পাঁচ শতাধিক মানুষ উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে বনে আসে। তারা প্রচুর আবর্জনাও ফেলে যায়। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। টোয়াসের পক্ষ থেকে সব আবর্জনা ব্যাগে ভরে নিয়ে আসা হয়।’

ট্যুর অপারেটররা বলছে, সুন্দরবন ঘিরে দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা গত এক দশকে বাস্তবায়িত হয়নি। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকা, কটকা-কচিখালী পয়েন্টগুলোতে অনিরাপদ কাঠের জেটি, নারী ও শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামাগার ও টয়লেট না থাকায় আগ্রহ কমছে পর্যটকদের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পর্যটকের বনে ঢোকার ফি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা।

হলিডেজ শিপিং লাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক আবু ফয়সাল মো. সায়েম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কম টাকায় পর্যটকদের সেবা দিতে চাই। কিন্তু ফি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে তা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বনে নামা ও ঘোরাঘুরির সুবিধা বাড়েনি। জাহাজে ওঠা-নামায় পর্যটকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

টোয়াসের সভাপতি মঈন জমাদ্দার বলেন, সুন্দরবনে পর্যটনের অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বনে ঢোকার ফি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ করার পরও পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ সূত্র জানায়, সবশেষ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮০ টাকা। বিগত বছরগুলোর চেয়ে রাজস্ব বাড়লেও কমেছে পর্যটক। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবন ভ্রমণের ফি বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ জায়গাগুলোয় দেশি পর্যটকের জন্য জনপ্রতি প্রতিদিনের ভ্রমণ ফি ৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। বিদেশি পর্যটকের জনপ্রতি ফি দিনপ্রতি এক হাজার থেকে বেড়ে দুই হাজার টাকা হয়েছে। সুন্দরবনের ভেতরে কটকা, কচিখালী, নীলকমল, হিরণ পয়েন্ট, হাড়বাড়িয়া, পুষ্পকাঠী, মান্দারবাড়িয়া, হলদেবুনিয়ার মতো অভয়ারণ্যে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের প্রতিদিনের ভ্রমণ ফি যথাক্রমে ১৫০ ও ১ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে যথাক্রমে ৩০০ ও ৩ হাজার টাকা হয়েছে। তিন দিনের ভ্রমণ ফি দেশিদের জন্য ভ্যাটসহ ১ হাজার, বিদেশিদের প্রায় ১১ হাজার টাকা।

তবে খুলনা বিভাগীয় বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো আজকের পত্রিকাকে বলেন, ১৩ বছর আগের তালিকা হালনাগাদ করে রাজস্ব আদায়ের নতুন নিয়ম করা হয়েছে। এ জন্য পর্যটক কমার আশঙ্কা নেই। বন নিয়ে নানামুখী অভিযোগের প্রমাণ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, সুন্দরবনে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পর্যটন হয়। অন্য পর্যটন এলাকার চেয়ে সুন্দরবনে অবকাঠামো তুলনামূলক ভালো। মহাপরিকল্পনায় সুন্দরবনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পর্যটনের লঞ্চ নদীর মধ্যে থাকে। কেউ বনে ওঠে না। পর্যটনের কারণে পরিবেশ তেমন দূষিত হয় না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত