কূটনীতি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা

চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১১: ০৯

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়ি পরিদর্শন শেষে বেরিয়ে আসার সময় বাইরে একদল মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করে। এরপর তিনি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

সুমন ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর পরিবারের দাবি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তাঁকে তুলে নিয়ে গেছেন। তাঁর বোন সানজিদা ইসলাম গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়কারী। তিনি জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন তাঁদের বাসায় যান, তখন বাইরে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ‘মায়ের কান্না’ নামের আরেকটি সংগঠনের কিছু ব্যক্তি। ‘মায়ের কান্না’ ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি, কারাদণ্ডের শিকার ও চাকরিচ্যুত সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন।

এই ঘটনার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক বিরোধও চলছে।

প্রশ্ন উঠেছে কূটনীতিকদের অধিকারের সীমা নিয়ে। তাঁদের কর্মতৎপরতা নিয়ে। একজন রাষ্ট্রদূত বিদেশি নাগরিক। তিনি চাইলেই বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক নেতার মতো চলাফেরা করতে পারেন না। ইচ্ছে হলেই কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে বক্তব্য রাখতে পারেন না। আবার ইচ্ছে হলেই কোনো দলের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারেন না। তাঁকে সব দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান সদ্ভাব নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দায়িত্ব পালনকারী অনেক কূটনীতিক ফ্রি-স্টাইলে চলেন, ফ্রি-স্টাইলে কথা বলেন। তাঁদের কথা ও তৎপরতা অনেক ক্ষেত্রেই সব রকম কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়।

এর জন্য অবশ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বই দায়ী। আমাদের দেশে বিরোধী দল নিজের শক্তির ওপর আস্থাশীল নয়। তারা কূটনীতিকদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি মনে করে। কূটনীতিকদের কাছে সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করে। সরকারও নিজেদের নানা দুর্বলতা ঢাকতে কূটনীতিকদের সমীহ করে চলে। ফলে কূটনীতিকেরা নিজেদের ‘নিধিরাম’ ভাবা শুরু করেন; যা কূটনীতির মূল দর্শনের সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়।

প্রসঙ্গত, ইংরেজি ‘ডিপ্লোমেসি’র বাংলা করা হয়েছে কূটনীতি। কূট শব্দটি বাংলা ভাষায় নেতিবাচক হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। কূট মানে হচ্ছে কুটিল (কূটবুদ্ধি); জটিল, দুর্বোধ্য (কূটপ্রশ্ন) ; মিথ্যা, কপট, শঠ (কূটচরিত্র) ; জালিয়াতি, জোচ্চুরি, কারসাজি বা ঘোরপ্যাঁচযুক্ত (কূটচাল)। অভিধান মতে, কূটনীতি হচ্ছে কুটিল নীতি; কপটতা; কৌশলপূর্ণ রাজনীতি (প্রধানত এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের)। সেই দিক থেকে ‘ডিপ্লোমেসি’ শব্দের অর্থ হিসেবে কূটনীতি শব্দটি কিছুটা বেমানান। একজন মানুষ কূট হলেও হতে পারেন। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের নীতি কী করে কূট বা নেতিবাচক হয়?

কূটনীতির মানে যা-ই হোক না কেন, বর্তমান যুগ হচ্ছে কূটনীতির যুগ। সবকিছুতেই ‘কূটনীতি’ কথাটা ব্যবহার করা হয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যেমন কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা বলা হয়, আবার করোনার টিকার জন্যও যথাযথ ‘কূটনৈতিক উদ্যোগের’ কথা বলা হয়। এভাবে তেল কূটনীতি, জল কূটনীতি, সমুদ্র কূটনীতি, টিকা কূটনীতি, অভিবাসন কূটনীতি, জলবায়ু কূটনীতি, বাণিজ্য কূটনীতি, অস্ত্র কূটনীতি ইত্যাদি নানা কূটনীতির কথা শোনা যায়। বর্তমানে কূটনীতির মারপ্যাঁচে যেমন এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে ঘায়েল করছে, আবার কূটনীতির জোরে সুবিধাও আদায় করছে।

কূটনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ডিপ্লোমেসি’ শব্দটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘ডিপ্লোন’ থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। ‘ডিপ্লোন’ মানে হচ্ছে ভাঁজ করা। কাপড়চোপড় ভাঁজ করে রাখার মতো রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভাঁজ করে রাখা থেকেই কি এ শব্দের উৎপত্তি? হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই! কূটনীতি ব্যাপারটি অত্যন্ত পুরোনো। রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতির ধারণাও এসেছে। প্রাচীন গ্রিসের বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। প্রয়োজনে সেই সব নগররাষ্ট্রের মধ্যে দূত বিনিময় হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতেও দূত বিনিময়ের রীতি প্রচলিত ছিল। পঞ্চদশ শতক থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রে দূতাবাস স্থাপন শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ফরাসিরা সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় আলোচককে বোঝার জন্য ‘কূটনীতিক’ (কূটনৈতিক) শব্দটি ব্যবহার শুরু করে।

আধুনিক বিশ্বে কূটনীতি বলতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক বোঝায়। কূটনীতির সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক নিবিড়। নিজ নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও অন্যান্য প্রয়োজনে প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে। কূটনীতির মাধ্যমে সেই নীতি রূপায়িত হয়।

কূটনীতি আসলে সহজ নয়। এটা অত্যন্ত জটিল একটা কাজ। ইংরেজি ভাষায় ডিপ্লোমেসি শব্দটির একটি বহু প্রচলিত সংজ্ঞা পাওয়া যায়।সংজ্ঞাটি হলো, যখন তুমি লোকজনকে বোঝাতে পারো যে, যে জিনিসটা তুমি পাবে না, সেটা তুমি মোটেই চাও না—সেই কলাকৌশলের নামই ডিপ্লোমেসি। এই সংজ্ঞার মতো কূটনীতিও আসলে খুবই জটিল একটি কাজ। এর ভাব আলাদা, ভাষা আলাদা। উদ্দেশ্যও আলাদা।ফ্রান্সে প্রচলিত একটি কথা আছে, একজন নারীর সঙ্গে একজন ডিপ্লোম্যাটের পার্থক্য কী?

যদি কোনো নারী ‘না’ বলেন, তার মানে ‘হয়তো’, তিনি যদি ‘হয়তো’ বলেন, তাহলে তার মানে হচ্ছে ‘হ্যাঁ’, আর তিনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে তিনি কোনো নারীই নন!

ডিপ্লোম্যাটের ব্যাপারটা ঠিক বিপরীত। কোনো ডিপ্লোম্যাট যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তার মানে ‘হয়তো’, তিনি যদি ‘হয়তো’ বলেন, তাহলে তার মানে হচ্ছে ‘না’, আর তিনি যদি ‘না’ বলেন, তাহলে তিনি কোনো ডিপ্লোম্যাটই নন!

আসলে কূটনীতি হচ্ছে একধরনের আর্ট। একসময় কূটনীতি বলতে কেবল একটি দেশের লাভের কথা ভাবা হতো। বর্তমানে কূটনৈতিক সম্পর্ক পারস্পরিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে পরিচালনা করা হয়। আধুনিক যুগে বৈদেশিক সম্পর্ক চাট্টিখানি বিষয় নয়। সম্রাট আকবরের সময় অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো-মন্দে বিশেষ কিছু আসত-যেত না। কিন্তু একালে আসে-যায়। কূটনীতি একালে এক কঠিন বিষয়। ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কই হোক বা বন্ধুপ্রতিম সম্পর্কই হোক, মনে করার কারণ নেই যে সবাই সব সময় ভাইয়ের মতো মমতা মাখানো বা বন্ধুর মতো অন্তরঙ্গ আচরণ করবে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে। বৈদেশিক সম্পর্ক পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর। আমি তোমাকে দেব, তুমি আমাকে দেবে। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রেম-প্রীতির ব্যাপার নয়; দেওয়া-নেওয়ার বিষয়; মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার বিষয়।

কূটনীতি আসলে কৌশলের খেলা। কূটনীতির ভাষাও তাই আলাদা। কূটনীতির ভাষা সাধারণ ভাষা থেকে খানিকটা ভিন্ন হয়ে থাকে, সেটা সবার জানা। আমরা অনেক সময় ‘কূটনীতির মারপ্যাঁচ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে থাকি। আপনি কিছুই বললেন না, নীরব থাকলেন—তাতেও কিন্তু আসল কথাটি বলা হয়ে যায়। আবার একটি বা দুটি শব্দ বললেন নিছক কৌতুকের ছলে, তাতেও কাজ হাসিল হয়ে যেতে পারে।

কূটনীতিতে কতগুলো শব্দ বহুল ব্যবহৃত। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় সমার্থক সেই শব্দগুলো (জারগন) কূটনীতিকদের মুখস্থ। এই যেমন, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু, সমঝোতা, কমফোর্ট জোন, ডায়ালগ, উইন-উইন পজিশন ইত্যাদি। এ ধরনের আরও কিছু শব্দ আছে, যার মূল সুর হলো সহযোগিতা। দ্বিপক্ষীয় হোক বা বহুপক্ষীয়, দ্বিরাষ্ট্রীয় হোক বা বহুরাষ্ট্রীয় অথবা জোটকেন্দ্রিক; কূটনীতি শুরু হয় সহযোগিতার নাম নিয়েই।

সহযোগিতার ইস্যু ছাড়াও কূটনীতিতে আরেকটি শব্দের বেশ কদর—‘বন্ধুত্ব’! মোটামুটি সব দেশের কূটনৈতিক পরিভাষায় এ শব্দটির গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ব্যবহার রয়েছে। কূটনৈতিক নীতিমালার বাইবেল হিসেবে পরিচিত ভিয়েনা কনভেনশনেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই বন্ধুত্বের কথাই বারবার বলা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় তো বটেই, আঞ্চলিক জোটগুলোও বেশ কায়দা করে এবং নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।

ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘কূটনীতি হলো এমন একটা আর্ট যে তুমি কাউকে জাহান্নামে যাও বলবে এমনভাবে, যেন সে তোমার কাছে এসে সেখানে যাওয়ার ঠিকানা খোঁজ করে।’ আর আড়াই হাজার বছর আগে চীনা সমর বিশেষজ্ঞ সান জু পরামর্শ দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সর্বোত্তম পথ হলো, একটা গুলি খরচ না করেও শত্রুকে ঘায়েল করা।

আমাদের কূটনীতি যদিও সেই পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনি। আমরা এখন পর্যন্ত বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, অভিন্ন স্বার্থ, শান্তি, কল্যাণ ইত্যাদি শব্দ নিয়েই নাড়াচাড়া করি। আমাদের কূটনৈতিক মান নিয়ে যেমন ভাবা দরকার, একই সঙ্গে আমাদের দেশে নিযুক্ত কূটনীতিকদের ভূমিকা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা দরকার।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত