‘পানি আনতে আনতে পানি হয়্যা যাছে জীবনডাও’

রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩, ০৮: ৪৮

লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন নারীরা। কারও হাঁটুতে ব্যথা, কারও কোমরে। কেউ কেউ এসেছেন জর, সর্দি, কাশির চিকিৎসা নিতে। ১ মে রাজশাহীর তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে এমন দৃশ্য দেখা গেল। সারিতে দাঁড়িয়েই সুফিয়া খাতুন (৪৫) বললেন, ‘সপ্তায় সপ্তায় আস্যা ওষুদ লিয়ি যাছি। তা-ও তো ব্যথা সারে না। আর মুনে হয় ভালো হবে না।’

সুফিয়ার বাড়ি তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের বেলপুকুর গ্রামে। তিনি জানালেন, বছর পাঁচেক আগে তাঁদের গ্রামের সব নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। এখন আর কোনোটিতেই পানি ওঠে না। খাওয়ার পানি বয়ে আনতে হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে। দিনের পর দিন কলসিতে পানি বয়ে আনতে গিয়ে তাঁর কোমরে ব্যথা। বসতে পারেন না, রাতে ঘুম আসে না। সব সময় চিনচিন করে।

বরেন্দ্র অঞ্চলে সুফিয়ার মতো অনেক নারী শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছেন দূর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে আনার কারণে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ঠা ঠা বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন আর সাধারণ নলকূপে পানি ওঠে না। হাতে চাপা অনেক গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় সামর্থ্যবানেরা বাড়িতে বাড়িতে সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভের গভীর থেকে পানি তুলে প্রয়োজন মেটাচ্ছে। কিন্তু যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে সেচের জন্য মাঠে মাঠে বসানো বিএমডিএর গভীর নলকূপের ওপর। কোথাও কোথাও অবশ্য বিএমডিএ বাড়িতে বাড়িতে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করছে। কিন্তু যেখানে এই পাইপলাইন নেই, সেখানকার নারীদের কষ্টেরও শেষ নেই। তাঁরা দূর থেকে খাওয়ার পানি বয়ে আনছেন।

এভাবে পানি আনার কারণে নারীরা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। হাতে, পায়ে কিংবা কোমরে ব্যথা তাঁদের সব সময়ের সঙ্গী। দূর থেকে পানি আনার কারণে গর্ভপাতের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন তানোর উপজেলার মাহালীপাড়ার বাসিন্দা হ্যাপী হাঁসদা। হ্যাপীর কোলে এখন দুই বছরের সন্তান। দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার সময় গর্ভপাত ঘটে তাঁর।

হ্যাপী বলেন, ‘কলসি আর জগ নিয়ে পানি আনতে গিয়েছিলাম। পানি নিয়ে আসার সময় পেটে ব্যথা শুরু হলো। সাথে সাথে নানিকে ডাকলাম। নানি ধরে বাড়ি আনল। তখনই গর্ভপাত শুরু হলো। পরে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সাত দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হলাম।’

তানোর উপজেলার মধ্যে পানির সংকট বেশি বাঁধাইড় ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের পরানপুর গ্রামের গৃহিণী ফারহানা বেগমেরও গর্ভপাত ঘটেছিল। তারপর আর সুস্থই হতে পারেননি। তিনি মারা গেছেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন তাঁর স্বামী। সেই স্ত্রীর নাম রাবেয়া খাতুন। এখন বাড়ির সামনে পাইপলাইনে আসা পানির ট্যাপ আছে। ওই ট্যাপেই সম্প্রতি থালাবাসন ধুয়ে নিচ্ছিলেন রাবেয়া। তিনি বলেন, ‘বছর দুয়েক আগেও দূর থেকে পানি আনতে হতো। তখন ফারহানার গর্ভপাত ঘটে। এরপর সে মারা গেলে স্বামী আমাকে বিয়ে করেন।’

তানোরের এই এলাকার এক পাশে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, অন্য পাশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা। এই এলাকাতেও ভূগর্ভস্থ পানির আকাল। সম্প্রতি নাচোলের অমৃতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সুপেয় পানির জন্য বাড়িতে বাড়িতে সাবমার্সিবল পাম্প বসানো হয়েছে। তবে পাশের নড়িয়াল গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীদের এখনো পানি আনতে হয় দূর থেকে।

গ্রামের বাসিন্দা দুলালি সরেন (৪০) বললেন, ‘ব্যথার কারণে মাঞ্জায় (কোমর) আর কলসি ধরতে পারি না। কলসি নিতে হয় মাথায়। হাতে একটা জগ ধরি। পানি আনতে আনতে জীবনডাও পানি হয়্যা যাছে। টাকা থাকলে আগে তো পাম্পই বসিয়ে লিতাম।’

নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুলতানা পাপিয়া বলেন, ‘আমার এখানে আউটডোরে রোজ ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ ভাগই নারী। হাতে, পায়ে ব্যথাসহ নানা সমস্যা নিয়েই তাঁরা আসেন। কেউ এভাবে নির্দিষ্ট করে বলেন না যে পানি বয়ে আনার কারণেই ব্যথা।’ তিনি বলেন, ‘পানি বয়ে আনার কারণে শারীরিক সমস্যা হতেই পারে।’

তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বার্নাবাস হাঁসদা বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিদিন আউটডোরে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী আসেন। তাঁদের অর্ধেক নারী। নারীদের মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ বলেন, শরীর ব্যথা। কিন্তু শুধু পানি আনার কারণেই ব্যথা কি না, সেটা আমরা জানি না। ওভাবে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। রোগীরাও বলেননি।’

মুণ্ডুমালা পৌরসভার মেয়র সাইদুর রহমান বলেন, ‘তানোর ও নাচোল উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকাটা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। সুপেয় পানির সংকট প্রকট। পানির সংকট দূর করতে আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকে গ্রামে গ্রামে ২৫০টি সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে দিলাম। কয়েক মাস চলার পর এগুলোতেও আর পানি উঠছে না। পরে ১ হাজার ১০০ ফুট পর্যন্ত গভীর পাইপ নিয়েও দেখেছি পানি নেই। হয় পাথর, না হয় কাদা। এই এলাকায় এখন আর পানি পাওয়া যাবে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত