হাসান মামুন
সম্পাদকীয়বাজেট পেশের পর এর ওপর সংবাদ সম্মেলনও হয়ে গেল, যার অভিজ্ঞতা অপ্রীতিকর। তবে বাজেট কতটা প্রীতিকর, সেটা নিয়েই আলোচনা চলবে বেশি। এরই মধ্যে আমরা স্পষ্ট জেনে যাব, শেষতক কত রাজস্ব আহরিত হলো চলতি অর্থবছরে। এডিপির বাস্তবায়ন কয়েক বছর ধরেই খারাপ থেকে আরও খারাপ। এবার এপ্রিল পর্যন্ত এর মাত্র ৫০ শতাংশের মতো বাস্তবায়ন হয়েছিল। জুন শেষে জানা যাবে শেষতক কত খরচ করা গেল। এসব ক্ষেত্রে তো ‘সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা’ও অর্জিত হচ্ছে না।
অহেতুক ‘খরচ’ বাড়ানোর অবশ্য মানে নেই। অর্থ তো কষ্টার্জিত। সরকার প্রত্যাশামতো কর-রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না। কর-জিডিপি অনুপাত গেছে আরও কমে। এ অবস্থায় ঋণের ওপর নির্ভর করেই চলতে হচ্ছে। বিদেশি ঋণ কম মিললে নিতে হচ্ছে দেশের ভেতর থেকে। এই ঋণ গ্রহণের আরেকটি পক্ষ হলো বেসরকারি খাত। এতে তাদের সুযোগ যাচ্ছে কমে। দীর্ঘদিন তারা কম সুদে (সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ) ঋণ পেয়ে কী করেছেন, সেই প্রশ্নও আছে। সুদের হার অবশ্য দ্রুত বাড়ছে এখন। এ কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার সুযোগ কম। আগে এটা না বাড়া সত্ত্বেও কেন বিনিয়োগ একটা জায়গায় আটকে ছিল, তার অনুসন্ধানও হয়নি। বিনিয়োগ না বাড়লে তো কর্মসংস্থান হবে না। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য শর্তও পূরণ হতে হবে। মূল্যস্ফীতি যখন উচ্চপর্যায়ে বহাল, তখন আবার কাজের সুযোগ না বাড়াটা বাড়িয়ে তুলেছে সংকট।
এ অবস্থায় রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ প্রভৃতির কাজ চলতে থাকা অবশ্য ইতিবাচক। তাতে নির্মাণ উপকরণ সরবরাহের ব্যবসা অন্তত বাড়ে। ধাপে ধাপে শ্রম বিনিয়োজিত হয়। এ প্রশ্নও উঠছে, এত দিন ধরে ঘটে চলা এসব অবকাঠামো উন্নয়নের পরবর্তী সুফল কী? কোনটির সুফল পেতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? এ বাবদ সরকারের ঋণ হালে যেভাবে বেড়েছিল, তা ফেরতের চাপও বেড়ে উঠেছে এরই মধ্যে। সে জন্য সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে আরও বেশি। দেশ থেকে আহরিত ঋণ আবার বেশি ব্যয়বহুল। সে জন্য পারলে বিদেশি ঋণ বেশি করে নেওয়াই ভালো। তবে সে ক্ষেত্রে বড় প্রতিশ্রুতি মিললেও অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় কম। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বিদেশি ঋণ গ্রহণে আমাদের অসুবিধা কিন্তু বাড়বে। সে জন্য আগামী দুই অর্থবছরে যতটা সম্ভব ‘সস্তায়’ বিদেশি ঋণ গ্রহণের পরামর্শ রয়েছে। তাহলে দেশের ব্যাংক খাতে বাড়বে না চাপ। খাতটির একাংশে তো তারল্যসংকটও রয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। ব্যাংকে আস্থা কমছে গ্রাহকের। টাকা-পয়সা তারা আরও কম রাখতে চাইছে ব্যাংকে। মূল্যস্ফীতির কারণেও সঞ্চয় কমছে। বাড়ছে এমনকি সঞ্চয়পত্র ভেঙে চলার হার।
এদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলতে থাকলেও সরকার কাজটা করতে পারছে না। পুরোনো চিত্র তুলে ধরে আবার বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বেই এটা বেশি! বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাওয়া শ্রীলঙ্কাও কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে। আরও অনেক দেশ এ কাজে পেয়েছে সাফল্য। অথচ চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েও তার ধারেকাছে থাকতে পারছি না আমরা। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার প্রবণতা বরং স্পষ্ট। এ অবস্থায় বাজেটে এটিকে ৬ দশমিক ৫-এ রাখার ঘোষণায় কার বিশ্বাস জন্মাবে? সময়ে সময়ে মূল্যস্ফীতি কিঞ্চিৎ কমে আসার প্রবণতা দেখালেও দীর্ঘদিন এটা আছে ১০-এর দিকে। এর হিসাব নিয়েও রয়েছে অবিশ্বাস। বিতর্ক আছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই। গরিবের জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ যে আরও বেশি, সেটা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরাও জানেন। কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ নেই তাঁদেরও। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দলের ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের অঙ্গীকার নিয়ে সংসদে কিছু আলোচনা অন্তত হতে পারে। বাজেট বাস্তবায়নে ‘সুশাসনের অভাব’ নিয়ে হয়তো নিশ্চুপ থাকা যায়। জনগণও সেটাকে হয়তো নেয় ‘অনতিক্রম্য অভিজ্ঞতা’ বলে। কিন্তু মাসের পর মাস চলা নজিরবিহীন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তারা নেবে কীভাবে?
এ অবস্থায় কৃষিতে সরকার তার মনোযোগ ধরে রাখতে চাইছে। তবে এ ক্ষেত্রে কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিতে হাততালি দিতে থাকলে কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারজাতকরণের প্রশ্নটি থেকে যাবে অবহেলিত। এতে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে সিংহভাগ কৃষকের স্বার্থ। তার কী দায় পড়েছে নিজে অব্যাহতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সবার ‘খাদ্যনিরাপত্তা’ জোগানোর! লাভজনক বিবেচিত হলে অন্যান্য ফসলে মনোনিবেশের অধিকার তার রয়েছে। তাতে অবশ্য প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে অবনতি ঘটতে পারে। এ অবস্থায় তাকে ধান-চালের সন্তোষজনক দাম দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। বেশি পরিমাণ আহরণও করতে হবে তার কাছ থেকেই—আমদানির বদলে। ‘রিজার্ভ’ও তো অস্বস্তিকর থেকে পীড়াদায়ক অনেক দিন ধরে। প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি কঠোরভাবে কমিয়েও এ ক্ষেত্রে সাফল্য মেলেনি। তাও ভালো, আইএমএফ এ বিষয়ে চাপাচাপি না করে ‘আমাদের বাস্তবতা’ মেনে প্রতিশ্রুত ঋণ জুগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষিতে সাফল্য ধরে রাখা চাই, যাতে কৃষিপণ্য অন্তত কম আনতে হয় মহামূল্যবান ডলার দিয়ে। সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আরও স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা আনা এবং এর বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। নিজ পণ্যের উপযুক্ত দাম থেকে বঞ্চিত কৃষকও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
বাজেটটি পেশ হলো কোরবানি ঈদের আগ দিয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই দেশময় গরু-ছাগলের হাটে বেড়ে যাবে মানুষের যাতায়াত। এতে রেমিট্যান্সের ব্যবহারও বাড়বে। ঈদ-পার্বণে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি দেখে কেউ অবশ্য অবাক হয় না। তবে এর সিংহভাগ এখনো আসছে হুন্ডিতে। নতুন পদ্ধতিতে ডলারের ‘আনুষ্ঠানিক দাম’ অনেকখানি বাড়িয়েও আমরা কি পারব বিধিবদ্ধভাবে রেমিট্যান্স আসা বাড়াতে? এ অবস্থায় রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। এটাকে মনে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫-এ নামিয়ে আনার মতোই সরল আশাবাদ। নিট রিজার্ভ কিন্তু এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। এটা অবশ্য কেবল আইএমএফকে জানানো হচ্ছে, যা কিনা জনগণের জন্য অবমাননাকর। তারা কেন জানতে পারবে না নিট রিজার্ভ? না জানলে দেশের আমদানি সক্ষমতা ও আর্থিক নিরাপত্তায় আস্থা রাখবে কীভাবে? রিজার্ভ থেকে চুরির খবরও তাদের জানানো হয়েছিল অনেক পরে।
রিজার্ভ গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে যে রপ্তানি আয়, তার তথ্য-উপাত্ত নিয়েও বাড়ছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্যে বিরাট গরমিল দেখে সচেতন মানুষ হতবাক। তাতে এ সন্দেহও বাড়ছে—তবে কি রপ্তানিকারকেরা উপার্জিত ডলার না এনে তার একাংশ পাচার করছেন? নানাভাবে অর্থ পাচার একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে হালে। প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের প্রতাপশালী ব্যক্তিরা এতে বেশি জড়িত বলেই ধারণা। তবে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা কঠিন। তাঁদের ‘অনুপার্জিত আয়’কে অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসাটাও সহজ নয়। এ অবস্থায় নতুন করে টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তাতে স্বভাবতই উঠছে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অন্যায্যতার প্রশ্ন। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ আয়কর আবার বাড়ানো হয়েছে।
বাজেট পেশের আগেই আমাদের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার মালয়েশিয়া থেকে মিলল খারাপ খবর। নির্ধারিত ফির কয়েক গুণ খরচ করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যেতে পারল না সেখানে। প্রক্রিয়াটাই গেল বন্ধ হয়ে। যাদের উদগ্র লোভে এসব ঘটে চলেছে, তাদের ধরা অবশ্য অর্থমন্ত্রীর কাজ নয়। বাজেটও শুধু তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের বিষয় নয়। এটা সরকারের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্র এবং এতে বোঝা যায় দেশ পরিচালনায় তাঁর মনোভাব। এর লক্ষ্যমাত্রাগুলো অনুমিত হলেও বাস্তবসম্মত হতে হয়। যেসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাজেট প্রণীত হচ্ছে, সেগুলোও হতে হয় নির্ভরযোগ্য।
সরকার এবার কম হারে বর্ধিত বাজেট নেওয়ায় তার প্রশংসা করছেন অনেকে। বাস্তবায়নে বড় কাটছাঁট হয়ে এটা চলতি সংশোধিত বাজেটের কাছাকাছি এসে যায় কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে। সরকারপ্রধানও বলে দিয়েছেন ‘সতর্কভাবে’ প্রকল্প নিতে। মেগা প্রকল্প গ্রহণের উৎসাহ সম্ভবত কমে এসেছে ঋণ পরিশোধের চাপে। বকেয়া অনেক বিলও শোধ করতে হচ্ছে আগামী অর্থবছরে। সে জন্য বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে বেশি। নইলে বাজেট হয়তো শুরুতেই আরও ছোট করা যেত। এতে করে আবার থেকে যাচ্ছে ঋণ করে ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি। রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলে এটা আরও বাড়বে বৈকি।
বাজেট ছোট হওয়ার সমস্যা কিছুটা কাটে বাস্তবায়ন মানসম্মত হলে। তবে মান বাড়ানোর কাজটা সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জিং। জনপ্রশাসন পুষতে ব্যয় বেড়ে চললেও এর জনসেবার মান কি বাড়ছে? উন্নয়ন প্রশাসনও কি পারছে এডিপি বাস্তবায়নে পারফরম্যান্স বাড়াতে? এনবিআর কি পারছে রাজস্ব আহরণে স্বাভাবিক প্রত্যাশাটুকুও পূরণ করতে? এসব জায়গায় অনিবার্যভাবেই লাগবে জবাবদিহির সংস্কৃতি। এটা দুর্বল হতে থাকলে এ ক্ষেত্রে উন্নতির আশাটুকু ধরে রাখাও কঠিন।
লেখক: হাসান মামুন
সাংবাদিক, বিশ্লেষক
সম্পাদকীয়বাজেট পেশের পর এর ওপর সংবাদ সম্মেলনও হয়ে গেল, যার অভিজ্ঞতা অপ্রীতিকর। তবে বাজেট কতটা প্রীতিকর, সেটা নিয়েই আলোচনা চলবে বেশি। এরই মধ্যে আমরা স্পষ্ট জেনে যাব, শেষতক কত রাজস্ব আহরিত হলো চলতি অর্থবছরে। এডিপির বাস্তবায়ন কয়েক বছর ধরেই খারাপ থেকে আরও খারাপ। এবার এপ্রিল পর্যন্ত এর মাত্র ৫০ শতাংশের মতো বাস্তবায়ন হয়েছিল। জুন শেষে জানা যাবে শেষতক কত খরচ করা গেল। এসব ক্ষেত্রে তো ‘সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা’ও অর্জিত হচ্ছে না।
অহেতুক ‘খরচ’ বাড়ানোর অবশ্য মানে নেই। অর্থ তো কষ্টার্জিত। সরকার প্রত্যাশামতো কর-রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না। কর-জিডিপি অনুপাত গেছে আরও কমে। এ অবস্থায় ঋণের ওপর নির্ভর করেই চলতে হচ্ছে। বিদেশি ঋণ কম মিললে নিতে হচ্ছে দেশের ভেতর থেকে। এই ঋণ গ্রহণের আরেকটি পক্ষ হলো বেসরকারি খাত। এতে তাদের সুযোগ যাচ্ছে কমে। দীর্ঘদিন তারা কম সুদে (সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ) ঋণ পেয়ে কী করেছেন, সেই প্রশ্নও আছে। সুদের হার অবশ্য দ্রুত বাড়ছে এখন। এ কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার সুযোগ কম। আগে এটা না বাড়া সত্ত্বেও কেন বিনিয়োগ একটা জায়গায় আটকে ছিল, তার অনুসন্ধানও হয়নি। বিনিয়োগ না বাড়লে তো কর্মসংস্থান হবে না। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য শর্তও পূরণ হতে হবে। মূল্যস্ফীতি যখন উচ্চপর্যায়ে বহাল, তখন আবার কাজের সুযোগ না বাড়াটা বাড়িয়ে তুলেছে সংকট।
এ অবস্থায় রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ প্রভৃতির কাজ চলতে থাকা অবশ্য ইতিবাচক। তাতে নির্মাণ উপকরণ সরবরাহের ব্যবসা অন্তত বাড়ে। ধাপে ধাপে শ্রম বিনিয়োজিত হয়। এ প্রশ্নও উঠছে, এত দিন ধরে ঘটে চলা এসব অবকাঠামো উন্নয়নের পরবর্তী সুফল কী? কোনটির সুফল পেতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? এ বাবদ সরকারের ঋণ হালে যেভাবে বেড়েছিল, তা ফেরতের চাপও বেড়ে উঠেছে এরই মধ্যে। সে জন্য সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে আরও বেশি। দেশ থেকে আহরিত ঋণ আবার বেশি ব্যয়বহুল। সে জন্য পারলে বিদেশি ঋণ বেশি করে নেওয়াই ভালো। তবে সে ক্ষেত্রে বড় প্রতিশ্রুতি মিললেও অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় কম। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বিদেশি ঋণ গ্রহণে আমাদের অসুবিধা কিন্তু বাড়বে। সে জন্য আগামী দুই অর্থবছরে যতটা সম্ভব ‘সস্তায়’ বিদেশি ঋণ গ্রহণের পরামর্শ রয়েছে। তাহলে দেশের ব্যাংক খাতে বাড়বে না চাপ। খাতটির একাংশে তো তারল্যসংকটও রয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। ব্যাংকে আস্থা কমছে গ্রাহকের। টাকা-পয়সা তারা আরও কম রাখতে চাইছে ব্যাংকে। মূল্যস্ফীতির কারণেও সঞ্চয় কমছে। বাড়ছে এমনকি সঞ্চয়পত্র ভেঙে চলার হার।
এদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলতে থাকলেও সরকার কাজটা করতে পারছে না। পুরোনো চিত্র তুলে ধরে আবার বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বেই এটা বেশি! বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাওয়া শ্রীলঙ্কাও কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে। আরও অনেক দেশ এ কাজে পেয়েছে সাফল্য। অথচ চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েও তার ধারেকাছে থাকতে পারছি না আমরা। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার প্রবণতা বরং স্পষ্ট। এ অবস্থায় বাজেটে এটিকে ৬ দশমিক ৫-এ রাখার ঘোষণায় কার বিশ্বাস জন্মাবে? সময়ে সময়ে মূল্যস্ফীতি কিঞ্চিৎ কমে আসার প্রবণতা দেখালেও দীর্ঘদিন এটা আছে ১০-এর দিকে। এর হিসাব নিয়েও রয়েছে অবিশ্বাস। বিতর্ক আছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই। গরিবের জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ যে আরও বেশি, সেটা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরাও জানেন। কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ নেই তাঁদেরও। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দলের ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের অঙ্গীকার নিয়ে সংসদে কিছু আলোচনা অন্তত হতে পারে। বাজেট বাস্তবায়নে ‘সুশাসনের অভাব’ নিয়ে হয়তো নিশ্চুপ থাকা যায়। জনগণও সেটাকে হয়তো নেয় ‘অনতিক্রম্য অভিজ্ঞতা’ বলে। কিন্তু মাসের পর মাস চলা নজিরবিহীন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তারা নেবে কীভাবে?
এ অবস্থায় কৃষিতে সরকার তার মনোযোগ ধরে রাখতে চাইছে। তবে এ ক্ষেত্রে কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিতে হাততালি দিতে থাকলে কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারজাতকরণের প্রশ্নটি থেকে যাবে অবহেলিত। এতে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে সিংহভাগ কৃষকের স্বার্থ। তার কী দায় পড়েছে নিজে অব্যাহতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সবার ‘খাদ্যনিরাপত্তা’ জোগানোর! লাভজনক বিবেচিত হলে অন্যান্য ফসলে মনোনিবেশের অধিকার তার রয়েছে। তাতে অবশ্য প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে অবনতি ঘটতে পারে। এ অবস্থায় তাকে ধান-চালের সন্তোষজনক দাম দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। বেশি পরিমাণ আহরণও করতে হবে তার কাছ থেকেই—আমদানির বদলে। ‘রিজার্ভ’ও তো অস্বস্তিকর থেকে পীড়াদায়ক অনেক দিন ধরে। প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি কঠোরভাবে কমিয়েও এ ক্ষেত্রে সাফল্য মেলেনি। তাও ভালো, আইএমএফ এ বিষয়ে চাপাচাপি না করে ‘আমাদের বাস্তবতা’ মেনে প্রতিশ্রুত ঋণ জুগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষিতে সাফল্য ধরে রাখা চাই, যাতে কৃষিপণ্য অন্তত কম আনতে হয় মহামূল্যবান ডলার দিয়ে। সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আরও স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা আনা এবং এর বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। নিজ পণ্যের উপযুক্ত দাম থেকে বঞ্চিত কৃষকও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
বাজেটটি পেশ হলো কোরবানি ঈদের আগ দিয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই দেশময় গরু-ছাগলের হাটে বেড়ে যাবে মানুষের যাতায়াত। এতে রেমিট্যান্সের ব্যবহারও বাড়বে। ঈদ-পার্বণে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি দেখে কেউ অবশ্য অবাক হয় না। তবে এর সিংহভাগ এখনো আসছে হুন্ডিতে। নতুন পদ্ধতিতে ডলারের ‘আনুষ্ঠানিক দাম’ অনেকখানি বাড়িয়েও আমরা কি পারব বিধিবদ্ধভাবে রেমিট্যান্স আসা বাড়াতে? এ অবস্থায় রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। এটাকে মনে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫-এ নামিয়ে আনার মতোই সরল আশাবাদ। নিট রিজার্ভ কিন্তু এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। এটা অবশ্য কেবল আইএমএফকে জানানো হচ্ছে, যা কিনা জনগণের জন্য অবমাননাকর। তারা কেন জানতে পারবে না নিট রিজার্ভ? না জানলে দেশের আমদানি সক্ষমতা ও আর্থিক নিরাপত্তায় আস্থা রাখবে কীভাবে? রিজার্ভ থেকে চুরির খবরও তাদের জানানো হয়েছিল অনেক পরে।
রিজার্ভ গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে যে রপ্তানি আয়, তার তথ্য-উপাত্ত নিয়েও বাড়ছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্যে বিরাট গরমিল দেখে সচেতন মানুষ হতবাক। তাতে এ সন্দেহও বাড়ছে—তবে কি রপ্তানিকারকেরা উপার্জিত ডলার না এনে তার একাংশ পাচার করছেন? নানাভাবে অর্থ পাচার একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে হালে। প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের প্রতাপশালী ব্যক্তিরা এতে বেশি জড়িত বলেই ধারণা। তবে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা কঠিন। তাঁদের ‘অনুপার্জিত আয়’কে অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসাটাও সহজ নয়। এ অবস্থায় নতুন করে টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তাতে স্বভাবতই উঠছে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অন্যায্যতার প্রশ্ন। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ আয়কর আবার বাড়ানো হয়েছে।
বাজেট পেশের আগেই আমাদের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার মালয়েশিয়া থেকে মিলল খারাপ খবর। নির্ধারিত ফির কয়েক গুণ খরচ করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যেতে পারল না সেখানে। প্রক্রিয়াটাই গেল বন্ধ হয়ে। যাদের উদগ্র লোভে এসব ঘটে চলেছে, তাদের ধরা অবশ্য অর্থমন্ত্রীর কাজ নয়। বাজেটও শুধু তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের বিষয় নয়। এটা সরকারের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্র এবং এতে বোঝা যায় দেশ পরিচালনায় তাঁর মনোভাব। এর লক্ষ্যমাত্রাগুলো অনুমিত হলেও বাস্তবসম্মত হতে হয়। যেসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাজেট প্রণীত হচ্ছে, সেগুলোও হতে হয় নির্ভরযোগ্য।
সরকার এবার কম হারে বর্ধিত বাজেট নেওয়ায় তার প্রশংসা করছেন অনেকে। বাস্তবায়নে বড় কাটছাঁট হয়ে এটা চলতি সংশোধিত বাজেটের কাছাকাছি এসে যায় কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে। সরকারপ্রধানও বলে দিয়েছেন ‘সতর্কভাবে’ প্রকল্প নিতে। মেগা প্রকল্প গ্রহণের উৎসাহ সম্ভবত কমে এসেছে ঋণ পরিশোধের চাপে। বকেয়া অনেক বিলও শোধ করতে হচ্ছে আগামী অর্থবছরে। সে জন্য বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে বেশি। নইলে বাজেট হয়তো শুরুতেই আরও ছোট করা যেত। এতে করে আবার থেকে যাচ্ছে ঋণ করে ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি। রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলে এটা আরও বাড়বে বৈকি।
বাজেট ছোট হওয়ার সমস্যা কিছুটা কাটে বাস্তবায়ন মানসম্মত হলে। তবে মান বাড়ানোর কাজটা সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জিং। জনপ্রশাসন পুষতে ব্যয় বেড়ে চললেও এর জনসেবার মান কি বাড়ছে? উন্নয়ন প্রশাসনও কি পারছে এডিপি বাস্তবায়নে পারফরম্যান্স বাড়াতে? এনবিআর কি পারছে রাজস্ব আহরণে স্বাভাবিক প্রত্যাশাটুকুও পূরণ করতে? এসব জায়গায় অনিবার্যভাবেই লাগবে জবাবদিহির সংস্কৃতি। এটা দুর্বল হতে থাকলে এ ক্ষেত্রে উন্নতির আশাটুকু ধরে রাখাও কঠিন।
লেখক: হাসান মামুন
সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে