একা মায়ের নেপথ্যের গল্প

এমি জান্নাত
Thumbnail image

জীবনের গল্প আর সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা আমাদের অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমরা অনেক ‘টার্ম’ জানি আজকাল। যেমন বেশ কবছর আগেও আমরা ‘সিঙ্গল মাদার’ বা ‘একা মা’ টার্মটার সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত ছিলাম না। আমাদের চারপাশে অনেক মা আছেন যারা একা সন্তানকে নিয়ে জীবনযাপন করছেন। কেউ হয়তো অনেক বেশি যুদ্ধ করছেন, কেউ কম। আর সমাজের আলোচনা সমালোচনার কল্যাণে আমরা তাদের ‘সিঙ্গল মাদার’ হিসেবে জানি। তবে এই টার্মটার চেয়ে ‘কে, কেন, কীভাবে’ সেসব জানতে বোধ হয় আমরা বেশি আগ্রহী!

হ্যাঁ, যে গল্পগুলো আপনারা রসিয়ে জানতে চান সেই সিঙ্গল মাদার হওয়ার নেপথ্যে অনেক গল্প থাকে। আমার প্রবন্ধ বই ‘হৃদয়ের এপার ওপার’-এ এই বিষয়টা নিয়ে অন্যভাবে লিখেছিলাম। একজন মা যখন তার সন্তানকে নিয়ে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা ও একা থাকেন অথবা বিধবা হয়ে সন্তানকে নিয়ে একা বাঁচেন—তাদেরই আমরা ‘সিঙ্গল মাদার’ বলি।

এইটুকুতে সবার বুঝতে পারার কথা, শখের বশে কেউ এই জীবনটা বেছে নেয় না। কারণ যিনি যে পরিবার বা স্ট্যাটাসে থাকুন না কেন, সে অনুযায়ী তাকে নানা বিশেষণে বিচার করা হয়। সেই মায়ের গায়ে লাগানো হয় নানা তকমা। যেমন, ডিভোর্স হয়ে গেছে—‘ভালো মেয়েদের ঘর ভাঙে নাকি’, ‘বাচ্চার কী হবে?’ আবার চাকরিজীবী হলে তো কথাই নেই। হয় বলবে, ‘কী এমন চাকরি যে এত গরম?’ না হয় বলবে, ‘টাকা আছে তাই মাটিতে পা পড়ে না!’ আর যদি স্বামী মৃত হয় তাহলে এখনো সমাজের কিছু মানুষ তাকে ‘অলক্ষুনে’, ‘অপয়া’ এই সব বিশেষণ দেবে।

 ‘সেপারেটেড’ বা ‘ডিভোর্সি’ অথবা ‘বিধবা’—যেকোনো নারীর চরিত্রে দাগ লাগাতে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেন অনেক ডিগ্রি নিয়ে ফেলেছে অনেক যুগ আগেই। অথচ সেই মায়ের মনের দাগ সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। এই ধারাবাহিকতা পরিবর্তিত রূপ নিয়ে কত যুগ চলবে জানা নেই।

অনেক নারী স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত, স্বামী এবং তার পরিবারের অপমান, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আপস করে সংসার নামক চার দেওয়ালে আটকে থাকে; কারণ সন্তানকে বাবা-মায়ের আলাদা থাকার চিহ্নিত কিছু প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য এবং নিজের পরিবারের কটুবাক্য থেকে মুক্তির জন্য অথবা সন্তান বা পরিবার কাউকেই কষ্ট দেবেন না সে জন্য। কিন্তু যখন একজন মা উপলব্ধি করেন, সংসার নামক দেওয়ালে একসঙ্গে থাকতে গিয়ে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর বিরূপ প্রভাবে সন্তানের ভালোর চাইতে খারাপটা বেশি হচ্ছে, মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে—সে সময় যদি সন্তানকে নিয়ে একা বাঁচার একটু অবলম্বন এবং আত্মবিশ্বাস থাকে, তখনই এই কঠিন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন। পাশাপাশি মনের জোরটাও থাকতে হয়। প্রসঙ্গ ‘একা মা’, তাই মায়ের সিদ্ধান্তের কথাই বলছি।

আর বিধবা হলে তো জীবনের এক রং চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব রং মুছে ফেলতে হবে! চাকরি করতে গেলে সাজগোজ কেন করবে, পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে কেন কথা বলবে—এটা একা মায়েদের চেয়ে স্বামী মারা গেলে বেশি প্রযোজ্য। আর কাজে উন্নতি করলে সঙ্গে যদি দেখতে একটু সুন্দর হয়, তাহলে তো কথাই নেই! তার আর কোনো যোগ্যতার যেন দরকার নেই! ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা, সনদ, মেধা এসব শিকেয় তুলে রাখা হয়।

সময় একেবারেই বদলায়নি, সেটা বলছি না। এখন একা মায়েরা অনেক কিছু করতে পারেন। শত কটূক্তির মধ্যে কাঁটার পথে হাঁটতে হাঁটতে নিজের লক্ষ্যে এগোতে পারেন মনের জোরে। পাশে থাকা কিছু সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী সেই উদ্যম বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। শুধু প্রকৃত সংখ্যাটা এখনো কম। আসলে আধুনিকায়নের এ সময়েও আমরা ঠিক কতটা নিজেদের মানসিকতা বদলাতে পেরেছি— প্রশ্নটা এখানে। এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একজন সিঙ্গল মাদারের যুদ্ধটাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। তার প্রতিটি চলার পথকে রোধ করার চেষ্টা করা হয় নানান দিক থেকে। নারীরাও কম এগিয়ে নেই আরেকজন নারীকে টেনে নিচে নামানোর প্রতিযোগিতায়! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে নেতিবাচক মন্তব্য করার প্রসারও ঠেকে নেই। একজন পাশে দাঁড়িয়ে একধাপ এগিয়ে দিলে দুজন দুটো কটু কথা বা কাজের মাধ্যমে দুই ধাপ পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় থাকে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মায়েরা ‘সিঙ্গল’ হয় নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করতে, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অথবা বাধ্য হয়ে। তাই তাদের সম্মান করার মানসিকতা পোষণ করতে যদি একান্তই না পারেন, অন্তত অসম্মান করে তার চলার পথটাকে রুখতে চেষ্টা করবেন না কেউ। এত সংগ্রামের মধ্যে একটু না হয় মসৃণ হোক সব একা মায়ের জীবন। 

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত