পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক: ১,৬৮২ কোটির সড়ক নির্মাণে কচ্ছপগতি

শরীয়তপুর প্রতিনিধি
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ৪৬
Thumbnail image

পদ্মা সেতু চালুর দিন থেকেই শরীয়তপুরবাসীকে সেতুর সুবিধা দিতে ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ। তবে ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর সোয়া দুই বছর পরও পাওয়া হয়নি সেই সুবিধা। ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার ‘শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ) সড়ক উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফা বাড়ালেও কাজ হয়েছে ৬০ শতাংশ। 

এদিকে পুরোনো সড়কটিতে বাস-গাড়িসহ যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। খোঁড়াখুঁড়ি করা আর ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে শরীয়তপুরবাসীকে। মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটছে।

সংযোগ সড়ক নির্মাণে বিলম্বের জন্য যাত্রী, পরিবহনকর্মী ও স্থানীয় লোকজন দায় দিয়েছেন ঠিকাদারের গাফিলতি এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের দায়সারা তদারকিকে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সওজ বলছে, করোনা মহামারি, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং বর্ষা মৌসুমের কারণে কাজে কিছুটা দেরি হয়েছে। 

শরীয়তপুর সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান রাসেল বলেন, জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে কাজের গতি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। বৃষ্টির কারণে এখন কাজের গতি কিছুটা কম। বৃষ্টির মৌসুম শেষে কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। 

শরীয়তপুর সওজ বিভাগ সূত্র জানায়, ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। তিনটি প্যাকেজে তিন ঠিকাদার নিয়োগের পর ওই বছরের জুলাইয়ে কাজ শুরু হয়। পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট জাজিরার নাওডোবা থেকে শরীয়তপুর জেলা সদর পর্যন্ত দুই লেনের সড়কটির দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। ভবিষ্যতে সড়কটি চার লেন করার সুযোগ রাখতে ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। বর্তমানে সেতু, কালভার্টসহ দুই লেন সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের ৩০ জুন।

আগের সড়কটি শরীয়তপুর সদর থেকে জাজিরার কাজিরহাট পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার অংশে প্রস্থ ১৮ ফুট এবং কাজিরহাট থেকে নাওডোবা গোলচত্বর পর্যন্ত ১২ ফুট। সড়কটি ৩৪ ফুট প্রশস্ত করে দুই লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। 

প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজের মধ্যে ১ নম্বর প্যাকেজে রয়েছে জেলা সদর থেকে জাজিরা ডিগ্রি কলেজ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ। এর ব্যয় ১৪২ কোটি টাকা। কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম/এস সালেহ আহমেদ। এর ৯ কিলোমিটারের কার্পেটিং শেষ হয়েছে। বাকি পাঁচ কিলোমিটারের কাজ চলছে। 

২ নম্বর প্যাকেজে কীর্তিনাশা নদীর ওপর কাজিরহাট সেতু (১৫০ মিটার) ও কোটাপাড়া সেতু (১৯০ মিটার) নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৫৯ কোটি টাকা। সেতু দুটি নির্মাণের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামিল ইকবাল। এ পর্যন্ত কোটাপাড়া সেতুর ৭৫ শতাংশ এবং কাজিরহাট সেতুর ৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে। 

৩ নম্বর প্যাকেজের জাজিরা ডিগ্রি কলেজ থেকে নাওডোবা গোলচত্বর পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজের ব্যয় ধরা হয় ১৪০ কোটি টাকা। কাজ পেয়েছে মেসার্স মীর হাবিবুল আলম। প্রকল্পের এই অংশই সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।
জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মীর হাবিবুল আলমের ম্যানেজার বকুল প্রামাণিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করেছি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। অনেক জায়গায় জমি বুঝে না পাওয়ায় এবং বৃষ্টির কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি হচ্ছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষে কাজের গতি বাড়ানো হবে।’ 

সরেজমিনে দেখা গেছে, জাজিরা থেকে নাওডোবা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার অংশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সরু আর খানাখন্দে ভরা এই সড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।

সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ৩০ জুন ধরা হলেও ওই সময়ে কোনো প্যাকেজের কাজই শুরু হয়নি। পরে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। তাতেও অগ্রগতি না হওয়ায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। 
এদিকে মেয়াদ বাড়িয়েও সংযোগ সড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ জানান যাত্রী ও পরিবহনকর্মীরা। প্রায়ই ঢাকায় যাতায়াত করা শরীয়তপুর জেলা সদরের ব্যবসায়ী মনির মোল্যা বলেন, পদ্মা সেতু চালুর দুই বছরের বেশি সময় পরও সড়কের কাজ শেষ হলো না। জাজিরা থেকে নাওডোবা পর্যন্ত ভাঙাচোরা সড়কে আধা ঘণ্টার পথ পার হতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগে।

শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস নামের বাসের চালক আলম মাদবর বলেন, জাজিরা থেকে নাওডোবা পর্যন্ত সড়ক ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাতে হচ্ছে। 

প্রকল্পের পরিচালক সওজের গোপালগঞ্জ জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাদেকুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে প্রায় এক বছর সময় দেরি হয়। এরপর জমি অধিগ্রহণে সময় বেশি লেগেছে। ২২টি এলএ কেসের মধ্যে এখনো ৮টির জমি বুঝে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ৩ নম্বর প্যাকেজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কাজিরহাট থেকে নাওডোবা গোলচত্বর পর্যন্ত আগের সড়কটি বেশি খারাপ হওয়ায় ২০২১ সালে বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়। নিয়ম হচ্ছে, রক্ষণাবেক্ষণ কাজের পর তিন বছর পার না হলে সেখানে নতুন করে কাজ করা যায় না।  

তবে জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয় জেলা প্রশাসন। শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, জমি অধিগ্রহণ প্রায় হয়ে গেছে। ২২টি এলএ কেসের মধ্যে শুধু ১৫ নম্বর এলএ কেসের সাত ধারার নোটিশ দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ এলএ কেসের জমি সড়ক বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ কোনো সমস্যা নয়।

ঠিকাদার হয়তো অন্য কোনো কারণে কাজে গাফিলতি করে জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে না বলে অজুহাত দিচ্ছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত