ঢাকা নগর পরিবহন: যাত্রী বেড়েছে, বাস বাড়েনি

সাইফুল মাসুম ও সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২২, ০৪: ৪৪
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ১০: ১৩

যাত্রা শুরুর দুই মাসের মধ্যে ঢাকা নগর পরিবহনের বাসের সংখ্যা ১০০ হওয়ার কথা। বাস রুট রেশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৫০টি বাস নিয়ে চালু হয় এই গণপরিবহনসেবা। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত চলাচলকারী ঢাকা নগর পরিবহনের তিন মাস পূর্ণ হলো আজ। এর মধ্যেই নগরবাসীর কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে নগর পরিবহন। বেড়েছে যাত্রীসংখ্যাও। কিন্তু বাসের সংখ্যা না বাড়ায় যাত্রীসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা ও সময়মতো বেতন-ভাতা না পাওয়ায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই গণপরিবহনসেবায় নিয়োজিত ড্রাইভার, হেলপারসহ একাধিক কর্মী। তাঁরা জানান, ঢাকা নগর পরিবহনের ৫০টি বাসের মধ্যে ৩০টি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি), বাকি ২০টি বাস ট্রান্সসিলভা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। বিআরটিসির বাসের কর্মীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ট্রান্সসিলভার বাসে কর্মরতরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।

যাত্রীর চাপ বাড়ছে
খুব বেশি প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই ঢাকা নগর পরিবহন চালু হওয়ায় শুরুতে যাত্রীদের সাড়া ছিল কম। কিন্তু সেবার মান ভালো হওয়ায় তিন মাসের মধ্যে চিত্র পাল্টে গেছে। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ঘাটারচরের শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরসংলগ্ন টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখা গেল যাত্রীর জটলা। পাশেই দাঁড়ানো নগর পরিবহনের কয়েকটি বাস।

কাঁচপুরেও যাত্রীদের চাপ থাকে। কাঁচপুর এলাকার লাইনম্যান ও টাইমকিপার মো. রাজা বললেন, ‘আগের তুলনায় যাত্রী বেড়েছে, কিন্তু গাড়ির না বাড়ায় আসনসংকট তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও অনেকে বাসে উঠতে পারছেন না।’

মোহাম্মদপুর এলাকার এক যাত্রী জানালেন, ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুরে পৌঁছতেই নগর পরিবহনের বাসের সব আসন পূর্ণ হয়ে যায়। তখন কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। তাতে অনেকেই বাসে ওঠার সুযোগ পান না।

নগর পরিবহনের বাসে জায়গা না পেয়ে অন্য পরিবহনের বাসে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক যাত্রী। শুরুতে বলা হয়েছিল, সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পাঁচ মিনিট পরপর বাস ছাড়বে। কিন্তু বাস কম থাকায় তা করা যাচ্ছে না।

আবার কাঁচপুর থেকে নিয়মিত মতিঝিলে যাতায়াতকারী মোবারক হোসেন জানালেন, নগর পরিবহনের বাস মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করে। এতে সময় বেশি লাগে। তাই সময় বাঁচাতে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলাচলকারী বাসে ওঠেন অনেকে।

ঢাকা নগর পরিবহনের চালক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘাটারচর থেকে শাহবাগ হয়ে যাওয়ার পথে ঢাকা ক্লাবের সামনে একটি টিকিট কাউন্টার রয়েছে। কিন্তু রাস্তা পার হয়ে অনেক যাত্রী এ পাশে এসে বাসে ওঠেন না। এই এলাকায় কাউন্টারটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে হওয়া উচিত।

এ ছাড়া মাঝেমধ্যে স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন মো. মারুফ নামে এক যাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক ওই শিক্ষার্থী শুক্রবারেও নগর পরিবহনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার দাবি জানান।

ড্রাইভার-হেলপাররা অসন্তুষ্ট
স্টপেজ ছাড়া যাত্রী তোলার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা নগর পরিবহনের একাধিক বাসের চালক ও হেলপার জানান, ডিসেম্বরে চালু হওয়ার পর জানুয়ারি মাসে পুরো বেতন পেলেও ফেব্রুয়ারিতে অর্ধেক বেতন পেয়েছেন ট্রান্সসিলভার ২০টি বাসের কর্মীরা। তাই টিকিট ছাড়া যাত্রী নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে অনেক কর্মীর মধ্যে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হেলপার বলেন, ‘অন্য বাসে হেলপারি করে দৈনিক হাজার টাকা আয় করা যায়। কিন্তু এখানে এসে এখনো ফেব্রুয়ারির পুরো বেতন পাই নাই। মার্চের বেতন আর ঈদের বোনাস জুটবে কি না জানি না।’

বেতন-ভাতার পাশাপাশি টিকিট কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ঘাটারচরের টিকিট কাউন্টারের কামাল হোসেন জানান, লাইট না থাকায় সন্ধ্যার পরে অন্ধকারে ঝুঁকি নিয়ে কাউন্টার খোলা রাখতে হয়। টাকাপয়সা ছিনতাই হতে পারে। আবার কাছাকাছি পাবলিক টয়লেট না থাকায় বাসের কর্মীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ও বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, কর্মীদের সংকটের বিষয়গুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। লাইট লাগানো এবং টয়লেট বসানোর বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। ট্রান্সসিলভাকে নিয়মিত বেতন পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকা নগর পরিবহনের উদ্যোগটি যাত্রীরা সাদরে গ্রহণ করেছেন। এমন উদ্যোগ চলমান রাখতে সংশ্লিষ্টদের ন্যূনতম যেসব দাবি, সেগুলো পূরণ করা আবশ্যক।’

আরও নতুন তিন রুট
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির অধীনে ঢাকা নগর পরিবহন পরিচালনায় যুক্ত রয়েছে ডিটিসিএ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ট্রান্সসিলভা। রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

২২ মার্চ কমিটির সভা শেষে তিনি জানান, ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটের অভিজ্ঞতায় ঢাকা নগর পরিবহনের জন্য নতুন তিনটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো ঘাটারচর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার (২২ নম্বর), ঘাটারচর থেকে সাইনবোর্ড, চিটাগং রোড (২৩ নম্বর) এবং ঘাটারচর থেকে কদমতলী (২৬ নম্বর)। ২২ নম্বর রুটে ৫০টি, ২৩ নম্বরে ১০০টি এবং ২৬ নম্বরে ৭৫টি মিলিয়ে এই তিন রুটে আরও ২২৫টি বাস নামানো হবে। এ ছাড়া ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ট্রান্সসিলভা আরও ২০টি বাস যুক্ত করবে বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত