উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: বিকল সরঞ্জামে সেবায় বঞ্চনা

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯: ৪৯

নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলার অন্তঃসত্ত্বা রাহেলা (২২) নিরাপদ প্রসবের আশায় দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গভীর রাতে পৌঁছান হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হবে সামনের বেসরকারি ক্লিনিকে। কারণ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে যন্ত্রটি বিকল ১৩ বছর ধরে, দুটি আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রও নষ্ট। অধিকাংশ প্যাথলজি পরীক্ষাও হয় না। যাদের সংগতি আছে, তারা বাইরে থেকে পরীক্ষা করিয়ে এখানে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। দরিদ্রদের ফিরতে হয় সেবা ছাড়াই।

দেশের ২২ জেলার ৩১ উপজেলায় খোঁজ নিয়ে অধিকাংশ স্থানে চিকিৎসকসহ দক্ষ জনবল এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও সরঞ্জামের সংকটে স্বাস্থ্যসেবার এমন নাজুক চিত্র পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা। যদিও উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘চিকিৎসকের ঘাটতির তথ্য সঠিক নয়। তবে জুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট পদে ঘাটতি আছে। সেটি নিরসনের কাজ চলেছে। আইনি জটিলতায় টেকনোলজিস্ট নিয়োগে বিলম্ব হয়েছে। তবে দ্রুত টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তা ছাড়া সারা দেশে মেরামত অযোগ্য যেসব যন্ত্রপাতির তালিকা করা হয়েছে, সেগুলো কেনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণরূপে চালু করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসাযন্ত্রের তালিকা বানিয়েছে। সেই তালিকায় দেখা যায়, ৪২৭ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১৮২টিতে অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) অচল। সচল আছে ১৯৩টি। মোট ৫৮৬টি এক্স-রে যন্ত্রের মধ্যে ২৯৪টি সচল আর ২৯২টি অচল, যেগুলোর মধ্যে ৩৯টি মেরামতের অযোগ্য। ৪১৪টি আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রের মধ্যে অচল ১১৪টি, সচল ২৩৩টি। কোনো কোনো উপজেলায় একাধিক যন্ত্র থাকলেও ৬৭ উপজেলায় একটিও নেই। ১ হাজার ১০টি ইসিজি যন্ত্রের মধ্যে ৬৩২টি সচল, ২৭৪টি অচল। ৬৬টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওটি টেবিল নেই। ৯৯টি অস্ত্রোপচার কক্ষে নেই ওটি লাইট। ১৪৪টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পোর্টেবল ওটি টেবিলও নেই। অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র না থাকায় ৯৯টি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয় না। ৫৮টিতে নেই ওটি ডায়াথার্মি যন্ত্র। এসব প্রতিষ্ঠানে ৭৭২টি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও নষ্ট ৩৪৩টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতির ঘাটতি নিয়ে তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। 

 শুরু থেকেই বিকল
জানা গেছে, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ বছর ধরে বিকল দুটি আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র। টেকনোলজিস্ট না থাকায় বন্ধ এক্স-রে সেবাও। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, রেডিওলজি বিভাগের টেকনোলজিস্ট অবসরে যাওয়ায় এক্স-রে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র দুটি সরবরাহের পর থেকেই নষ্ট।

রাজশাহীর পুঠিয়ায় চালু করার ১০ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায় এক্স-রে যন্ত্র। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে জেনারেটর ও পানির ফিল্টার। ইউএইচও আলী মাজরুই রহমান বলেন, ‘বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। আশা করা যায়, সমাধান হবে।’ 

পরামর্শ ছাড়া সবই বন্ধ
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টেকনোলজিস্ট না থাকায় ১৬ বছর ধরে বন্ধ এক্স-রে বিভাগ। পাঁচ বছর ধরে তালাবদ্ধ প্যাথলজি বিভাগ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য সব সেবাই বন্ধ। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রতন দীপ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সব পদই শূন্য। এগুলো পূরণ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দিয়েও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। 

যন্ত্র-সরঞ্জাম অচল 
হবিগঞ্জের সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে যন্ত্র বিকল দেড় যুগ ধরে। শায়েস্তাগঞ্জে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনই নেই। সিভিল সার্জন নূরুল হক বলেন, ‘হবিগঞ্জ সদর, বানিয়াচং, লাখাই, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, বাহুবল ও মাধবপুরে দেড় যুগ ধরে এক্স-রে মেশিন বিকল। প্রতি মাসে ঢাকায় লোকবল ও যন্ত্রপাতি সংকটের তথ্য লিখিতভাবে জানিয়েও আমরা প্রতিকার পাচ্ছি না।’

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩ বছর ধরে বিকল এক্স-রে যন্ত্র। হয় না আলট্রাসনোগ্রামও। ইউএইচও (ভারপ্রাপ্ত) খাদিজা রহমান বলেন, ‘মেরামতের জন্য লিখিতভাবে জানিয়েছি। তবে এখনো বরাদ্দ আসেনি।’

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম এবং ইসিজি যন্ত্র নষ্ট। নেই ওটি টেবিল, ওটি লাইট। ইউএইচও আবু সাজ্জাদ মোহাম্মদ সায়েম বলেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে সাত বছর ধরে নষ্ট এক্স-রে যন্ত্র। উপজেলা চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান বলেন, নতুন এক্স-রে মেশিন বসানোর জন্য একটি কক্ষ মেরামত করা হয়েছে। ঢাকার দোহার উপজেলায় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে অটোক্লেভ ও আলট্রাসনোগ্রাম। চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেও তিনটি নষ্ট। যদিও ইউএইচও জসীমউদ্দিনের দাবি, অন্যান্য উপজেলার চেয়ে দোহার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অনেক এগিয়ে।

অর্থ-জনবল নেই, বাক্সবন্দী যন্ত্র
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে জনবলসংকটে ১৮ বছর ধরে বাক্সবন্দী এক্স-রে যন্ত্র। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেবদাস দেব বলেন, ‘আমাদের প্রায় সব মেশিনই নষ্ট। এক্স-রের টেকনিশিয়ান নেই।’ তিতাসেও দুটি এক্স-রে যন্ত্র কাজে লাগছে না। ইউএইচও সরফরাজ হোসেন খান বলেন, ‘টেকনিশিয়ান না থাকায় এক্স-রে সেবা দিতে পারছি না।’
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে ৩ বছর এবং টাঙ্গাইলের সখীপুরে ১৪ বছর ধরে বাক্সবন্দী ৫০ কেভি জেনারেটর। ঈশ্বরগঞ্জের ইউএইচও লোপা চৌধুরী বলেন, ঘণ্টায় পাঁচ লিটার ডিজেল লাগে। এর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দেও জেনারেটর টাকার অভাবে বাক্সবন্দী।

টেকনোলজিস্ট না থাকায় সাত বছর এক্স-রে হয় না বরগুনার বেতাগী উপজেলায়। কক্সবাজারের চকরিয়ায় ১৭ বছর ধরে নেই অ্যাম্বুলেন্স, প্রিন্টারের অভাবে চালু হয়নি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার চালু হয়নি আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় যন্ত্র থাকলেও লোকবলের অভাবে অস্ত্রোপচার বন্ধ সাড়ে তিন বছর। বাগেরহাটের কচুয়ায় টেকনোলজিস্ট না থাকায় বন্ধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

৪৬% চিকিৎসকের পদ শূন্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে ৪৬ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য। ৪২৭টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুমোদিত ৬ হাজার ৭৯০ পদের বিপরীতে কর্মরত ৩ হাজার ৬৯৪ চিকিৎসক। নার্স ও মিডওয়াইফ পদের ১৩ শতাংশ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদের ৩৫ শতাংশ, ডেন্টাল সার্জন পদের ৪৬ শতাংশ শূন্য। এ ছাড়া সাপোর্ট স্টাফ ৫০ শতাংশ; মাঠকর্মী ৩২ শতাংশ এবং অন্যান্য পদের ৪৩ শতাংশ পদ শূন্য আছে। সব মিলিয়ে ৩৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ শূন্য পদ নিয়ে চলেছে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা।

দেশে ৪২৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ৫টি ১০০ শয্যার, ৬টি ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণের পর্যায়ে, ৩৫১টি ৫০ শয্যার।

জনবল, যন্ত্রপাতি সরবরাহের তাগিদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এখানে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা আছে; কিন্তু যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের দায়িত্ববোধের ঘাটতি রয়েছে। প্রধান সমস্যা হলো, শূন্য পদে নিয়োগদানে দেরি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে হবে। লোকবলের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান সম্ভব হবে না।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স এবং পাঁচজন টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমেই শূন্য পদে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ দিতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। এসবের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারি থাকতে হবে।’ 

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আজকের পত্রিকার হাতিয়া, বাগাতিপাড়া, রাজৈর, কচুয়া, ঈশ্বরগঞ্জ, ত্রিশাল, কোটচাঁদপুর, বড়লেখা, কাপাসিয়া, পুঠিয়া, সখীপুর, চৌদ্দগ্রাম, তিতাস, ভেড়ামারা, জীবননগর, কামারখন্দ, ভূরুঙ্গামারী, ভাঙ্গুড়া, জগন্নাথপুর, দোহার, বেতাগী, চকরিয়া ও কেন্দুয়া প্রতিনিধি।] 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণের ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত