স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কৃষক

রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২: ২৮

মাথার ওপর তেতে উঠেছে গনগনে সূর্য। পিঠে বালাইনাশকের জার নিয়ে ধানখেতে স্প্রে করেই যাচ্ছেন মো. হাবিবুর (২৮)। হাফহাতা টি-শার্ট, হাতে গ্লাভস নেই, মুখে মাস্কও নেই। হাবিবুর জানালেন, ৪৫০ টাকায় দেড় বিঘা জমিতে বালাইনাশক দেওয়ার জন্য তিনি এসেছেন।

২ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার জৈটাবটতলা মাঠে হাবিবুরের সঙ্গে কথা হয়। ভরদুপুরে এভাবে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘হারা তো এভাবেই দিই। খালি প্যাটে ভুঁইয়ে বিষ দিলে সমস্যা হয়। বিষের অ্যাকশন করে। কিছুদিন আগে হার চাচাতো ভাই সানু ফিট লাইগ্যা গেলছিল।’

পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন ছাড়াই জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন চিকিৎসার খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হয় কৃষককে। 
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও অনেকে সুস্থ হতে পারেন না। এ জন্য চাষিদের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করে থাকেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও কম।

এ বিষয়ে কৃষক সচেতনতা গড়ে তুলতে রাজশাহীর তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলী রেজা তৈরি করেছেন ‘বালাইনাশক সহায়িকা’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপ। সেখানে সব বালাইনাশকের তথ্য এবং ব্যবহারের নিয়মকানুনও দেওয়া আছে। তবে এটির প্রচারণা কম। এই বালাইনাশক সহায়িকা আসার আগে তানোরের কৃষকের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অসচেতনতার কারণে।

তানোরের প্রকাশনগর গ্রামের কৃষক জিল্লুর রহমান তো হারিয়েছেন একটি চোখ। তিনি জানান, সারের সঙ্গে দানাদার বিষ মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়েছিলেন। সেদিন রোদে ঘেমে যায় সার ও বিষ। এসব ছিটানোর সময় একফোঁটা ঘাম এসে পড়ে চোখে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ জ্বলতে থাকে। জিল্লুর তখনই পুকুরের পানিতে চোখ ধুয়ে নেন; কিন্তু জ্বালাপোড়া কমে না। গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে গেলে দুটি ড্রপ দেন। তাতেও কাজ হয় না। তারপর যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে চিকিৎসায়ও কাজ হয় না। তারপর রাজশাহীর একটি চক্ষু হাসপাতাল এবং শেষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। জ্বালাপোড়া কমে, কিন্তু সারা জীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যায় একটি চোখ। চিকিৎসায় খরচ হয় দেড় লাখ টাকা।

চলতি বছর আলুর মৌসুমে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে গুবিরপাড়া গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলমের চোখ। তিনি জানান, আলুর জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার সময় অসাবধানতাবশত অল্প একটু বিষপানি এসে পড়ে তাঁর চোখে। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ জ্বলতে থাকে। দ্রুতই পুরো মুখ ফুলে যায়। এরপর চোখ হলুদ হয়ে যেতে শুরু করে। খোরশেদ তখন যান চিকিৎসকের কাছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাত দিন ভর্তি থাকার পর তাঁর চোখের উন্নতি হয়। এ সময়ের মধ্যে চিকিৎসায় তাঁর ২২ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। চিকিৎসক তাঁকে জানিয়েছিলেন, স্প্রে করার সময় অসাবধানতায় চোখে বিষক্রিয়া হয়েছিল তাঁর।

তানোরের দুবইল গ্রামের কৃষক লিয়াকত আলী কীটনাশক স্প্রে করতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন বিষক্রিয়ায়। তিনি জানান, আলুর ছত্রাকনাশক স্প্রে করছিলেন তিনি। মুখে মাস্ক ছিল না। তখনই শীতের মধ্যে তিনি ঘামতে থাকেন। লিয়াকত দ্রুত বাড়ি চলে যান। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পাকস্থলী ওয়াশ করেন। এর একদিন পর জ্ঞান ফেরে লিয়াকতের। ধীরে ধীরে সুস্থ হন। একটু অসচেতনতায় চিকিৎসার জন্য তাঁর ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান তিনি।

মোহর গ্রামের কৃষক এনামুল হক বিষক্রিয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ছিলেন তিন দিন। তিনি জানান, এক দুপুরে তিনি খালি হাত দিয়ে ধানখেতে দানাদার বালাইনাশক ছিটান। তারপর জমির কাদা মেখে হাত ধুয়ে নেন। এরপর এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে মুড়ি খান। পরে বাড়ি গিয়ে গোসলের পর ভাত খান। এরপরই শুরু হয় বমি। ঘুম ঘুম ভাব, শরীর টলতে থাকে। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন। এর মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এনামুল। অচেতন অবস্থাতেই তাঁর পাকস্থলী ওয়াশ করা হয়। এনামুল জানান, তিন দিন পর তাঁর জ্ঞান ফিরেছিল। তারপর বাড়ি ফেরেন। চিকিৎসায় খরচ হয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বালাইনাশক ব্যবহারের সময় এবং পরে সতর্ক থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না বলে এখন মনে করেন এনামুল।

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ক মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষা চালায় বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)। প্রতিষ্ঠানটির গবেষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাসায়নিক কীটনাশকের যত্রতত্র ব্যবহারে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যও হুমকিতে পড়ছে। রোগবালাই বাড়ছে। চিকিৎসার পেছনে দরিদ্র কৃষকের খরচও বাড়ছে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে সম্মিলিতভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ বলেন, ‘বালাইনাশক ব্যবহারের সময় কৃষকদের পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। মাস্ক, গামবুট, অ্যাপ্রোন কিংবা ফুলহাতা শার্ট, হ্যান্ডগ্লাভস, ক্যাপ অবশ্যই পরতে হবে; কিন্তু কৃষকেরা তা মানেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে যায়।’ তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি বলেন, ‘কৃষকের কাছে সহজে তথ্য পৌঁছতে আমরা বালাইনাশক সহায়িকা অ্যাপস চালু করেছি। এখানে সব বালাইনাশকের তথ্য যেমন আছে, তেমনি ব্যবহারবিধি ও সতর্কতার কথাও আছে। কৃষক যদি স্বল্পশিক্ষিতও হন তাও এই অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন। নিজে না জানলে পরিবারের কাউকে দিয়ে অ্যাপ থেকেই সবকিছু দেখে নিতে পারবেন।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত