এসএমই ব্যাংক: প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধন

আবু তাহের খান
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২২, ১০: ৫৫

শেষ প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র কারুশিল্পীদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি শিল্পনীতিতেই এরূপ একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত থাকছে যে হস্তশিল্প রপ্তানি থেকে আহরিত সমুদয় আয় আয়করমুক্ত সুবিধা পাবে। বর্তমান শিল্পনীতিতেও (শিল্পনীতি ২০১৬) বিদ্যমান ওই প্রণোদনা-সুবিধা বহাল রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে (অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৪.৯)। কিন্তু গত ৩০ বছরে এর বাস্তব ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে, তা কি কখনো মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে? এটি শুনতে খুবই ভালো শোনায় যে শিল্পনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দলিলে দরিদ্র ও প্রান্তিক কারুশিল্পীদের কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে যে ঘোষিত ওই প্রণোদনার প্রায় কোনো অংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কখনো ওই কারুশিল্পীদের ভাগ্যে জোটেনি, কারুশিল্পীদের নাম করে তা ভোগ করেছেন বিত্তবান বণিকেরা।

একইভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) নাম করে অন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোক্তারা ভোগ করেছেন, তাঁদেরও অধিকাংশ আসলে ওই পর্যায়ের উদ্যোক্তা নন, যাঁদের জন্য সভা-সেমিনারের আলোচনায় মুখরোচক মমতায় আমরা গলদঘর্ম হই। বস্তুত এসব মুখরোচক আলোচনার বেশির ভাগই অত্যন্ত অগভীর এবং এ খাতের বাস্তব চর্চা ও তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীন। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সামান্য কিছু তথ্য ও প্রয়োজনের কথা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

গত ৭ সেপ্টেম্বর আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তাদের কয়েকজন এ খাতের উদ্যোক্তাদের স্বার্থে নতুন এসএমই ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন (প্রথম আলো, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২)। প্রস্তাবকারীদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলি, প্রকৃতপক্ষে এটিও একটি মুখরোচক ও অগভীর চিন্তাপ্রসূত প্রস্তাব, যার সঙ্গে এ খাতের বাস্তব চাহিদা ও প্রয়োজনের কোনোই মিল নেই। একই অনুষ্ঠানে দেওয়া তাঁদের অন্য বক্তব্য থেকেই এর যথার্থতা প্রমাণিত হয়, যেখানে তাঁরা মূলত ৫-১০ লাখ টাকা পুঁজিধারী উদ্যোক্তাদের সমস্যাগুলোকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেটি খুবই যথার্থ।

কিন্তু এটি হয়তো তাঁদের গোচরে নেই অথবা তাঁরা খেয়াল করতে ভুলে গেছেন যে সরকারের সর্বশেষ শিল্পনীতি অনুযায়ী ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগসীমা পর্যন্ত সব শিল্পই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (শিল্পনীতি ২০১৬-এর অধ্যায়-৩)। ফলে ৩০ কোটি টাকা বা এর কাছাকাছি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরাও যেহেতু মাঝারি উদ্যোক্তা, সেহেতু সংজ্ঞা অনুযায়ী বলার উপায় নেই যে মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। আসলে অপেশাদারি হাতে প্রণীত সংজ্ঞার বিচারে এসএমই উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কখনোই সেই উদ্যোক্তা নন, যাঁরা এ খাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করেন। এ খাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ উদ্যোক্তার ঋণচাহিদা ৩০ কোটি টাকা বা তার কাছাকাছি পর্যায়ের নয়। তাদের চাহিদা আসলে খুবই অল্প—মাত্র ১০-২০ লাখ টাকা, যাঁদের কথা উল্লিখিত অনুষ্ঠানেও আলোচিত হয়েছে।

কিন্তু এসএমই উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না এবং নিয়তই তাঁরা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন মর্মে যে আচনা রয়েছে এবং ৭ সেপ্টেম্বরের উল্লিখিত আলোচনায়ও যেটি উঠে এসেছে, সেটি তো আসলে ওই ১০-২০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণে আগ্রহীদের কথা। ফলে শেষোক্ত এই ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য হয়রানিমুক্ত ও প্রচুর কাগজপত্রের বোঝাবিহীন ঋণ নিশ্চিত করতে হলে নতুন ব্যাংক নয়; বরং সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিল্পের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা। আর এই সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এর যৌক্তিকীকরণ না করার কারণে এ খাতের ১০-২০ লাখ টাকা ঋণ লাভে আগ্রহীরা শুধু যে ছোট ছোট ঋণ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন তা-ই নয়, এসএমই উদ্যোক্তা সেজে বড় উদ্যোক্তারাও ছোটদের শর্তে বিপুল পরিমাণ ঋণ বাগিয়ে নিচ্ছেন।

আবু তাহের খান

তা ছাড়া, একই প্রক্রিয়ায় সংজ্ঞার ফাঁক গলিয়ে সরকারকেও তাঁরা বিপুল পরিমাণ কর দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। যেমনটি বিরত থাকছেন হস্তশিল্পপণ্যের রপ্তানিকারকেরাও, যা এ লেখার গোড়াতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর এরূপ ন্যায্য কর থেকে বঞ্চিত হয়ে উল্লিখিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে, অর্থাৎ বাজেটের আওতাধীন রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য সরকার তখন সাধারণ জনগণের ওপর নতুন করের বোঝা চাপিয়ে বসে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে উল্লিখিত ত্রুটিপূর্ণ সংজ্ঞার কারণে ছোট উদ্যোক্তারা শুধু ঋণ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন না, বাড়তি করের বোঝা পরিশোধ করতে গিয়ে কষ্টের স্বীকার হচ্ছেন নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষও।

এবার আসা যাক এসএমই ব্যাংকের কথায়। ক্ষুদ্রশিল্প খাতে অর্থায়নের জন্য বড় আকৃতির মূলধনসম্পন্ন বহুল আলোচিত বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ব্যাংক ফর স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স’ (বেসিক ব্যাংক) ১৯৮৮ সাল থেকে দেশে কাজ করে আসছে। বেসিক ব্যাংকের গঠনবিধি অনুযায়ী এর বিনিয়োগযোগ্য ঋণ তহবিলের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্রশিল্প খাতে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং তারা তা করছেও। কিন্তু মূল সমস্যাটি সেই একই জায়গায়—সংজ্ঞায়। ক্ষুদ্রশিল্পের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগসম্পন্ন যেকোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করলেই তাদের ঋণদানের শর্ত পূরণ হয়ে যায়। ফলে দেখাই যাচ্ছে যে ক্ষুদ্রশিল্পে ঋণদানের সমুদয় শর্ত পূরণ হওয়ার পরও ঋণের অভাবে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভোগা ১০-২০ লাখ টাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণচাহিদার সিংহভাগই অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। কারণ, বেসিক ব্যাংক ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণদানের জন্য স্থাপিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এ খাতের নিম্ন প্রান্তের ছোট উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ খুব কম।

দেশের অপরাপর বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবছর এসএমই খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়ে থাকে। বেসিক ব্যাংকের মতো তারাও এ ক্ষেত্রে সংজ্ঞার সুযোগ নিয়ে মূলত এসএমই খাতের ঊর্ধ্বাংশকেই পুষছে। তবে এসএমই খাতে ঋণদানের ব্যাপারে বেসিক ব্যাংকের মতো তাদের ওপর যেহেতু কোনো গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা নেই, সেহেতু এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোরালো নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রায় সবার মাঝেই নিম্ন প্রান্তের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণদানের ব্যাপারে আগ্রহের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অবশ্য এরপরও রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে মোটামুটি ধরনের ভূমিকা পালন করলেও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বলতে গেলে অনেকটাই উদাসীন। আর গ্রামাঞ্চলে তো তাদের অধিকাংশের কোনো শাখাই নেই (অবশ্য গ্রামে তারা শাখা খুলতেও চায় না)। সে ক্ষেত্রে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য, যাদের বড় অংশের অবস্থানই গ্রামে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোই মূল ভরসা।

উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে এসএমই খাতে ঋণদানের জন্য নতুন ব্যাংক স্থাপনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাকে অনেকটাই আবেগপ্রসূত ধারণা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি একে বৈঠকি ধাঁচের মুখরোচক জনপ্রিয় আলোচনা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আসলে এ খাতের ঋণ-অভাবী উদ্যোক্তাদের ঋণচাহিদা পূরণের জন্য বস্তুতপক্ষে নতুন ব্যাংক নয়, প্রয়োজন হচ্ছে বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ-সংক্রান্ত ঋণদান কার্যক্রমকে অধিকতর দক্ষ ও কার্যকর করে তোলা। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সামর্থ্য ও সম্ভাবনা রয়েছে, প্রয়োজনীয় উদ্যম ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে তার একটি বড় অংশই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। ফলে সে অব্যবহৃত সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে ব্যবহার এবং তাদের ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর দক্ষ ও কার্যকরভাবে গড়ে তোলার পরিবর্তে একের পর এক নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হলে তা রাষ্ট্রের তথা এ খাতের পরিচালন ব্যয়কেই কেবল বাড়িয়ে তুলবে, যা প্রকারান্তরে শেষ পর্যন্ত সাধারণ উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে চাপবে।

পরিশেষে বলব, এসএমই খাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ উদ্যোক্তাদের ব্যাপকভিত্তিক ঋণদান কার্যক্রমের আওতায় আনতে হলে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়িয়ে তার সমাধান হবে না। বাড়াতে হবে তার দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা। বিশেষ করে বেসিক ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। বেসিক ব্যাংক যে প্রশংসনীয় দক্ষতা নিয়ে গোড়াতে কাজ শুরু করেছিল, সে অবস্থা যদি আবার ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে এক বেসিক ব্যাংকই এ খাতের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

আর তার সঙ্গে বাদবাকি ব্যাংকগুলোর পুনর্বিন্যাসকৃত সামর্থ্যকে যদি যুক্ত করা সম্ভব হয় এবং তাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এ খাতের ঋণচাহিদা কখনোই হতাশার মুখে পড়বে বলে মনে হয় না। সেই সঙ্গে সংজ্ঞা পরিবর্তনের বিষয়টি তো রয়েছেই। বস্তুত বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্পের বিনিয়োগসীমাকে ব্যাপক হারে কমিয়ে এনে এমন স্তরে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে এ খাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ উদ্যোক্তার ঋণচাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব হয়।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত