Ajker Patrika

ব্যতিক্রমী নির্বাচনে কাঠগড়ায় ইভিএম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ০৯: ১৫
ব্যতিক্রমী নির্বাচনে কাঠগড়ায় ইভিএম

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল, যা অনেকটাই ব্যতিক্রমী। কোনো ধরনের অনিয়ম-সহিংসতা ছাড়াই দীর্ঘদিন বাদে বড় কোনো ভোট শেষ হলো। ভোটার, রাজনীতিকসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেন, যে কারণেই হোক দীর্ঘদিনের মধ্যে এটাই সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। তবে সারা দিন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হওয়ার পরেও মাত্র ৫০ শতাংশ ভোট পড়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি এই নাসিক নির্বাচনে কোনো ধরনের কারসাজি বা কারচুপি না হলেও ইভিএমে ধীর গতির কারণেই এত কম ভোট পড়েছে। নারায়ণগঞ্জের মতো এমন একটা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, অভ্যন্তরীণ অভিবাসনসহ কয়েকটি বাস্তবসম্মত কারণে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ শিল্পনগরী হওয়ায় এখানে কাজের জন্য প্রতিবছর নাগরিকেরা আসেন। এখানেই ভোটার হন। কিন্তু গত কয়েক বছরে নতুন ভোটার হওয়া অনেকের কর্মক্ষেত্র বদল হওয়া কিংবা চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার কারণে তারা আর সিটি করপোরেশনের ভোট দেওয়ার জন্য আসেননি। আরেকটা কারণ হচ্ছে-গত দেড়-দুই বছরে করোনা এবং অন্য অসুস্থতাজনিত কারণে অনেক ভোটারের মৃত্যু হয়েছে। এই সব মিলিয়ে কমে যাওয়া ভোটারের সংখ্যাটা ৫ শতাংশ বা তার বেশি।

অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ও মৃত্যু ছাড়াও নাসিক নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির কমার পেছনে একটি রাজনৈতিক কারণও দাঁড় করিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, একটা বড় রাজনৈতিক গোষ্ঠী নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে তাদের ‘ডেডিকেটেড’ কিছু ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাননি। এটাও একটা বড় কারণ।

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়ার পেছনে নানা যুক্তি থাকলেও নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রফিউর রাব্বী দুষলেন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারকে। তাঁর দাবি, নাসিক নির্বাচনে ৭৫ থেকে ৭৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে পারতেন। কিন্তু ইভিএমের ধীর গতির কারণে কেন্দ্র থেকে অনেককে ভোট না দিয়েই বেরিয়ে যেতে হয়েছে। নাসিক নির্বাচনে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলও না বলেও মনে করছেন তিনি।

রফিউর রাব্বী বলেন, অনেকে ২-৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে পারেননি। বাড়ি চলে গেছেন। আঙুলের ছাপ মেলেনি। একেকজনের ছাপ মেলাতে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট লেগেছে। সামগ্রিকভাবে ইভিএম নিয়ে এমনিতেই সর্বত্র একটা বিতর্ক আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে। সরকার চাইলে ইভিএমে ভোটের ফলাফল নিজের মতো করে তৈরি করতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সরকার চেয়েছে বলেই নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তাঁর মতে, এটা সরকারেরই কৌশল। তিনি বলেন, ‘দেশে-বিদেশে সরকার নানাভাবে চাপের মুখে আছে। এই চাপকে প্রশমিত করতেই সরকার নাসিক নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কোনো চেষ্টা করেনি। অন্যদিকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সরকার দলের তারকা প্রার্থী থাকায় জয়ের বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চয়তা আগে থেকেই ছিল।

বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সরকার এটা করেছে। যাতে করে জনগণের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, এই সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।

ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পরেও কম ভোট পড়ার কারণ হিসেবে তিনি মোটা দাগে করোনা পরিস্থিতি ও ইভিএমকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, নাসিক নির্বাচনে ব্যবহার করা ইভিএম অত্যন্ত নিম্নমানের। এই যন্ত্রের কারণে ভোটগ্রহণ বিলম্বিত হয়েছে, নানা জটিলতায় ভোটের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

তবে ফলাফল প্রকাশের পর পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেছেন, ‘জনগণ আমাকে নির্বাচনে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে। সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ইভিএমের কারচুপির জন্য আমার পরাজয় হয়েছে। এই পরাজয়কে আমি পরাজয় মনে করি না।’

এদিকে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, এই সরকারের আমলে সুষ্ঠু ভোট আশা করা যায় না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘এই সরকারের আমলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়? এই কথা শুনলে পশু-পাখিরাও হাসবে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অনিয়মকে নিয়ম বলারও তো লোক আছে।’

সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, ভোট ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সেই বিষয়টিই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। বর্তমান ভোট ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের যে অনাস্থা সেটি ভোট কম পড়ার মধ্যেই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে আপনারা দেখেছেন কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা ভোটের দুই দিন আগে গিয়ে ডিসি, এসপিদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। ওই রুদ্ধদ্বার কী আলোচনা হয়েছে সেগুলো তো আমরা জানি না। আর ইভিএমে নানা রকম কারচুপিরও ব্যাপার থাকে। যেটা খালি চোখে দেখা যায় না।

নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুব সুন্দর হয়েছে। ইভিএম-এর যান্ত্রিক ত্রুটির কথা স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, ইভিএমে টেকনিক্যাল সমস্যা থাকতেই পারে। এটা কোনো অভিযোগের ভিত্তি হতে পারে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত