বিশেষজ্ঞ মত: পরিবর্তন কেন উদ্বিগ্ন করে

সামিনা লুৎফা, শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০: ৪৪
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১: ০৬

বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি, শিক্ষাক্রমের ভালো-খারাপ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পাঠদানের সত্যি বা বানানো ভিডিও চিত্র সংক্রামিত করেছে পুরো নেট দুনিয়া। অভিভাবক-শিক্ষকসহ একটি পক্ষ এই শিক্ষাক্রম বাতিল করতে মরিয়া।

তবে সরকার অনড় অবস্থানে যে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করবেই। এর মধ্যে আন্দোলনের অপরাধে একাধিক অভিভাবক ও শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন, অজ্ঞাতসংখ্যক ব্যক্তির নামে মামলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত মুক্ত আলোচনা কর্তৃপক্ষ বাতিল করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আমাদের বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমাজ উদ্বিগ্ন এবং সেই উদ্বেগকে পাত্তা দিচ্ছে না সরকার।

সমাজে পরিবর্তন হয় দুই রকমের—বৈপ্লবিক এবং অবিরাম ছোট ছোট পরিবর্তনের প্রবাহ দিয়ে। সাধারণত শিশুদের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ভালো ফল দেয় না। আবার ঘরে যে ভাষা, অভ্যাস, মূল্যবোধ তৈরি হয়; সেটার সঙ্গে সাংঘর্ষিক মূল্যবোধ দিয়ে তাকে ছোঁয়া সহজ হয় না, প্রয়োজন হয় দক্ষ শিক্ষকের; যার অভাব আছে আমাদের। আর অভিভাবকেরা যদি আপনার ‘উন্নত’ শিক্ষাক্রম মেনে না নেন (কারণ, তারা হয়তো জানেন না যে অনভ্যস্ত সিলেবাসের নতুন ব্যবস্থা কী করে কাজ করবে), বা অজানা অনিশ্চয়তা থেকে ভীত হয়ে পড়েন বা শিক্ষাক্রমের দর্শনের সঙ্গে একমত না হন, তাহলে এটা কাজ করবে না।

ধরা যাক, যে অভিভাবক সাংস্কৃতিকভাবে নাচ-গান-শিল্প-সংস্কৃতিকে ‘বেদাত’ এবং পরিত্যাজ্য বলে জানেন বা কায়িক শ্রমকে নিচু শ্রেণির ভাবেন, তাঁর মূল্যবোধ না বদলে ‘শিল্প-সংস্কৃতি’ এবং ‘জীবন-জীবিকা’ নামের বিষয় সব স্তরে অন্তর্ভুক্ত করার মানে হলো, সরকার যাদের জন্য শিক্ষাক্রম বানিয়েছে, তাদের চেনে না। মানুষের মূল্যবোধ স্মার্টফোনের মতো অল্পে বদলায় না, বহু বছরের ধীর ও ক্রম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বদলায় এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে গেলে সাংস্কৃতিক পশ্চাদপসরণ (কালচারাল ল্যাগ) তৈরি হতে পারে। অভিভাবকদের ক্ষেত্রে যে সংযোগহীনতা তৈরি হয়েছে, ফলে তাঁরা সরকারের শিক্ষাক্রমে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। তাঁদের আস্থায় নেওয়া দরকার।

ফিনল্যান্ডে সফল হয়েছে বলে বাংলাদেশেও সফল হবে, এমনটা শোনা গেলেও আসলে দেখা গেল, সেই মডেলেও মাধ্যমিকের উচ্চস্তরে বেশি বিষয় আছে, বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে, সর্বোপরি সেখানে আছে শিক্ষকদের উচ্চ মর্যাদা, বেতন এবং বহু বছরের অবিরাম নিরীক্ষা ও সামাজিক শিক্ষণের মাধ্যমে অভিভাবক-শিক্ষার্থী-শিক্ষকের যৌথ প্রায়োগিক জ্ঞান। আমাদের আছে শিক্ষায় জিডিপির অতি সামান্য বরাদ্দ, শিক্ষকদের দরিদ্র বেতনকাঠামো, অনিশ্চিত রাজনৈতিক চাপ, ম্যানেজিং কমিটি নামের উৎপাত, যা শিক্ষকদের অমানবিকভাবে মর্যাদাহীন চাকুরেতে পরিণত করে রাখে। এই শিক্ষকেরা এলাকার প্রভাবশালীদের সন্তানদের ক্রম মূল্যায়নে বায়াসড হতে বাধ্য হতে পারেন। কী করে এসব সমস্যা তাঁরা পাশ কাটাবেন, তার জন্য তাঁদের না আছে সামাজিক পুঁজি, না আছে অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ।

দেশের সব জায়গায় ইন্টারনেটের সার্ভিস ভালো নয়, সাইবার নিরাপত্তা নেই, শিশুদের ডিভাইসমুখী হওয়ার কুফলও অজানা নয়। আবার গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা উপকরণ ক্রয় এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে বলে আশঙ্কা। এ থেকে দুটো ফল হতে পারে—অনগ্রসর এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিশুরা ঝরে পড়বে বা কম খরচে অন্য মাধ্যমমুখী হবে।

ঝরে না পড়ে থাকলেও এই অভিজ্ঞতামুখী শিক্ষার অন্যান্য খরচ দিতে না পেরে তারা পিছিয়ে পড়বে। ডিভাইস ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বা সাংস্কৃতিক পুঁজি না থাকার দরুন তারা ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার হবেন; ধনবান পরিবারের সন্তানদের থেকে কম আয়ের মানুষের সন্তান পিছিয়ে যাবে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য অনতিক্রম্য হয়ে উঠবে।

একজন অভিভাবক ও শিক্ষক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে অভিজ্ঞতানির্ভর জ্ঞানার্জনের যে দর্শনকে এই শিক্ষাক্রমের মূলমন্ত্র করা হয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য এবং এটাই আমাদের দরকার। কিন্তু ওপরের শ্রেণিতে বিজ্ঞানশিক্ষাকে সংকুচিত করা, প্রযুক্তিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া এবং মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসার জন্য আলাদা করে বিষয় নির্বাচনের সুযোগ না রাখা আত্মঘাতী এবং পরিত্যাজ্য। এসব বিষয়সহ আরও কিছু জিনিস পরিবর্তন করে, ধীরে এবং পর্যায়ক্রমে এ শিক্ষাক্রমকে আত্মস্থ করার সুযোগ দিতে হবে। জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাড়াহুড়া করা যাবে না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত