মামুনুর রশীদ
আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদ দেখার এখন আর সুযোগ নেই। ১৯ সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরাসহ নানা টেলিভিশনে মূল সংবাদ রানির বিদায় এবং তৃতীয় চার্লসের সিংহাসন আরোহণ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এখনো রাজতন্ত্র আছে। পাশাপাশি এসেছে গণতন্ত্র। কিন্তু এ রকম রাজতন্ত্রের বন্দনা আর কোথাও নেই। এ রকম আরেকবার দেখেছিলাম প্রিন্স ডায়ানার মৃত্যুর পর। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম একেবারে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রানিকে তখন খুব অসহায় লাগছিল। সংবাদমাধ্যমে ডায়ানাকে বলা হয়েছিল ‘কুইন অব হার্টস’। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দুবার ঢাকায় এসেছিলেন। প্রথমবার ১৯৬১ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৮৩ সালে। দুবারই ছিল সামরিক শাসন। একবার আইয়ুব খান, অন্যবার জেনারেল এরশাদ। দুবারই দেশে গণতন্ত্র ছিল না। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে রানিকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। খণ্ডিত ভারতবর্ষ কেমন আছে, সেটা দেখার জন্য তিনি এসেছিলেন? নাকি তাঁর প্রজারা কেমন আছেন, তা-ই ছিল তাঁর দেখার বিষয়? রানির দুটি সফরই ছিল মূলত কমনওয়েলথে ব্রিটিশরাজ কতটা শক্তিশলী আছে, তা দেখার জন্য এবং একটা বড় আত্মতৃপ্তি নিয়েই তিনি দেশে ফিরেছেন। দেশের মানুষের ভেতরটা দেখার কোনো আগ্রহ ও প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি। মেরি অ্যান্ডারসনে করে নদীভ্রমণ এবং গাজীপুরের গ্রামের উৎসব দেখে তিনি একটা বড় আনন্দ নিয়েই দেশে ফিরলেন। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন নিয়ে অনেক আলোচনা, বইপুস্তক প্রকাশ হয়েছে। সেই ১৭৭৭ সাল থেকে বাঙালিরা লন্ডনযাত্রা শুরু করেছে। উচ্চবিত্তের সন্তানেরা লেখাপড়া করতে ইংল্যান্ড যাবে—এটা কালক্রমে প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উচ্চতর শিক্ষা এবং সংস্কৃতি তাদের আকৃষ্টও করত। সেই সময়ে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর শুধু ইংল্যান্ড গেলেনই না, তাঁদের মৃত্যুও হলো সেখানে। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ গেছেন, আবার ফিরেও এসেছেন। আর ডাক্তারি পড়ে বড় ডাক্তার হয়েও অনেকে ফিরে এসেছেন। আর এসেছেন ভূরি ভূরি ব্যারিস্টার। তাঁদের মধ্যে আছেন গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরুসহ অনেক আইনজীবী, যাঁরা পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতির হালটা ধরেছিলেন। তাঁরা ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছিলেন পেশাগত সার্টিফিকেটের সঙ্গে দেশপ্রেমের চিন্তা। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যার সূচনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইংরেজি জানা একটা সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। হিন্দি, উর্দুও কিছু পরিমাণে চলত আর সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর প্রদেশ বাংলায় চলত বাংলা। কিন্তু কালক্রমে যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠল ইংরেজি। অফিস-আদালতে ইংরেজিই চলত। ফলে ইংরেজি ভাষাভাষী ভারতীয়রা সর্বক্ষেত্রে একটা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। দেশের রাজনীতি মূলত চলে যায় ভারতীয় আইন ব্যবসায়ীদের হাতে এবং এই আইন ব্যবসায়ীরা জনগণের সঙ্গে একেবারেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। রাজনীতিতে তাঁদের প্রধান কাজ ছিল দেনদরবার এবং ইংরেজি কাগজে লেখালেখি। ইংরেজরা কোনো প্রতিভাবান বা সম্ভাবনাময় ব্যক্তি দেখলেই তাকে নাইটহুড, লর্ড বা স্যার উপাধিতে ভূষিত করত। পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনীতিতে আগমনের পর উপাধিগুলো হয় খান বাহাদুর, খান সাহেব। হিন্দুদের ক্ষেত্রে রায় বাহাদুর, রায় সাহেব ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে বিপ্লবী ও সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই সময়ে অনেক নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশীয় সামন্ত প্রভু, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের সৃষ্টি করা দোসরদের দ্বারা ইংরেজরা কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম, পরবর্তীকালে যুগান্তর অনুশীলনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ইংরেজদের নিষ্ঠুরতা আজ পর্যন্ত নিপীড়নের একটা বড় উদাহরণ হয়ে আছে। ভারতবর্ষের বাইরে আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে, লাতিন আমেরিকায় এবং খোদ উত্তর আমেরিকায় ইংরেজদের বর্বরতা সর্বজনবিদিত। ভারতবর্ষে তারা এক নতুন ফন্দি আবিষ্কার করে তা হলো, ধর্ম দিয়ে বিভাজন। এটি খুব সহজেই কাজ করে। ভারতীয় জনগণকে বিভক্ত এবং পরস্পরের প্রতি হিংসা একটা চরম আকার ধারণ করে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় জিন্নাহ ও নেহরু সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা উপলব্ধি না করে নিজেরাই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে দেনদরবার অব্যাহত রাখেন। এদিকে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠছে। ইংরেজদের এ দেশে শাসন শুরু করার সময় থেকেই যে বিষয়টি তাদের সামনে আসে সেটি হলো, ভারতবর্ষের বিশাল সম্পদ। ইংরেজ শাসন যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেই বাংলায় লর্ড ক্লাইভের লুণ্ঠন কার্যের শুরু। পরবর্তীকালে বাংলা থেকে দিল্লি পর্যন্ত এই লুণ্ঠন অব্যাহত থাকে। ভারতবর্ষ লুণ্ঠনের ইতিহাস সবারই জানা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন ও নিপীড়নের কাজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারত শাসনের দায়িত্বভার ব্রিটিশ সরকার নিজেরা নিয়ে নেয়। তাতেও লুণ্ঠন ও নিপীড়নের সমাপ্তি ঘটে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে আগে ধুরন্ধর ইংরেজ বুঝতে পারে যে তাদের ঔপনিবেশিকের কাল শেষ হয়ে এসেছে। তাদের সৌভাগ্য, তত দিনে তারা বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে তাঁবেদার ও সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি শেষ করে এনেছে। তাই এ দেশ ত্যাগ করলেও তাদের লুণ্ঠনের হাত সর্বত্র বিরাজ করবে। এর মধ্যে একটা বড় সুযোগ এনে দিল সাম্প্রদায়িকতা। ভারত ভাগ এক সুবর্ণ সুযোগ। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে দুটি দেশ বানালে তাদের মধ্যে কলহের শেষ হবে না; বরং তা ফুলেফেঁপে উঠবে। দেখা গেল দুই সম্প্রদায় পরস্পরকে হত্যা করছে, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধাচ্ছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রাণ রক্ষার্থে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে আর এই সুযোগে নিরাপদে ইংরেজরা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। সীমান্ত নিয়ে অনেক ঝামেলাই তারা ঝুলিয়ে রেখে গেল। এর মধ্যে বড় ঝামেলা হলো কাশ্মীর। দেশ বিভাগের পরপরই কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধের পর যুদ্ধ শুরু হলো ভারত ও পাকিস্তানে। বাংলা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ পাঞ্জাবি শাসকদের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিছুই জানতেন না। এখানকার ভাষা-সংস্কৃতির ওপর তাই প্রথমেই কামানটা দেগে বসলেন তিনি। অস্ত্রের বলে পূর্ব বাংলাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। তাই পূর্ব বাংলা ২৪ বছর সংগ্রামের পর স্বাধীন হয়ে গেল। দুটি দেশের বদলে এখন তিনটি দেশ। এসবই ব্রিটিশের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এসে কী দেখলেন? এবং ১৯৮৩ সালে এসেই বা কী দেখলেন? দুটি সময়ে সামরিক শাসন চলছে। জনগণ তার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। বাংলার মনোরম দৃশ্য দেখে তিনি ফিরে গেলেন। গণতন্ত্রহীনতা তথা সামরিক শাসনের কোনো বিরূপতা তাঁর মধ্যে তৈরি হলো না; বরং ওই সময়গুলোতে ইংল্যান্ড থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানে এসে পৌঁছেছে। একদিকে শেক্সপিয়ার, বায়রন, মিল্টন, শেলি, কিটস, বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁদের শিল্প ও দর্শনে শিক্ষিত সমাজ বুঁদ হয়ে আছে আর নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য নিয়ে এ দেশের মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এর ওপরেই তারা গড়ে তুলেছিল কমনওয়েলথ। কমনওয়েলথপ্রধান রানি এবং রাজপরিবার তার কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর জনগণের প্রতি তাকানোর কোনো সময় পান না। ইতিমধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাজতন্ত্র খর্ব হতে হতে কোনো কোনো জায়গায় নিশ্চিহ্নও হয়ে গেছে। রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্যে যে ছবিগুলো আমরা দেখতে পাই, সে এক বিশাল ঐশ্বর্য। যার মধ্যে আমাদের সম্পদও লুকিয়ে আছে। নিপীড়নের এক নিষ্ঠুর উদাহরণ হয়ে আছে আফ্রিকা, যা এখনো শেষ হয়নি। ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা কায়েম করেছে, রেললাইন করেছে—এসব সত্য, কিন্তু যেসব দেশে ঔপনিবেশিক নেই, সেসব দেশে কি এসব হচ্ছে না? তবে একটা বড় উপহার দিয়ে গেছে আমলাতন্ত্র ও দ্বৈতনীতি। নিরীহ, সরল বাঙালিদের মধ্যে এখন গড়ে উঠছে চতুর দুর্নীতিবাজ এবং দেশপ্রেমহীন আমলা ও বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময়কার সেই কালোবাজারি, মুনাফাখোর অসৎ ব্যবসায়ী। ইংরেজরা নিজ হাতে এসব তৈরি করে গেছে। সঙ্গে আরও আছে—সংসদীয় রাজনীতির তুখোড় রাজনীতিবিদ নেতা। যারা সম্পদ বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে খুবই দক্ষ। ইংল্যান্ডের অসংখ্য প্রাসাদের মধ্যে তাদেরও বড় বড় প্রাসাদ আছে। ব্যক্তিগতভাবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি কোনো বিদ্বেষ কারোরই থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং যে ইতিহাসকে ধারণ করেন, তাঁর প্রতি আমাদের কোনো মমতা থাকার কথা নয়। তাই টেলিভিশনের ছবি শুধু ছবি নয়, দীর্ঘশ্বাসও।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদ দেখার এখন আর সুযোগ নেই। ১৯ সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরাসহ নানা টেলিভিশনে মূল সংবাদ রানির বিদায় এবং তৃতীয় চার্লসের সিংহাসন আরোহণ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এখনো রাজতন্ত্র আছে। পাশাপাশি এসেছে গণতন্ত্র। কিন্তু এ রকম রাজতন্ত্রের বন্দনা আর কোথাও নেই। এ রকম আরেকবার দেখেছিলাম প্রিন্স ডায়ানার মৃত্যুর পর। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম একেবারে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রানিকে তখন খুব অসহায় লাগছিল। সংবাদমাধ্যমে ডায়ানাকে বলা হয়েছিল ‘কুইন অব হার্টস’। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দুবার ঢাকায় এসেছিলেন। প্রথমবার ১৯৬১ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৮৩ সালে। দুবারই ছিল সামরিক শাসন। একবার আইয়ুব খান, অন্যবার জেনারেল এরশাদ। দুবারই দেশে গণতন্ত্র ছিল না। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে রানিকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। খণ্ডিত ভারতবর্ষ কেমন আছে, সেটা দেখার জন্য তিনি এসেছিলেন? নাকি তাঁর প্রজারা কেমন আছেন, তা-ই ছিল তাঁর দেখার বিষয়? রানির দুটি সফরই ছিল মূলত কমনওয়েলথে ব্রিটিশরাজ কতটা শক্তিশলী আছে, তা দেখার জন্য এবং একটা বড় আত্মতৃপ্তি নিয়েই তিনি দেশে ফিরেছেন। দেশের মানুষের ভেতরটা দেখার কোনো আগ্রহ ও প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি। মেরি অ্যান্ডারসনে করে নদীভ্রমণ এবং গাজীপুরের গ্রামের উৎসব দেখে তিনি একটা বড় আনন্দ নিয়েই দেশে ফিরলেন। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন নিয়ে অনেক আলোচনা, বইপুস্তক প্রকাশ হয়েছে। সেই ১৭৭৭ সাল থেকে বাঙালিরা লন্ডনযাত্রা শুরু করেছে। উচ্চবিত্তের সন্তানেরা লেখাপড়া করতে ইংল্যান্ড যাবে—এটা কালক্রমে প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উচ্চতর শিক্ষা এবং সংস্কৃতি তাদের আকৃষ্টও করত। সেই সময়ে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর শুধু ইংল্যান্ড গেলেনই না, তাঁদের মৃত্যুও হলো সেখানে। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ গেছেন, আবার ফিরেও এসেছেন। আর ডাক্তারি পড়ে বড় ডাক্তার হয়েও অনেকে ফিরে এসেছেন। আর এসেছেন ভূরি ভূরি ব্যারিস্টার। তাঁদের মধ্যে আছেন গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরুসহ অনেক আইনজীবী, যাঁরা পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতির হালটা ধরেছিলেন। তাঁরা ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছিলেন পেশাগত সার্টিফিকেটের সঙ্গে দেশপ্রেমের চিন্তা। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যার সূচনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইংরেজি জানা একটা সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। হিন্দি, উর্দুও কিছু পরিমাণে চলত আর সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর প্রদেশ বাংলায় চলত বাংলা। কিন্তু কালক্রমে যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠল ইংরেজি। অফিস-আদালতে ইংরেজিই চলত। ফলে ইংরেজি ভাষাভাষী ভারতীয়রা সর্বক্ষেত্রে একটা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। দেশের রাজনীতি মূলত চলে যায় ভারতীয় আইন ব্যবসায়ীদের হাতে এবং এই আইন ব্যবসায়ীরা জনগণের সঙ্গে একেবারেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। রাজনীতিতে তাঁদের প্রধান কাজ ছিল দেনদরবার এবং ইংরেজি কাগজে লেখালেখি। ইংরেজরা কোনো প্রতিভাবান বা সম্ভাবনাময় ব্যক্তি দেখলেই তাকে নাইটহুড, লর্ড বা স্যার উপাধিতে ভূষিত করত। পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনীতিতে আগমনের পর উপাধিগুলো হয় খান বাহাদুর, খান সাহেব। হিন্দুদের ক্ষেত্রে রায় বাহাদুর, রায় সাহেব ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে বিপ্লবী ও সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই সময়ে অনেক নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশীয় সামন্ত প্রভু, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের সৃষ্টি করা দোসরদের দ্বারা ইংরেজরা কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম, পরবর্তীকালে যুগান্তর অনুশীলনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ইংরেজদের নিষ্ঠুরতা আজ পর্যন্ত নিপীড়নের একটা বড় উদাহরণ হয়ে আছে। ভারতবর্ষের বাইরে আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে, লাতিন আমেরিকায় এবং খোদ উত্তর আমেরিকায় ইংরেজদের বর্বরতা সর্বজনবিদিত। ভারতবর্ষে তারা এক নতুন ফন্দি আবিষ্কার করে তা হলো, ধর্ম দিয়ে বিভাজন। এটি খুব সহজেই কাজ করে। ভারতীয় জনগণকে বিভক্ত এবং পরস্পরের প্রতি হিংসা একটা চরম আকার ধারণ করে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় জিন্নাহ ও নেহরু সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা উপলব্ধি না করে নিজেরাই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে দেনদরবার অব্যাহত রাখেন। এদিকে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠছে। ইংরেজদের এ দেশে শাসন শুরু করার সময় থেকেই যে বিষয়টি তাদের সামনে আসে সেটি হলো, ভারতবর্ষের বিশাল সম্পদ। ইংরেজ শাসন যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেই বাংলায় লর্ড ক্লাইভের লুণ্ঠন কার্যের শুরু। পরবর্তীকালে বাংলা থেকে দিল্লি পর্যন্ত এই লুণ্ঠন অব্যাহত থাকে। ভারতবর্ষ লুণ্ঠনের ইতিহাস সবারই জানা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন ও নিপীড়নের কাজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারত শাসনের দায়িত্বভার ব্রিটিশ সরকার নিজেরা নিয়ে নেয়। তাতেও লুণ্ঠন ও নিপীড়নের সমাপ্তি ঘটে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে আগে ধুরন্ধর ইংরেজ বুঝতে পারে যে তাদের ঔপনিবেশিকের কাল শেষ হয়ে এসেছে। তাদের সৌভাগ্য, তত দিনে তারা বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে তাঁবেদার ও সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি শেষ করে এনেছে। তাই এ দেশ ত্যাগ করলেও তাদের লুণ্ঠনের হাত সর্বত্র বিরাজ করবে। এর মধ্যে একটা বড় সুযোগ এনে দিল সাম্প্রদায়িকতা। ভারত ভাগ এক সুবর্ণ সুযোগ। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে দুটি দেশ বানালে তাদের মধ্যে কলহের শেষ হবে না; বরং তা ফুলেফেঁপে উঠবে। দেখা গেল দুই সম্প্রদায় পরস্পরকে হত্যা করছে, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধাচ্ছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রাণ রক্ষার্থে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে আর এই সুযোগে নিরাপদে ইংরেজরা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। সীমান্ত নিয়ে অনেক ঝামেলাই তারা ঝুলিয়ে রেখে গেল। এর মধ্যে বড় ঝামেলা হলো কাশ্মীর। দেশ বিভাগের পরপরই কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধের পর যুদ্ধ শুরু হলো ভারত ও পাকিস্তানে। বাংলা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ পাঞ্জাবি শাসকদের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিছুই জানতেন না। এখানকার ভাষা-সংস্কৃতির ওপর তাই প্রথমেই কামানটা দেগে বসলেন তিনি। অস্ত্রের বলে পূর্ব বাংলাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। তাই পূর্ব বাংলা ২৪ বছর সংগ্রামের পর স্বাধীন হয়ে গেল। দুটি দেশের বদলে এখন তিনটি দেশ। এসবই ব্রিটিশের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এসে কী দেখলেন? এবং ১৯৮৩ সালে এসেই বা কী দেখলেন? দুটি সময়ে সামরিক শাসন চলছে। জনগণ তার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। বাংলার মনোরম দৃশ্য দেখে তিনি ফিরে গেলেন। গণতন্ত্রহীনতা তথা সামরিক শাসনের কোনো বিরূপতা তাঁর মধ্যে তৈরি হলো না; বরং ওই সময়গুলোতে ইংল্যান্ড থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানে এসে পৌঁছেছে। একদিকে শেক্সপিয়ার, বায়রন, মিল্টন, শেলি, কিটস, বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁদের শিল্প ও দর্শনে শিক্ষিত সমাজ বুঁদ হয়ে আছে আর নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য নিয়ে এ দেশের মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এর ওপরেই তারা গড়ে তুলেছিল কমনওয়েলথ। কমনওয়েলথপ্রধান রানি এবং রাজপরিবার তার কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর জনগণের প্রতি তাকানোর কোনো সময় পান না। ইতিমধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাজতন্ত্র খর্ব হতে হতে কোনো কোনো জায়গায় নিশ্চিহ্নও হয়ে গেছে। রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্যে যে ছবিগুলো আমরা দেখতে পাই, সে এক বিশাল ঐশ্বর্য। যার মধ্যে আমাদের সম্পদও লুকিয়ে আছে। নিপীড়নের এক নিষ্ঠুর উদাহরণ হয়ে আছে আফ্রিকা, যা এখনো শেষ হয়নি। ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা কায়েম করেছে, রেললাইন করেছে—এসব সত্য, কিন্তু যেসব দেশে ঔপনিবেশিক নেই, সেসব দেশে কি এসব হচ্ছে না? তবে একটা বড় উপহার দিয়ে গেছে আমলাতন্ত্র ও দ্বৈতনীতি। নিরীহ, সরল বাঙালিদের মধ্যে এখন গড়ে উঠছে চতুর দুর্নীতিবাজ এবং দেশপ্রেমহীন আমলা ও বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময়কার সেই কালোবাজারি, মুনাফাখোর অসৎ ব্যবসায়ী। ইংরেজরা নিজ হাতে এসব তৈরি করে গেছে। সঙ্গে আরও আছে—সংসদীয় রাজনীতির তুখোড় রাজনীতিবিদ নেতা। যারা সম্পদ বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে খুবই দক্ষ। ইংল্যান্ডের অসংখ্য প্রাসাদের মধ্যে তাদেরও বড় বড় প্রাসাদ আছে। ব্যক্তিগতভাবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি কোনো বিদ্বেষ কারোরই থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং যে ইতিহাসকে ধারণ করেন, তাঁর প্রতি আমাদের কোনো মমতা থাকার কথা নয়। তাই টেলিভিশনের ছবি শুধু ছবি নয়, দীর্ঘশ্বাসও।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে