আবু তাহের খান
পাহাড়ি ঢলের পানি আটকে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার ১৯৫৭-৬২ সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙামাটিতে ২ হাজার ২০০ ফুট দীর্ঘ একটি বাঁধ নির্মাণ করে তার উজানে একটি কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করে। উদ্দেশ্য ছিল দুটি: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও হ্রদকে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের কথিত সেই উদ্দেশ্যের দুটিই সেদিন তাদের দৃষ্টিতে সফল হয়েছিল—স্থাপিত হয়েছিল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও কাপ্তাই হ্রদ।
কিন্তু এর মাধ্যমে তারা রাঙামাটির চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লাখখানেক সদস্যকে বাস্তুচ্যুত করার মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই চোখের ও দেহের জলে ভাসিয়ে এ অঞ্চলে নতুন যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সমস্যার জন্ম দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি আজও হয়নি। এক জটিল ও অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে এখনো এর জের স্থানীয় ও অস্থানীয় সব জনগোষ্ঠীকেই বহন করে যেতে হচ্ছে। এমনকি কখনো কখনো তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকেও স্পর্শ করে যাচ্ছে।
কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও সেখানে একটি হ্রদ গড়ে তোলার সঙ্গে প্রচণ্ড মিল আছে ২০১৬-২০ সময়কালে কিশোরগঞ্জের নিকলীর হাওরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণেরও। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন ছিল একটি বিশাল ‘উন্নয়ন প্রয়াস’, তেমনি হাওরের বুক চিরে উল্লিখিত সড়ক নির্মাণকেও বলা হয়েছে যোগাযোগ অবকাঠামো বিস্তারের ক্ষেত্রে ‘উন্নয়নের নতুন দিগন্ত’।
একইভাবে কাপ্তাই হ্রদ যেমন লাখো পর্যটকের হৃদয়ছোঁয়া আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, তেমনি ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে বছরজুড়ে দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের পরম আরাধ্য এক ভ্রমণস্থল। কিন্তু এর পরের মিলগুলোই কষ্টের। নানা শ্রেণির অগুনতি পর্যটক কাপ্তাইয়ের মনোরম বাঁধ আর চোখজুড়ানো হ্রদের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলেও তাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের বুকচেরা কষ্টের যেমন এতটুকু লাঘব হয়নি, তেমনি ‘উন্নয়নের নতুন দিগন্ত’ সৃষ্টির নামে নিকলীর হাওরে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করে সন্নিহিত এলাকার চরের মানুষদেরও স্থায়ী জলাবদ্ধতার অভিশাপের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ যেন অনেকটা তপ্ত কড়াই থেকে উনুনে নিক্ষেপ।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ওখানকার চরের মানুষেরা আগে শুকনো মৌসুমের পাঁচ-ছয় মাস অন্তত বহু যুগের অভিজ্ঞতায় রপ্ত ধীরগতির পুরোনো যোগাযোগ-কৌশল মেনে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করতে পারত। কিন্তু সড়ক নির্মাণের পর থেকে এখন সারা বছরই তারা ঘরে পানিবন্দী এবং একই ধারায় ফসলের মাঠ ও গবাদিপশুর চারণভূমিও সারা বছরই থাকছে পানির নিচে।
আর ভয়ংকর উন্নয়নের এই ফলাফল দেখে কষ্ট ও অনুশোচনায় দগ্ধ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান স্পষ্টতই বলেছিলেন: ‘এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে।’ এবং এটা তাঁকে বলতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উল্লিখিত সড়কের উচ্ছ্বাসভরা উদ্বোধনের মাত্র ৩ বছর ২২ দিনের মাথায়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেন ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর।
তো এই যখন নিকলীর হাওরের বুকে অবাঞ্ছিত সড়ক নির্মাণের কারণে সেখানকার কৃষকজীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির করুণ চিত্র, তখন পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ওই সড়কের ওপর আঁকা হয় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আলপনা, যা কিছুদিন ছিল দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম প্রসঙ্গ। এরই মধ্যে ২০ এপ্রিলের আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ওই আলপনা আঁকার কারণে ‘ফ্যাকাশে হবে হাওরের শস্য ও মাছ’। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ওই আলপনা আঁকার কাজে ১৬ হাজার লিটার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে।
আর এটি আঁকা হয়েছে বাংলালিংক, এশিয়াটিক মার্কেটিং ও বার্জার পেইন্টসের সৌজন্যে। বৃষ্টির পানিতে ওই রাসায়নিক যখন গলে গলে পার্শ্ববর্তী হাওরের পানিতে মিশবে, তখন একদিকে তা যেমন ব্যাপক ফসলহানির কারণ হবে, অন্যদিকে তেমনি তা সেখানকার কীটপতঙ্গ ও জলজ প্রাণিকুলকেও অবাধে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। তা ছাড়া হাওরে জন্মে এরূপ বিভিন্ন শ্রেণির ঘাস ও অন্যান্য খুদে উদ্ভিদকেও ধ্বংস করে ফেলবে। মোটকথা, বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা ওই আলপনা এখন নিকলীর হাওরের ফসল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ধরনের এক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
পরিবেশের এরূপ মারাত্মক ঝুঁকির কথা চিন্তা করে বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই আলপনা না আঁকার দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি গ্রাহ্য করা হয়নি। তবে ভাগ্য ভালো, ওই প্রতিবাদকে সরকারের পক্ষ থেকে মৌলবাদীদের কাণ্ড বলে অভিহিত করা হয়নি, যা ইদানীং কোনো উদ্যোগ বা বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই করা হয়ে থাকে।
আর পয়লা বৈশাখের মতো একটি সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসব যে এখন ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাভাবনা ও অংশগ্রহণ-ধারার বাইরে গিয়ে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে, নিকলীর হাওরের ফসল ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে সেখানে তিন ব্যবসায়িক কোম্পানির বিজ্ঞাপনভিত্তিক আলপনা আঁকা তারই প্রমাণ বহন করে।
অথচ এই আলপনা আঁকার পরিবর্তে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানকার সার্বিক পরিবেশ রক্ষা করে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে দুদিনব্যাপী হস্ত ও কুটিরশিল্প মেলা এবং রুচিসম্মত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেত, যেখানে স্থানীয় কারুশিল্পীরা তাঁদের পণ্যাদি বিক্রি করে লাভবান হতে পারতেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সেটি না ভেবে ভেবেছে, গোষ্ঠীবিশেষকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার কথা।
যতটুকু জানা যায়, যথাযথ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই আলপনাটি আঁকা হয়েছে। ১২ এপ্রিল ওই আলপনা কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং ১৪ এপ্রিল ভোরে তুলির শেষ আঁচড় টেনে এর সমাপ্তি ঘোষণা করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। একজন অগ্রসর চিন্তার মানুষ হিসেবে সাধারণের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূরের যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এর বিপরীতে তাঁর এরূপ আচরণ একেবারেই মানানসই হয়নি বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত।
এশিয়াটিক মার্কেটিংয়ের সঙ্গে তাঁর যত ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক সম্পর্কই থাকুক না কেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এখানে সেটির চর্চা করাটা বস্তুতই সমীচীন হয়নি বলে মনে করি। তাঁর মতো সুধীজনেরা যদি এমনটি করেন, তাহলে দ্রুত পতনমুখী এই সমাজে সাধারণ মানুষ কাদের ওপর নির্ভর করবে?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্য, গত ২৮ বছরে দেশে জলাভূমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৮৬ শতাংশ। আর বিভিন্ন সূত্রের সমন্বিত তথ্যের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, এর সিংহভাগই জবরদখল হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে। এমনকি বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাও বাংলাদেশে নদী গ্রাস-সমর্থনমূলক প্রকল্পে অর্থ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) আওতাধীন যমুনা নদী সরুকরণ প্রকল্প যার অন্যতম উদাহরণ।
চলনবিল, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, বেলাইবিল ইত্যাদির মতো বৃহৎ জলাশয়গুলোর একটি বড় অংশ বেসরকারি দখলদারদের হাতে চলে গেলেও সেসব বস্তুত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতাতেই ঘটে চলেছে। নিকলীর হাওরের বুকে সড়ক নির্মাণ করে এর ধ্বংসযজ্ঞের সিংহভাগ আগেই সম্পন্ন করা হয়েছে, যার উল্লেখ ওপরে রয়েছে। অবশিষ্ট যেটুকু বাকি ছিল, বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে সড়কের ওপর আলপনা এঁকে এখন সেটুকুও পূরণ করা হলো।
আর স্বার্থোদ্ধারের প্রয়াসে এর উদ্যোক্তারা এতটাই বুদ্ধিমান যে, এ কাজের জন্য তারা অত্যন্ত যত্ন করে বেছে নিয়েছে পয়লা বৈশাখের মতো একটি আবেগঘন উপলক্ষকে, যাতে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে সহজেই আবেগের আসক্তিতে তন্ময় করে রাখা যায়। আর একই চতুর উদ্দেশ্যে প্রচারণায় আনা হয়েছে এরূপ তথ্য যে এটি বিশ্বের দীর্ঘতম আলপনা এবং পাশাপাশি গোপন করা হয়েছে এ বিষয়টি যে এটি সেখানকার মানুষ, ফসল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
দেশে চলমান তাপপ্রবাহ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখা দেওয়া আকস্মিক বন্যা, ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনায় বিশ্বজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার কথা। তো এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়, পৃষ্ঠপোষকতা, সমর্থন ও উদ্যোগেই যদি বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে আলপনা আঁকা, নদীর প্রস্থ ও গভীরতা বৃদ্ধির পরিবর্তে সেটিকে সরু করে ফেলা, খাল-বিল, নদী-নালার মতো উন্মুক্ত জলাশয় জবরদখল করা, রাষ্ট্রের খাসজমিতে রাষ্ট্রেরই স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি কাজগুলো এভাবে অবাধে ঘটতে থাকে, তাহলে পরিবেশ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের ঘোষিত অঙ্গীকার কি নিছক ফাঁকা বুলি হিসেবেই আখ্যায়িত করা চলে না?
এমনকি এটি সংবিধানে ঘোষিত অঙ্গীকারেরও বরখেলাপ নয় কি? এ বিষয়ে সংবিধান স্পষ্টতই অঙ্গীকার করছে যে ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮. ক)
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়
পাহাড়ি ঢলের পানি আটকে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার ১৯৫৭-৬২ সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙামাটিতে ২ হাজার ২০০ ফুট দীর্ঘ একটি বাঁধ নির্মাণ করে তার উজানে একটি কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করে। উদ্দেশ্য ছিল দুটি: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও হ্রদকে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের কথিত সেই উদ্দেশ্যের দুটিই সেদিন তাদের দৃষ্টিতে সফল হয়েছিল—স্থাপিত হয়েছিল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও কাপ্তাই হ্রদ।
কিন্তু এর মাধ্যমে তারা রাঙামাটির চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লাখখানেক সদস্যকে বাস্তুচ্যুত করার মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই চোখের ও দেহের জলে ভাসিয়ে এ অঞ্চলে নতুন যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সমস্যার জন্ম দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি আজও হয়নি। এক জটিল ও অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে এখনো এর জের স্থানীয় ও অস্থানীয় সব জনগোষ্ঠীকেই বহন করে যেতে হচ্ছে। এমনকি কখনো কখনো তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকেও স্পর্শ করে যাচ্ছে।
কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও সেখানে একটি হ্রদ গড়ে তোলার সঙ্গে প্রচণ্ড মিল আছে ২০১৬-২০ সময়কালে কিশোরগঞ্জের নিকলীর হাওরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণেরও। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন ছিল একটি বিশাল ‘উন্নয়ন প্রয়াস’, তেমনি হাওরের বুক চিরে উল্লিখিত সড়ক নির্মাণকেও বলা হয়েছে যোগাযোগ অবকাঠামো বিস্তারের ক্ষেত্রে ‘উন্নয়নের নতুন দিগন্ত’।
একইভাবে কাপ্তাই হ্রদ যেমন লাখো পর্যটকের হৃদয়ছোঁয়া আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, তেমনি ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে বছরজুড়ে দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের পরম আরাধ্য এক ভ্রমণস্থল। কিন্তু এর পরের মিলগুলোই কষ্টের। নানা শ্রেণির অগুনতি পর্যটক কাপ্তাইয়ের মনোরম বাঁধ আর চোখজুড়ানো হ্রদের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলেও তাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের বুকচেরা কষ্টের যেমন এতটুকু লাঘব হয়নি, তেমনি ‘উন্নয়নের নতুন দিগন্ত’ সৃষ্টির নামে নিকলীর হাওরে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করে সন্নিহিত এলাকার চরের মানুষদেরও স্থায়ী জলাবদ্ধতার অভিশাপের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ যেন অনেকটা তপ্ত কড়াই থেকে উনুনে নিক্ষেপ।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ওখানকার চরের মানুষেরা আগে শুকনো মৌসুমের পাঁচ-ছয় মাস অন্তত বহু যুগের অভিজ্ঞতায় রপ্ত ধীরগতির পুরোনো যোগাযোগ-কৌশল মেনে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করতে পারত। কিন্তু সড়ক নির্মাণের পর থেকে এখন সারা বছরই তারা ঘরে পানিবন্দী এবং একই ধারায় ফসলের মাঠ ও গবাদিপশুর চারণভূমিও সারা বছরই থাকছে পানির নিচে।
আর ভয়ংকর উন্নয়নের এই ফলাফল দেখে কষ্ট ও অনুশোচনায় দগ্ধ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান স্পষ্টতই বলেছিলেন: ‘এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে।’ এবং এটা তাঁকে বলতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উল্লিখিত সড়কের উচ্ছ্বাসভরা উদ্বোধনের মাত্র ৩ বছর ২২ দিনের মাথায়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেন ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর।
তো এই যখন নিকলীর হাওরের বুকে অবাঞ্ছিত সড়ক নির্মাণের কারণে সেখানকার কৃষকজীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির করুণ চিত্র, তখন পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ওই সড়কের ওপর আঁকা হয় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আলপনা, যা কিছুদিন ছিল দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম প্রসঙ্গ। এরই মধ্যে ২০ এপ্রিলের আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ওই আলপনা আঁকার কারণে ‘ফ্যাকাশে হবে হাওরের শস্য ও মাছ’। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ওই আলপনা আঁকার কাজে ১৬ হাজার লিটার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে।
আর এটি আঁকা হয়েছে বাংলালিংক, এশিয়াটিক মার্কেটিং ও বার্জার পেইন্টসের সৌজন্যে। বৃষ্টির পানিতে ওই রাসায়নিক যখন গলে গলে পার্শ্ববর্তী হাওরের পানিতে মিশবে, তখন একদিকে তা যেমন ব্যাপক ফসলহানির কারণ হবে, অন্যদিকে তেমনি তা সেখানকার কীটপতঙ্গ ও জলজ প্রাণিকুলকেও অবাধে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। তা ছাড়া হাওরে জন্মে এরূপ বিভিন্ন শ্রেণির ঘাস ও অন্যান্য খুদে উদ্ভিদকেও ধ্বংস করে ফেলবে। মোটকথা, বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা ওই আলপনা এখন নিকলীর হাওরের ফসল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ধরনের এক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
পরিবেশের এরূপ মারাত্মক ঝুঁকির কথা চিন্তা করে বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই আলপনা না আঁকার দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি গ্রাহ্য করা হয়নি। তবে ভাগ্য ভালো, ওই প্রতিবাদকে সরকারের পক্ষ থেকে মৌলবাদীদের কাণ্ড বলে অভিহিত করা হয়নি, যা ইদানীং কোনো উদ্যোগ বা বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেই করা হয়ে থাকে।
আর পয়লা বৈশাখের মতো একটি সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসব যে এখন ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাভাবনা ও অংশগ্রহণ-ধারার বাইরে গিয়ে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে, নিকলীর হাওরের ফসল ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে সেখানে তিন ব্যবসায়িক কোম্পানির বিজ্ঞাপনভিত্তিক আলপনা আঁকা তারই প্রমাণ বহন করে।
অথচ এই আলপনা আঁকার পরিবর্তে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানকার সার্বিক পরিবেশ রক্ষা করে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে দুদিনব্যাপী হস্ত ও কুটিরশিল্প মেলা এবং রুচিসম্মত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেত, যেখানে স্থানীয় কারুশিল্পীরা তাঁদের পণ্যাদি বিক্রি করে লাভবান হতে পারতেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সেটি না ভেবে ভেবেছে, গোষ্ঠীবিশেষকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার কথা।
যতটুকু জানা যায়, যথাযথ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই আলপনাটি আঁকা হয়েছে। ১২ এপ্রিল ওই আলপনা কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং ১৪ এপ্রিল ভোরে তুলির শেষ আঁচড় টেনে এর সমাপ্তি ঘোষণা করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। একজন অগ্রসর চিন্তার মানুষ হিসেবে সাধারণের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূরের যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এর বিপরীতে তাঁর এরূপ আচরণ একেবারেই মানানসই হয়নি বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত।
এশিয়াটিক মার্কেটিংয়ের সঙ্গে তাঁর যত ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক সম্পর্কই থাকুক না কেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এখানে সেটির চর্চা করাটা বস্তুতই সমীচীন হয়নি বলে মনে করি। তাঁর মতো সুধীজনেরা যদি এমনটি করেন, তাহলে দ্রুত পতনমুখী এই সমাজে সাধারণ মানুষ কাদের ওপর নির্ভর করবে?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্য, গত ২৮ বছরে দেশে জলাভূমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৮৬ শতাংশ। আর বিভিন্ন সূত্রের সমন্বিত তথ্যের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, এর সিংহভাগই জবরদখল হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে। এমনকি বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাও বাংলাদেশে নদী গ্রাস-সমর্থনমূলক প্রকল্পে অর্থ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) আওতাধীন যমুনা নদী সরুকরণ প্রকল্প যার অন্যতম উদাহরণ।
চলনবিল, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, বেলাইবিল ইত্যাদির মতো বৃহৎ জলাশয়গুলোর একটি বড় অংশ বেসরকারি দখলদারদের হাতে চলে গেলেও সেসব বস্তুত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতাতেই ঘটে চলেছে। নিকলীর হাওরের বুকে সড়ক নির্মাণ করে এর ধ্বংসযজ্ঞের সিংহভাগ আগেই সম্পন্ন করা হয়েছে, যার উল্লেখ ওপরে রয়েছে। অবশিষ্ট যেটুকু বাকি ছিল, বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে সড়কের ওপর আলপনা এঁকে এখন সেটুকুও পূরণ করা হলো।
আর স্বার্থোদ্ধারের প্রয়াসে এর উদ্যোক্তারা এতটাই বুদ্ধিমান যে, এ কাজের জন্য তারা অত্যন্ত যত্ন করে বেছে নিয়েছে পয়লা বৈশাখের মতো একটি আবেগঘন উপলক্ষকে, যাতে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে সহজেই আবেগের আসক্তিতে তন্ময় করে রাখা যায়। আর একই চতুর উদ্দেশ্যে প্রচারণায় আনা হয়েছে এরূপ তথ্য যে এটি বিশ্বের দীর্ঘতম আলপনা এবং পাশাপাশি গোপন করা হয়েছে এ বিষয়টি যে এটি সেখানকার মানুষ, ফসল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
দেশে চলমান তাপপ্রবাহ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখা দেওয়া আকস্মিক বন্যা, ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনায় বিশ্বজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার কথা। তো এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়, পৃষ্ঠপোষকতা, সমর্থন ও উদ্যোগেই যদি বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে আলপনা আঁকা, নদীর প্রস্থ ও গভীরতা বৃদ্ধির পরিবর্তে সেটিকে সরু করে ফেলা, খাল-বিল, নদী-নালার মতো উন্মুক্ত জলাশয় জবরদখল করা, রাষ্ট্রের খাসজমিতে রাষ্ট্রেরই স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি কাজগুলো এভাবে অবাধে ঘটতে থাকে, তাহলে পরিবেশ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের ঘোষিত অঙ্গীকার কি নিছক ফাঁকা বুলি হিসেবেই আখ্যায়িত করা চলে না?
এমনকি এটি সংবিধানে ঘোষিত অঙ্গীকারেরও বরখেলাপ নয় কি? এ বিষয়ে সংবিধান স্পষ্টতই অঙ্গীকার করছে যে ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮. ক)
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে