মিয়ানমার নিয়ে কূটনৈতিক কৌশল বদলাতে হবে

এ কে এম শামসুদ্দিন
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৫১
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪, ১১: ০৫

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। সীমান্তবর্তী ওই রাজ্যে যে সহিংসতা চলছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এই সহিংস পরিস্থিতিতে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গত সেপ্টেম্বর থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ যে সাঁড়াশি আক্রমণের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাচ্ছে, তার সুফল তারা ঘরে তুলে নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

মোট পাঁচটি জেলা নিয়ে গঠিত এই রাখাইন রাজ্য আবার ১৭টি টাউনশিপে বিভক্ত। গত কয়েক দিনের যুদ্ধে এই ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে সাতটিই দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এই শহরগুলো বাংলাদেশ সীমানার খুব কাছাকাছি। তবে এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ জেলা তারা নিজেদের দখলে নিতে পারেনি। এরই মধ্যে জান্তা বাহিনীকে পিছু হটিয়ে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ের কাছে পোনাজিউন শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। পোনাজিউন শহরটি ইয়াঙ্গুন-সিতওয়ে মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় এই শহর সরকারের জান্তা বাহিনীর লজিস্টিক সাপ্লাইয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যন্ত ১৭০টি শক্ত ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা।

আরাকান আর্মির অব্যাহত আক্রমণের মুখে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে টিকে থাকতে পারছে না, সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন তৎপরতা দেখেই বোঝা যায়। কিছুদিন আগেই তারা রাখাইনের উত্তরাঞ্চল থেকে তাদের সেনাসদস্যদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মিয়েবন শহরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ তল্লাশিচৌকি থেকে হেলিকপ্টারে করে সেনাসদস্যদের দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যখন নিশ্চিত হয়েছে যে আরাকান আর্মির সাঁড়াশি আক্রমণে তাদের পরাজয় অবধারিত, তখনই তাদের দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের এসব সেনাসদস্য দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে।

নতুন করে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এ লড়াই শুরু হওয়ার পর আরাকান আর্মি জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বেশ কিছু নিরাপত্তা চৌকি দখল করে নিয়েছে। অন্যদিকে রাখাইনের মংডু ও বুথিডং শহরে নিয়ন্ত্রণ নিতে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে আরাকান আর্মি।

রাখাইনে একের পর এক অঞ্চল ও সেনাচৌকির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা সেনারা বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির প্রধান জেনারেল তুন মিয়াত নাইং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্ল্যাইং ও তাঁর অনুগত জেনারেলদের প্রতি রাখাইনে পরাজয় মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধেরও অনুরোধ করেছেন।

অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরাকান আর্মি রাখাইনের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাখাইন জনগণের এমন সমর্থন পেয়ে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে তাদের পূর্ববর্তী স্বাধীন রাজত্ব আবারও প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আরাকান আর্মির প্রতি মানুষের সমর্থন এত প্রবল যে, রাখাইনের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকায় তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে এর প্রধান জেনারেল তোয়াই মিয়াত নাইং সম্প্রতি দাবি করেছেন। তারা ইতিমধ্যে ওই সব এলাকায় তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন বলে দাবি করেছেন। বিচারব্যবস্থা, কর ব্যবস্থাপনাও তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা নতুন পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণও পরিচালনা করছেন।

মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যালায়েন্স, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও আরাকান আর্মির যৌথভাবে গঠিত ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ জানুয়ারিতে উত্তরাঞ্চলের শান রাজ্য থেকে সামরিক বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে। বর্তমানে সেখানে একটি ভঙ্গুর অস্ত্রবিরতি চলছে। যদিও ধারণা করা হয়েছিল, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সেখানে পাল্টা আক্রমণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটতে দেখা যায়নি, বরং এই রাজ্যে বেশ কয়েকজন জেনারেলসহ অনেক সেনাসদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন।

সামরিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সামরিক বাহিনীর জন্য এটা শুধু পরাজয় নয়, মিয়ানমারে যে সামরিক বাহিনীর জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে, এটা তারই ইঙ্গিত বহন করে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গৃহযুদ্ধে মিয়ানমার জান্তা সরকারের জন্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বরং পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। তারা প্রায় প্রতিদিন সেনাসদস্য হারাচ্ছে। অথচ নতুন করে কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না।

ফলে নতুন করে শক্তিবৃদ্ধিও হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত তারা বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সেনাসদস্যরা টহল দিতেও সাহস করছেন না। অনেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। যুদ্ধে টিকে থাকতে সামরিক বাহিনী এখন বিমান হামলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সেনাসদস্যের সংকটে মিয়ানমার আগে থেকেই চালু থাকা তরুণ বয়সী সব নারী-পুরুষকে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের পুনরায় ঘোষণা দিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে জোর করে রোহিঙ্গা পুরুষদের সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে যেসব রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করছে, তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে সম্প্রতি ৪০০ পুরুষকে দুই সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে ঢোকানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্রোহী সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই রোহিঙ্গা পুরুষদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে সামরিক বাহিনী।

তবে যাই হোক, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে এখনই পূর্ণাঙ্গভাবে পরাজিত করা সম্ভব নয়। শান ও রাখাইনে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও অন্যান্য অঞ্চলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তারা জানে, এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। মিয়ানমারের বড় বড় অঞ্চল যেমন—সিত্তে, নেপিডো কিংবা রেঙ্গুনে বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনী না পৌঁছানো পর্যন্ত জান্তা বাহিনীর পরাজয় বলা যাবে না।

তবে নানামুখী আক্রমণে তারা যে দুর্বল হয়ে পড়েছে তা বলা যায়। জান্তা সরকারের পরাজয় অনিবার্য না হলেও তাদের পিঠ যে দেওয়ালে ঠেকে গেছে, সে কথা বলা যায়।

রাখাইনে যা ঘটছে, তা নিয়ে এখনই আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। মনে রাখতে হবে, চীন থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সসহ বিদ্রোহী দলগুলোকে সমর্থন জানালেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সম্পর্ক কিন্তু বিচ্ছিন্ন করেনি। আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনে সাফল্য পেলেও দক্ষিণে এখনো কিছু করতে পারেনি। এই অঞ্চলে ভারত ও চীন উভয় দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। যদিও আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্ট ইউনাইটেড আরাকান লীগের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়।

তবে রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্টের প্রভাব বরাবরই থাকবে। এই সবকিছু বিবেচনা করে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নতুন করে ভাবতে হবে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার বলে দাবিদার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি এবং আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যেহেতু নমনীয় মনোভাব পোষণ করে; বাংলাদেশকে এ দুটো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি বিশেষ বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা এবং চীনের ওপর নির্ভর করে এখন পর্যন্ত কোনো আশার আলো দেখা যায়নি। কাজেই তাদের ওপর নির্ভর না করে বাংলাদেশকে নতুনভাবে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে এনইউজি ও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি বলে মনে করি। এ দুটো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশ এরই মধ্যে অনেক সময় অপচয় করে ফেলেছে। পরিস্থিতিও কিছুটা জটিল আকার ধারণ করেছে।

তার পরও মনে করি, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও এ ধরনের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও ভারতের সমর্থন থাকবে বলে মনে হয় না। তারা মনঃক্ষুণ্ন হলেও বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।

ভারত ও চীন মিয়ানমারে তাদের স্বার্থ রক্ষায় যদি মিয়ানমারের পাশে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমরা কেন দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে মস্তক উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না? এর জন্য আমাদের কূটনৈতিক সক্ষমতা আরও বাড়াতে এবং কুশলী কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

এ কে এম শামসুদ্দিন,অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত