ড. রাশেদা রওনক খান
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে, স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কী ইঙ্গিত করে, চাইলেই কি স্মার্ট হয়ে যাওয়া যায়? একটি রাষ্ট্রের স্মার্ট হয়ে যাওয়ার যে জার্নি, এটা কি খুব সহজ? কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন কি একটি রাষ্ট্রকে স্মার্ট করে তুলতে পারে? তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ হতে আর কী কী প্রয়োজন? কীভাবে সেগুলো অর্জন সম্ভব? এসব প্রশ্ন এখনই বারবার সামনে আসা উচিত, যেন স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা কিছুটা ভেবেচিন্তে পরিকল্পনাগুলো করতে পারেন।
স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য চারটি ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে—প্রথমত, স্মার্ট সিটিজেন অর্থাৎ প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবেন; দ্বিতীয়ত, স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ অর্থনীতির সব কার্যক্রম হবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে; তৃতীয়ত, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, যার মাধ্যমে আমরা পরিচালিত হব; এবং সর্বশেষ বলা হচ্ছে, গোটা সমাজই হবে স্মার্ট সোসাইটি!
আজকের আলোচনা এই স্মার্ট সমাজ নিয়ে। আমি এই ‘গোটা সমাজ’ ধারণার ওপর জোর দিতে চাই। এই যে ‘সব’ বা ‘সবাই’ স্মার্ট হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, আদতে কি এই ‘সবাই’-এর মাঝে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষজনকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা রয়েছে? স্মার্ট সিটিতে কি শহরগুলো সব সবুজ হয়ে উঠবে? দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি কমে যাবে? আর স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক কী রকম হবে? সমাজের সব প্রতিষ্ঠান, চিন্তাভাবনা নারীবান্ধব হয়ে উঠবে? রাস্তাঘাট নিরাপদ হবে; যেখানে ছিনতাই, পকেট মারা, ইভ টিজিং—এসব ঘটবে না? হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল প্রযুক্তি, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এসবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্মার্ট সিটিতে কি মানবসম্পদ উন্নয়নের জায়গা আছে? পরিকল্পনায় যে স্মার্ট বাংলাদেশ, সেই পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন, কতটা দূরে কিংবা কাছে?
ঢাকায় একটু বৃষ্টিতেই যে যানজট আর জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, তা কীভাবে দূরীভূত হবে, সেটি কি আছে স্মার্ট সিটির পরিকল্পনায়? ঢাকার বাতাসে যে বিষাক্ততা আমাদের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে, তার কী হবে? স্মার্ট শহর গড়ে তুলতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান ইত্যাদি নানা নামে রাজউকের যে ভাবনা, তাতে কি নগর দরিদ্রদের সুলভে আবাসন সুবিধা দেওয়ার বিষয় আছে? রাজউকের গড়ে তোলা বহুতল ভবনের ‘টার্গেট ক্লায়েন্ট’ কারা?
স্মার্ট সিটির কেন্দ্রে অবস্থিত ইনফরমাল ইকোনমির ধারক-বাহক, উচ্চবিত্তদের বাসাবাড়ি ও অফিসে যাঁরা কাজ করে স্মার্ট আবহ তৈরি করেন, সেই সুবিশাল ইনফরমাল ও অধস্তন কর্মী বাহিনীর জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা কি এই প্ল্যানগুলোতে আছে? সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দূরে থাক, এসব পরিকল্পনায় তাঁদের শহরের বাইরে থাকার এবং বাইরে থেকে এসে কাজ করার যে চিন্তা করা হচ্ছে, তা কতটা মানবিক হবে? স্মার্ট সিটিতে মানবিকতার জায়গা কোথায় তাহলে?
স্মার্ট সরকার, স্মার্ট প্রশাসন, স্মার্ট পুলিশিং—এসবের চূড়ান্ত রূপ কেমন হবে? ধারণায়নের ক্ষেত্রে বলা যায়, প্রান্তিক পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষকে এসব প্রশাসনিক সার্ভিস প্রদান নিশ্চিত করা। কিন্তু এই পরিকল্পনায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আসলে মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুতি নিয়েছে? উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো, দ্রুত সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আনা—কতটা সম্ভব অর্জন করা? যেমন আমাদের পাসপোর্ট এখন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর এমআরপিতে রূপান্তর করা হচ্ছে; কিন্তু তা করতে গিয়ে নাগরিকেরা কি নানা ধরনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন?
নাকি সরকারের বিভিন্ন অফিসে গিয়ে তাঁদের লাল ফিতাবন্ধ ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নিতে ঘুষ দিতে হয়? ডিজিটাল পদ্ধতি কি কোনোভাবে দুর্নীতিবাজদের মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ঘুষের সংস্কৃতিকে রুখতে পারবে? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বর্তমানে মূল টার্গেট সরকারি চাকরি পাওয়া এবং পাওয়ার পর অনেকে এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্মার্ট চাকরিজীবীরা যদি এভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে থাকেন, তাহলে এই স্মার্টনেসের অর্থ কী দাঁড়াবে?
স্মার্ট রাজনীতির স্বরূপ কেমন হবে এই স্মার্ট বাংলাদেশে? তরুণ রাজনীতিবিদেরা সাধারণের পাশে দাঁড়াতে পারতেন, দিনমজুর, কৃষক, পাটকলশ্রমিক, গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতেন। ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি ছাত্রদের কল্যাণে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্যাণে নিবেদিত হতে পারত।
তাই ভাবি, স্মার্ট বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা স্মার্ট হয়ে উঠবে? তারুণ্যের রাজনীতি তো স্মার্ট হওয়ারই কথা, কিন্তু তা কি হচ্ছে? এখনো তরুণেরা নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষকে মারধর করে, ভাবা যায়? সাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ঘটছে কি তারুণ্যের রাজনীতির, নাকি তারুণ্য ছুটছে ‘বড় ভাই’, ‘সহমত ভাই’ সংস্কৃতিতে? সাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলে এই দেশে ছাত্ররাজনীতির অর্থ কী? কেবল ক্ষমতার সিঁড়ি ভাঙা? তারুণ্য কি ক্ষমতালোভী হয়ে উঠছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না, ঠিকভাবে চলতে পারছে না—সেসব নিয়ে চিন্তা কি ছাত্রসংগঠনগুলোর আছে? জানতে চাওয়ার মতো মন থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষার্থী কতটা কষ্টে আছে, অভাবে আছে, তা জানা সম্ভব, কেবল প্রয়োজন দেখার চোখ আর মানবিক মন। সেসব কি এখনকার স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি শেখায় ছাত্রদের? সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি যদি নজর না থাকে, চিন্তাভাবনা না থাকে; আগ্রহের বিষয় থাকে কেবল পদ-পদবি নিয়ে মারামারি, হানাহানি আর সেই ক্ষমতায়িত পদের দাপট দেখানো, তাহলে কি সেই ছাত্ররাজনীতিকে স্মার্ট রাজনীতি বলা যাবে?
কেবল ছাত্ররাজনীতি নয়, আমরা সাধারণ মানুষও ইদানীং সবকিছুতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে কথা বলি, অন্ধের মতো। যে নিজস্বতা বোধ থাকা প্রয়োজন, তা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের। বড় দুই দলের বাইরেও আমাদের জীবন আছে, সেই জীবনের সবকিছুকে যেন এই দলীয় বিবেচনা দিয়েই ভাবতে শিখেছি। ধরা যাক, ফেসবুকে কেউ স্ট্যাটাস দিল, সেটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মাথায় কাজ করে, এটা কোন দলের পক্ষে যাচ্ছে বা বিপক্ষে যাচ্ছে! যদি পছন্দের দলের পক্ষে যায়, তাহলে বাহবা আর বিপক্ষে গেলে তো কথাই নেই! শুরু হবে নানা অপকথা।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে এসব দেখলে চিন্তিত হতাম না, তরুণদেরও যখন একইভাবে ভাবতে দেখি, তখন ভাবি, পরিবর্তন আসবে কীভাবে, যদি আমরা নিজেরাই পরিবর্তিত না হই? তারুণ্যের চিন্তাভাবনায় স্বকীয়তা না এলে কিন্তু সামনের দিনগুলোতে কোনো আলো থাকবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল রাজনৈতিক ঘৃণা-বিদ্বেষ কিংবা অপপ্রচারের প্ল্যাটফর্ম নয়, ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-মানবতা ছড়িয়ে দেওয়ারও একটি জায়গা হতে পারে। আর এই কাজটি তরুণদেরই, যাদের হাতে আসলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাবি।
স্মার্ট বাংলাদেশ মানেই প্রযুক্তির বিকাশ, যার অনেকটুকুই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্যাশলেস লেনদেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আরও কত নতুন নতুন প্রযুক্তি যে আসছে বা আসবে, তা সময়ই বলে দেবে। একজন সত্যিকারের মানুষ তৈরির জন্য কেবল প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুললেই হবে না, তাকে মানবিক মানুষ হিসেবেও তৈরি করতে হবে। মানবিকতাবিহীন সমাজে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার মানুষের
কল্যাণে আসবে না। স্মার্ট সিটির সিটিজেন কি আধুনিক-মননশীল-সৃজনশীল-নান্দনিকতা চেতনার মানুষ হবে?
আমরা স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসি, তাই আমাদের স্বপ্নে স্মার্ট বাংলাদেশের যে চিত্র আছে, সেখানে ‘সকল’-এর অন্তর্ভুক্তি ঘটুক, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, ধর্ম-শ্রেণি-নির্বিশেষে সবার কথা চিন্তা করেই তৈরি হোক সব পরিকল্পনা। স্মার্ট ইকোনমিতে ফরমাল এবং ইনফরমাল ইকোনমি যেমন থাকবে, তেমনি ফরমাল ও ইনফরমাল বাসস্থানও থাকুক, যেখানে শহরের অতি দরিদ্র মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের আশপাশে বসবাস করার সুযোগ পায়। মানুষ হয়ে উঠুক প্রকৃত অর্থেই স্মার্ট, শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য, প্রকৃত স্মার্টনেস নয়। একজন মানুষ যখন ভেতর থেকে সুন্দর, সাবলীল, দয়ালু, দানশীল, মানবিক, পজিটিভ চিন্তার অধিকারী—তখনই কেবল সত্যিকার অর্থে স্মার্ট হয়ে ওঠে।
এই ধরনের স্মার্ট সিটিজেন তৈরি কীভাবে সম্ভব? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যে হাল, তা কি এই শিক্ষা দেয় আদৌ? তাহলে এই স্মার্ট সিটিজেন কোথায় পাব, তার জন্য কি কোনো পরিকল্পনা করা হচ্ছে বা হয়েছে? নতুন প্রজন্ম এই স্মার্ট সিটিজেনে পরিণত হোক, দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাক, তেমন স্বপ্নই দেখি। দেশ, সরকার, অর্থনীতি, রাজনীতি হোক সকলের, হোক স্মার্ট, তাহলেই স্মার্ট বাংলাদেশের অবয়ব আমরা দেখতে পাব।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে, স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কী ইঙ্গিত করে, চাইলেই কি স্মার্ট হয়ে যাওয়া যায়? একটি রাষ্ট্রের স্মার্ট হয়ে যাওয়ার যে জার্নি, এটা কি খুব সহজ? কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন কি একটি রাষ্ট্রকে স্মার্ট করে তুলতে পারে? তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ হতে আর কী কী প্রয়োজন? কীভাবে সেগুলো অর্জন সম্ভব? এসব প্রশ্ন এখনই বারবার সামনে আসা উচিত, যেন স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা কিছুটা ভেবেচিন্তে পরিকল্পনাগুলো করতে পারেন।
স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য চারটি ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে—প্রথমত, স্মার্ট সিটিজেন অর্থাৎ প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবেন; দ্বিতীয়ত, স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ অর্থনীতির সব কার্যক্রম হবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে; তৃতীয়ত, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, যার মাধ্যমে আমরা পরিচালিত হব; এবং সর্বশেষ বলা হচ্ছে, গোটা সমাজই হবে স্মার্ট সোসাইটি!
আজকের আলোচনা এই স্মার্ট সমাজ নিয়ে। আমি এই ‘গোটা সমাজ’ ধারণার ওপর জোর দিতে চাই। এই যে ‘সব’ বা ‘সবাই’ স্মার্ট হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, আদতে কি এই ‘সবাই’-এর মাঝে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষজনকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা রয়েছে? স্মার্ট সিটিতে কি শহরগুলো সব সবুজ হয়ে উঠবে? দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি কমে যাবে? আর স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক কী রকম হবে? সমাজের সব প্রতিষ্ঠান, চিন্তাভাবনা নারীবান্ধব হয়ে উঠবে? রাস্তাঘাট নিরাপদ হবে; যেখানে ছিনতাই, পকেট মারা, ইভ টিজিং—এসব ঘটবে না? হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল প্রযুক্তি, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এসবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্মার্ট সিটিতে কি মানবসম্পদ উন্নয়নের জায়গা আছে? পরিকল্পনায় যে স্মার্ট বাংলাদেশ, সেই পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন, কতটা দূরে কিংবা কাছে?
ঢাকায় একটু বৃষ্টিতেই যে যানজট আর জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, তা কীভাবে দূরীভূত হবে, সেটি কি আছে স্মার্ট সিটির পরিকল্পনায়? ঢাকার বাতাসে যে বিষাক্ততা আমাদের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে, তার কী হবে? স্মার্ট শহর গড়ে তুলতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান ইত্যাদি নানা নামে রাজউকের যে ভাবনা, তাতে কি নগর দরিদ্রদের সুলভে আবাসন সুবিধা দেওয়ার বিষয় আছে? রাজউকের গড়ে তোলা বহুতল ভবনের ‘টার্গেট ক্লায়েন্ট’ কারা?
স্মার্ট সিটির কেন্দ্রে অবস্থিত ইনফরমাল ইকোনমির ধারক-বাহক, উচ্চবিত্তদের বাসাবাড়ি ও অফিসে যাঁরা কাজ করে স্মার্ট আবহ তৈরি করেন, সেই সুবিশাল ইনফরমাল ও অধস্তন কর্মী বাহিনীর জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা কি এই প্ল্যানগুলোতে আছে? সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দূরে থাক, এসব পরিকল্পনায় তাঁদের শহরের বাইরে থাকার এবং বাইরে থেকে এসে কাজ করার যে চিন্তা করা হচ্ছে, তা কতটা মানবিক হবে? স্মার্ট সিটিতে মানবিকতার জায়গা কোথায় তাহলে?
স্মার্ট সরকার, স্মার্ট প্রশাসন, স্মার্ট পুলিশিং—এসবের চূড়ান্ত রূপ কেমন হবে? ধারণায়নের ক্ষেত্রে বলা যায়, প্রান্তিক পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষকে এসব প্রশাসনিক সার্ভিস প্রদান নিশ্চিত করা। কিন্তু এই পরিকল্পনায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আসলে মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুতি নিয়েছে? উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো, দ্রুত সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আনা—কতটা সম্ভব অর্জন করা? যেমন আমাদের পাসপোর্ট এখন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর এমআরপিতে রূপান্তর করা হচ্ছে; কিন্তু তা করতে গিয়ে নাগরিকেরা কি নানা ধরনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন?
নাকি সরকারের বিভিন্ন অফিসে গিয়ে তাঁদের লাল ফিতাবন্ধ ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নিতে ঘুষ দিতে হয়? ডিজিটাল পদ্ধতি কি কোনোভাবে দুর্নীতিবাজদের মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ঘুষের সংস্কৃতিকে রুখতে পারবে? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বর্তমানে মূল টার্গেট সরকারি চাকরি পাওয়া এবং পাওয়ার পর অনেকে এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্মার্ট চাকরিজীবীরা যদি এভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে থাকেন, তাহলে এই স্মার্টনেসের অর্থ কী দাঁড়াবে?
স্মার্ট রাজনীতির স্বরূপ কেমন হবে এই স্মার্ট বাংলাদেশে? তরুণ রাজনীতিবিদেরা সাধারণের পাশে দাঁড়াতে পারতেন, দিনমজুর, কৃষক, পাটকলশ্রমিক, গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতেন। ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি ছাত্রদের কল্যাণে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্যাণে নিবেদিত হতে পারত।
তাই ভাবি, স্মার্ট বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা স্মার্ট হয়ে উঠবে? তারুণ্যের রাজনীতি তো স্মার্ট হওয়ারই কথা, কিন্তু তা কি হচ্ছে? এখনো তরুণেরা নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষকে মারধর করে, ভাবা যায়? সাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ঘটছে কি তারুণ্যের রাজনীতির, নাকি তারুণ্য ছুটছে ‘বড় ভাই’, ‘সহমত ভাই’ সংস্কৃতিতে? সাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলে এই দেশে ছাত্ররাজনীতির অর্থ কী? কেবল ক্ষমতার সিঁড়ি ভাঙা? তারুণ্য কি ক্ষমতালোভী হয়ে উঠছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না, ঠিকভাবে চলতে পারছে না—সেসব নিয়ে চিন্তা কি ছাত্রসংগঠনগুলোর আছে? জানতে চাওয়ার মতো মন থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষার্থী কতটা কষ্টে আছে, অভাবে আছে, তা জানা সম্ভব, কেবল প্রয়োজন দেখার চোখ আর মানবিক মন। সেসব কি এখনকার স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি শেখায় ছাত্রদের? সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি যদি নজর না থাকে, চিন্তাভাবনা না থাকে; আগ্রহের বিষয় থাকে কেবল পদ-পদবি নিয়ে মারামারি, হানাহানি আর সেই ক্ষমতায়িত পদের দাপট দেখানো, তাহলে কি সেই ছাত্ররাজনীতিকে স্মার্ট রাজনীতি বলা যাবে?
কেবল ছাত্ররাজনীতি নয়, আমরা সাধারণ মানুষও ইদানীং সবকিছুতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে কথা বলি, অন্ধের মতো। যে নিজস্বতা বোধ থাকা প্রয়োজন, তা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের। বড় দুই দলের বাইরেও আমাদের জীবন আছে, সেই জীবনের সবকিছুকে যেন এই দলীয় বিবেচনা দিয়েই ভাবতে শিখেছি। ধরা যাক, ফেসবুকে কেউ স্ট্যাটাস দিল, সেটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মাথায় কাজ করে, এটা কোন দলের পক্ষে যাচ্ছে বা বিপক্ষে যাচ্ছে! যদি পছন্দের দলের পক্ষে যায়, তাহলে বাহবা আর বিপক্ষে গেলে তো কথাই নেই! শুরু হবে নানা অপকথা।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে এসব দেখলে চিন্তিত হতাম না, তরুণদেরও যখন একইভাবে ভাবতে দেখি, তখন ভাবি, পরিবর্তন আসবে কীভাবে, যদি আমরা নিজেরাই পরিবর্তিত না হই? তারুণ্যের চিন্তাভাবনায় স্বকীয়তা না এলে কিন্তু সামনের দিনগুলোতে কোনো আলো থাকবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল রাজনৈতিক ঘৃণা-বিদ্বেষ কিংবা অপপ্রচারের প্ল্যাটফর্ম নয়, ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-মানবতা ছড়িয়ে দেওয়ারও একটি জায়গা হতে পারে। আর এই কাজটি তরুণদেরই, যাদের হাতে আসলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাবি।
স্মার্ট বাংলাদেশ মানেই প্রযুক্তির বিকাশ, যার অনেকটুকুই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্যাশলেস লেনদেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আরও কত নতুন নতুন প্রযুক্তি যে আসছে বা আসবে, তা সময়ই বলে দেবে। একজন সত্যিকারের মানুষ তৈরির জন্য কেবল প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুললেই হবে না, তাকে মানবিক মানুষ হিসেবেও তৈরি করতে হবে। মানবিকতাবিহীন সমাজে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার মানুষের
কল্যাণে আসবে না। স্মার্ট সিটির সিটিজেন কি আধুনিক-মননশীল-সৃজনশীল-নান্দনিকতা চেতনার মানুষ হবে?
আমরা স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসি, তাই আমাদের স্বপ্নে স্মার্ট বাংলাদেশের যে চিত্র আছে, সেখানে ‘সকল’-এর অন্তর্ভুক্তি ঘটুক, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, ধর্ম-শ্রেণি-নির্বিশেষে সবার কথা চিন্তা করেই তৈরি হোক সব পরিকল্পনা। স্মার্ট ইকোনমিতে ফরমাল এবং ইনফরমাল ইকোনমি যেমন থাকবে, তেমনি ফরমাল ও ইনফরমাল বাসস্থানও থাকুক, যেখানে শহরের অতি দরিদ্র মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের আশপাশে বসবাস করার সুযোগ পায়। মানুষ হয়ে উঠুক প্রকৃত অর্থেই স্মার্ট, শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য, প্রকৃত স্মার্টনেস নয়। একজন মানুষ যখন ভেতর থেকে সুন্দর, সাবলীল, দয়ালু, দানশীল, মানবিক, পজিটিভ চিন্তার অধিকারী—তখনই কেবল সত্যিকার অর্থে স্মার্ট হয়ে ওঠে।
এই ধরনের স্মার্ট সিটিজেন তৈরি কীভাবে সম্ভব? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যে হাল, তা কি এই শিক্ষা দেয় আদৌ? তাহলে এই স্মার্ট সিটিজেন কোথায় পাব, তার জন্য কি কোনো পরিকল্পনা করা হচ্ছে বা হয়েছে? নতুন প্রজন্ম এই স্মার্ট সিটিজেনে পরিণত হোক, দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাক, তেমন স্বপ্নই দেখি। দেশ, সরকার, অর্থনীতি, রাজনীতি হোক সকলের, হোক স্মার্ট, তাহলেই স্মার্ট বাংলাদেশের অবয়ব আমরা দেখতে পাব।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে